মধুমিতা রায় চৌধুরী মিত্র'র প্রবন্ধ


  



             "বাবা-চরিত্র"

আমাদের দেশে জীবন মানেই সিনেমা আর সিনেমা মানেই জীবন। দুটি একেবারে নিজেদের সাথে জড়িয়ে আছে। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা থেকে শুরু প্রত্যেক মানুষের চরিত্রের মধ্যে সিনেমা। তাই আজ একটি বিশেষ চরিত্রকে বেছে নিলাম। সেই চরিত্র ছাড়া আমাদের জীবন, প্রাণহীন।

আজ আলোচনা করি সিনেমায় দেখা বাবাদের নিয়ে আর তাঁদের বিভিন্ন রূপ আমাদের সমাজের মধ্যে কি ভাবে মিশে আছে।
আমাদের দেশের সব ভাষার সিনেমা'তে বাবা'দের একটা ওজনপাল্লায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। এক দিকে থাকবে রাগী, দজ্জাল, অসৎ, ধনী নামক কিছু বাটখারা। অন্য দিকে দারিদ্র্য, সৌম্যভাব, উদাসীনতা, কমলরূপী, বন্ধর মতন কিছু বাবা। 
এবার একে একে সিনেমার সাথে আমাদের সকলের বাবা'কে মেলাই:-
পুরোনো বাংলা সিনেমা দিয়ে শুরু করি।
কমল মিত্র এক রাগী বাবা। 
সিনেমায়  তাঁর গলা শুনলে উত্তম কুমার, সৌমিত্র চাটুজ্যেরাও গুটিয়ে যান। 
ছবি বিশ্বাস অদ্ভুত বাবা। তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাগী কাম আদরের বাবা।এঁরা দুজন কিন্তু মেয়েদের খুব প্রিয় বাবা। একেবারে একমাত্র মেয়েদেরকে মাটিতে পা'ফেলতে দেন না।
পাহাড়ি সান্যাল আর এক রকম বাবা। অতি মাই-ডিয়ার। তাঁকে কখনও বকুনি দিতে দেখলাম না ছেলে-মেয়েদের।
গোলমালের সিনেমায়ে উৎপল দত্ত এক রাগী আবার মজাদার বাবা। আবার কালী বন্দ্যোপাধ্যায় দাদার কীর্তি সিনেমাতে একদম অন্য রকম।
‘দিলওয়ালে দুলহনিয়াতে অমরীশ পুরী এবং অনুপম খের দু’জনেই বাবা। অথচ কত অমিল। দুজনই লন্ডনে বসে দুই রকম চিন্তা নিয়ে বাঁচে। একজন মনে করেন, মেয়েদের গ্রাম্য বালিকাদের মতো রাখবেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সন্তানদেরই ভয়।
 দ্বিতীয় জন ছেলের সঙ্গে বিয়ার খাবেন। 
সিঙ্গল মায়েদের কত আলোচনা হয়। 
কিন্তু সিনেমা এবং বাস্তবে, দুই ক্ষেত্রেই সিঙ্গেল বাবারাও একশয়ে একশো।
মাসুম ছবিতে নাসিরুদ্দিন শাহ, চাচি চারশো বিশ ছবির কমল হাসান বা কুছ কুছ হোতা হ্যায়’র শাহরুখ খান, আকেলে হাম আকেলে তুমে'র আমির খান। সবাই যুদ্ধটা একা করছেন। সন্তানরা তাঁদের মনোবল। 
ভিকি ডোনার'এর  আয়ুষ্মান খুরানা, সে তো আবার অনেকটা মহাভারতের 'গাঁধারী'র রেকর্ড ব্রেক করতে চায়।
‘পা’ সিনেমায় অমিতাভ ও অভিষেক বচ্চনকে ভাবুন।  কি সুন্দর কেমিস্ট্রি। 
 ‘বাগবান’ বা ‘কভি খুশি কভি গমের’ বাবা অমিতাভ  বচ্চন আবার অন্য রকম। 
সৌমিত্র চাটুজ্জে আবার অন্য রকম বাবা। তপন সিংহের ‘আতঙ্ক'এর’ সাথে বেলাশেষের বাবা'র কোনো মিল আছে? 
বাবা'রা আসলে বাবা'ই হয়। ঠিক যেমন জীবনে হয় তেমনি সিনেমাতেও হয়। বাবা'রা চরম ঠান্ডা বা গরমকে উপেক্ষা করে সন্তানের জন্য সর্বত্র ঘুরে বেড়ান। ফিনল্যান্ড থেকে ইজিপ্ট, বা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। 
আর এই গ্রাম বাংলায়, এখনও কত বাড়িতে এক সপ্তাহের শেষে বা এক মাস বা এক বছর পর, কত কিশোর কিশোরী আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। কাজের শহর বা যুদক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরবেন বাবা। দরজায় ট্যাক্সি বা রিক্সার শব্দ হবে। ছুটে যাবে তাঁরা। বাবা এলে খুব মজা। আবার উল্টোটাও হয় এখন। শহরের ঘরে বন্দিই আছেন বাবা। সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রতীক্ষা! কখন বিদেশ থেকে ছেলে ভিডিয়ো কল করবে। ফোন না এলেই বা দেরি হলেই চিন্তার একশেষ। ওই সময়টুকুর জন্যই সারাদিনের প্রতীক্ষা।
 কত স্বপ্ন সার্থক হয়  বাবাদের হাত ধরে, কত স্বপ্ন বাতিলও হয় বাবা'দের জেদে। কত দিন যাবে, কত রাত আসবে। বাবা'রা কিন্তু ঠিক থেকে যাবে আমাদের মধ্যেই।

আজ এই আলোচনার বিষয়টিতে ইচ্ছে করেই বাবা'দের নিয়ে করলাম। আমি আজ ছয়'মাস হলো পিতৃহীনা। এই সবের মধ্যে নিজের হারিয়ে যাওয়া বাবা'কে খুব মনে পড়ছে।
পুরোনো ফেসবুক পোস্টে বাবার সাথে ছবি গুলো দেখে কান্না পায়, খুব মনে পড়ে খুব। মনে হয় এখনি বোধহয় কলিং বেলটা বেজে উঠবে। দৌড়ে গিয়ে দেখবো বাবা। আমি রেগে জিজ্ঞেস করবো কোথায় ছিলে???

উইলিয়াম ব্লেকের একটা কবিতা খুব মনে পড়ে…...
Father, father, where are you going
       O do not walk so fast.
Speak father, speak to your little boy
       Or else I shall be lost,

The night was dark no father was there
       The child was wet with dew.
The mire was deep, & the child did weep
       And away the vapour flew.

       প্রবন্ধকার মধুমিতা রায় চৌধুরী মিত্র

0 Comments