"চলচ্চিত্রের অতীত ও বর্তমান"
-লেলিন (১৯১৭)
শিক্ষা-সম্প্রসারণ ও আনন্দ পরিবেশন- এই দ্বৈত দায়িত্ব আধুনিক যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্করণের মাধ্যমে সংশাধিত হচ্ছে, তার নাম "চলচ্চিত্র" । প্রমোদমূলক শিল্প হিসেবে এর জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। চলচ্চিত্র শিল্প আজ সমাজের সর্বস্তরের ওপর যে অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। এর সর্বব্যাপী ও মায়া -মদির আকর্ষণের দুর্বারতার কাছে আমাদের চিরাচরিত রঙ্গমঞ্চের আবেদন- জৌলুস আজ নিষ্প্রভ। এর আবেদনের মনোহারীত্ব ও সার্বজনীনতা একে দান করেছে শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যমের মর্যাদা । শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষত: লোক শিক্ষার ক্ষেত্রে এর সাফল্যের সম্ভাবনা অসামান্য ।
চলচ্চিত্র শব্দটির অর্থ গতিশীল বা চলমান চিত্র। চলচ্চিত্রের ইংরেজি দুইটি প্রতিশব্দ রয়েছে। একটি Film এবং অন্যটি Motion Picture বা Movie. চলচ্চিত্র সৃষ্টির মূল সূত্রের জনক আরবীয় মুসলিম বিজ্ঞানী আবু আলী আল হাসান। বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৮৮৫ সালে। ফ্রান্সের লুমিয়ার ও আগস্ট ভ্রাতৃদ্বয় নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র। ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন। তিনি ১৯০৪ সালে ‘আলী বাবা অ্যান্ড ফরটি থিবস’ নামে নির্বাক ছবি নির্মাণ করেন। ১৯৩১ সালে উপমহাদেশে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রের নাম বিশ্বমঙ্গল। আর উপমাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরী । চলচ্চিত্রের নাম ‘জামাই ষষ্ঠী’।
আজ চলচ্চিত্র আমাদের কাছে আর বিস্ময়ের বস্তু নয়।কিন্তু একদিন এমন ছিল, যেদিন ছবির মানুষের হাত-পা মুখ নেড়ে রক্তমাংসের জীবন্ত নর-নারীর মত কথা বলা বা গান গাওয়া ছিল এক পরম বিস্ময়ের ব্যাপার ।চলচ্চিত্র আবিষ্করনের পূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল ফটোগ্রাফিআর, তাকে পর্দায় প্রতিফলিত করবার জন্যে আবিষ্কৃত হয়েছিল ম্যাজিক লণ্ঠন। পর্দায় প্রতিফলিত নিশ্চল ছবির সঙ্গে চলতো কথকতার মতো নীতিগর্ভ বক্তৃতা| তাও সেদিন লোকশিক্ষা ও লোকরঞ্জনের দ্বৈত ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ।
তারপর শিল্পী ও বিজ্ঞানীরা লেগে গেলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে ।সেলুলয়েড ফিতের ওপর মুদ্রিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিত্র সম্বলিত রীল থেকে চিত্র ক্ষেপন যন্ত্রের দ্বারা তীব্র আলোকের সাহায্যে পর্দার ওপর বড় করে প্রতিফলিত করে ছবি দেখানো হতে লাগল। চলন্ত ছবি দেখতে বেশ ভিড় জমে দেখে ব্যবসায়ীরাও তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করল। ক্রমশ সৃষ্টি হল সবাক চলচ্চিত্র।ছবির ফটোগ্রাফের পাশে পাশে সেলুলয়েডের ফিল্মের উপর উঠতে লাগল শব্দেরও ফটো। তখন গল্প, উপন্যাস, নাটক, অভিনয় ইত্যাদি নিত্যনতুন আনন্দের আয়োজনে যোগ দিল লক্ষ লক্ষ লোক।
চলচ্চিত্রের আনন্দ বিতরণী ও চিত্তবিনোদনী ক্ষমতা
অসামান্য। তাই চলচ্চিত্র ভূমিষ্ঠ লগ্ন থেকেই সগৌরবে লোক রঞ্জনী ভূমিকায় অবতীর্ণ। আনন্দবিলাসী কর্মক্লান্ত মানুষের দর্শনেন্দ্রিয় ও শ্রবণেন্দ্রিয়কে পরিতৃপ্ত করে নতুন কর্মোদ্যম ও কর্ম প্রেরণা সঞ্চারে তার জুড়ি নাই । কিন্তু সকল শিল্পের কাছে যেমন সমাজের একটা দাবি আছে, চলচ্চিত্র শিল্পের কাছেও তেমনি আছে সমাজের মহত্তর দাবি । তাহলে চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় ভূমিকা - লোকশিক্ষা । ছায়াচিত্র আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদানে অদ্বিতীয়, বিশেষত: ভারতের মতো দেশে, যেখানে নিরক্ষরের সংখ্যা সামগ্রিক জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ,সেখানে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ। শিক্ষাহীন মানুষ অন্ধ তার দৃষ্টিতে অক্ষর নিষ্ফল হতে পারে, কিন্তু চিত্র নিস্ফল হয় না ।এখানেই চিত্রের সার্বজনীনতা ।চলচ্চিত্র আবার চলমান জীবনের শিল্পিত বিবৃতি । সকল মানুষের দৃষ্টিতে রয়েছে তার সার্বজনীন আবেদন।ভারতের উচিত,এর পূর্ণতম সুযোগ গ্রহণ করে দেশের শিক্ষা ও লোকশিক্ষার জনপদ উন্মুক্ত করে দেওয়া।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের কুশিক্ষা ও কুরুচি সৃষ্টির ভূমিকা অসামান্য।সে দিক দিয়ে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের দায়িত্ব অসীম হলেও দেশে কুরুচিপূর্ণ চলচ্চিত্রের সৃষ্টিধারা অবারিত।আজ ভারতীয় চলচ্চিত্রে নেই কোন সুস্থ জীবনাদর্শের বলিষ্ঠ প্রতিফলন, নেই কোন মহৎ হৃদয়বৃত্তির রূপায়ণ, নেই কোন উদার চরিত্র মহিমা, নেই বাস্তবের বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি; কোন উচ্চতর শিল্প সুষমার উপস্থাপনা ও দুর্লভ। আছে কেবল অসুস্থ মনোবিকার, দেহ কামনার উন্মত্ত উল্লাস।সে দিক থেকে ভারতের ফিল্ম সেন্সর বোর্ড তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।মাঝে মাঝে তার অস্তিত্ব সম্পর্কেও প্রশ্ন ওঠে।সমালোচনার জবাবে পাশ্চাত্য দুনিয়ার চলচ্চিত্রের ঔদার্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। কিন্তু দেশটি যে আমেরিকা নয়- নিতান্তই ভারত বর্ষ, সে কথা তারা গড়াতেই ভুলে যান।তাতে প্রযোজক-পরিচালকদের অর্থাগমের পথ সুগম হয়েছে।কিন্তু সর্বনাশ হচ্ছে জাতির।
এই প্রবন্ধের ইতি টেনে বলতে পারি- ভারতীয় চলচ্চিত্র আজ বিশ্ব-বিজয় সমাপ্ত করেছে| বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ই সেই সাফল্যের পথিকৃত। কিন্তু অন্যদিকে ভারতীয় চলচ্চিত্র কে রুচি বিকারের রাহু গ্রাস করেছে।যে ছবি কারখানার শ্রমিকদের মনোরঞ্জন করে, তা অল্পবয়স্ক বালকদের যে সর্বনাশ সাধন করে, তা এই দুর্ভাগা দেশে কেউ বুঝতে চায় না।তাই দেখা যায়, কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, নির্মিত ছবি দেখবার জন্য অপ্রাপ্তবয়স্কদের ভিড় নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনীকে রাখতে হয়।তাতে চলচ্চিত্র নির্মাতা, সরকার, শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবক- কারো লজ্জায় মাথা কাটা যায় না । সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ !!
প্রবন্ধকার শেখ আসমত
0 Comments