উপলব্ধি
"কালতো বাবা বাড়িতে থাকবেনা ।তাই কালই মস্ত বড়ো সুযোগ ! যেভাবেই হোক মাকে রাজি করাতেই হবে ঠাকুমা । তোমার কথা মা কিছুতেই ফেলতে পারবেনা। " - দুই বোনের আবদারে মৃণালিনী দেবী খানিকটা চিন্তায় পড়লেন । রিঙ্কি আর পিঙ্কি কে তো ছোটো থেকেই দেখছেন - ওরা থাকে পাশের ফ্ল্যাটেই । ওদের বাবার পুলিশে চাকরি, তাই ডিউটির কোনো মাথা মুন্ডু নেই। বাড়িতে প্রায় থাকেই না ।ওদের মা কল্যাণী একরকম একাই এই দুই দুরন্ত কে সামলাই। মৃণালিনী দেবী কল্যাণী কে খুবই স্নেহ করেন । তাই মাঝে মাঝে বলেন " ও পিঙ্কির মা, তুমিতো হাপায় উঠছ, তুমার মাইয়াদের মাঝে মধ্যি আমার কাছে পাঠায় দিও। "তা রিঙ্কি - পিঙ্কি যায় ও ঠাকুমার কাছে যখন তখন । এই যেমন এখন এসেছে সিনেমা দেখার প্রস্তাব নিয়ে । মেয়ে দুটো সিনেমার পোকা ।সিনেমা দেখতে পেলে দুরন্ত পনা ও বন্ধ হয়ে যায়। কল্যাণী অবশ্য ওদের কড়া শাসনে রেখেছে। এখন গরমের ছুটি চলছে । তাই সন্ধ্যায় টিভি দেখার পারমিশন দিয়ে সেই শর্তে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ওদের দিয়ে পড়াশোনাটা করিয়ে নেয় কল্যাণী । রিঙ্কি - পিঙ্কি ও আপত্তি করেনা। সিনেমা দেখার শর্তে ওরা যেকোনো কিছু করতে রাজী। কিন্তু মুশকিল হয়েছে টিভিতে সিনেমা দেখে আর মন ভরেনা ওদের। ওরা এখন চায় হলে গিয়ে বড়ো স্ক্রিনে সিনেমা দেখতে। কল্যাণী ওদের বাইরে কোথাও ছাড়তে চায়না। আর কল্যাণীর নিজের সিনেমা দেখার শখ নেই যে ওদের নিয়ে যাবে । অগত্যা রিঙ্কি - পিঙ্কি ধরে বসেছে ওদের ঠাকুমা কে। মৃণালিনী দেবী মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়লেন - সিনেমা দেখতে যে তারও বড্ডো ভালো লাগে ! সুতরাং কল্যাণীর কাছে গিয়ে একেবারে গলবস্ত্র হয়ে বললেন " ও পিঙ্কির মা, তুমার মাইয়ারা আমার সাথে সিনেমা দেখতি চায়, তুমি আর না করোনি। " মৃণালিনী দেবীর রিকোয়েস্ট দেখে লজ্জিত হয় কল্যাণী, বলে " ছি ছি মাসিমা, এভাবে বলছেন কেন? আপনার সাথে পাঠাতে কোনো আপত্তি নেই । কিন্তু আমি বুঝতে পারছি ওরা প্ল্যান করে আপনাকে দিয়ে এটা বলালো। " বলে কটমট করে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী বলে " যাচ্ছ যাও, তোমার বাবা বাড়ি এলে আমি কিন্তু সত্যি কথাই বলবো । তখন তোমরা বুঝে নিও। " এবার রিঙ্কি - পিঙ্কি এসে মায়ের হাত চেপে ধরে - " প্লিজ মা, বাবাকে একটু ম্যানেজ কোরো । " পাশাপাশি দুটো সিনেমা হলের একটাতে অমিতাভ বচ্চন এর একটা পুরোনো সিনেমা চলছে আরেকটায় নতুন সিনেমা - আমির খানের 'কোয়ামত সে কোয়ামত তক ' । ঠাকুমা আবার বচ্চন এর ভক্ত। কিন্তু রিঙ্কি - পিঙ্কির জোড়াজুড়িতে আমির খানের সিনেমাটাই দেখা হল ।তারপর ঠাকুমার সাথে মোগলাই পরোটা খেয়ে সিনেমাটার গান-" পাপা কেহেতে হ্যাই বড়া নাম করেগা " গাইতে গাইতে ওরা বাড়ি ফিরলো। বাবা বাড়ি ফেরেনি দেখে হাপ ছেড়ে বাঁচলো ওরা । তারপর থেকে ঠাকুমার সাথে সিনেমা দেখা চলতে থাকলো। বেশিরভাগ আমির খানের সিনেমা -ওদের হিরো ! আর সেই সঙ্গে ওদের পড়ার ঘরটা ভরে উঠলো আমির খানের ফটোতে। দেওয়ালের কোনো জায়গা আর বাকি থাকলোনা । একদিন দুবোন বিউটি পার্লারে গিয়ে ' দিল হ্যায়কে মানতা নেহি ' সিনেমার আমির খানের হিরোইন পূজা ভাটের মতো করে চুলের স্টাইল করে এলো।কল্যাণী বোঝাতে থাকলো " লক্ষী মা, এবার পড়ায় একটু মন দে, সিনেমাটা বিনোদনের জন্য, আর সিনেমা আর্টিস্ট দের তো এটা পেশা ।এই নিয়ে কেউ এতো মাতামাতি করে !" এইভাবে স্কুল থেকে কলেজে উঠল ওরা। পিঠোপিঠি দুবোন - দুবছর এর গ্যাপ । রিঙ্কির সিনেমা আর্টিস্ট দের ফটো কেনার নেশাটা কমে গেছে ইদানিং। ওর বিয়ের দেখাশোনা চলছে । পিঙ্কি এসে বলে " কিরে দিদি,তোর বর যদি আমির খানের মতো সুন্দর না হয়, তু্ই মেনে নিতে পারবি? " রিঙ্কি কিছু বলেনা, বোনের কথায় শুধু একটু হাসে । বিয়েটা হয়ে যায় রিঙ্কির ।পিঙ্কি এখন বড্ডো একা। ঠাকুমার বয়স হয়েছে,তাই ওরা দুবোন যেত সিনেমা দেখতে। কিন্তু এখন কার সাথে যাবে পিঙ্কি। তাছাড়া রিঙ্কি অনেক পাল্টে গেছে বিয়ের পর -এটাই খুব দুঃখের পিঙ্কির কাছে। রিঙ্কি আজকাল বলে " আর সিনেমার হিরো দিয়ে কি করবো,জীবনের হিরো পেয়ে গেছি । তোর বিয়ে হলে বুঝবি। " বোঝার দরকারই নেই - ভাবে পিঙ্কি ।কারণ সেতো বিয়েই করবেনা। কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি তে পা রেখেছে পিঙ্কি ।ও আরও পড়তে চায় শুনে বাবা আপত্তি করেনি । আমির খানের ছবি গুলো এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছে পিঙ্কি। তবে আমির খানের ও বয়স হয়েছে, বিয়েও করেছে দুবার। আজকাল বেশি সিনেমা ও করেনা। তাই পিঙ্কি এখন নতুন দের সিনেমা ও দেখছে। রিসেন্ট নতুন নায়ক সুশান্ত সিং রাজপূত এর দুটো সিনেমা দেখলো - 'এম এস ধোনি - দি আনটোল্ড স্টোরি ' আর ' ছিছোরে ', বেশ ভালোই লাগলো । কদিন পর হঠাৎ এক বন্ধু এসে খবর দিলো সুশান্ত সিং নাকি গলায় ফাঁস লাগিয়ে সুইসাইড করেছে। পিঙ্কি চেঁচিয়ে উঠলো " সেকি ! আমিতো এই সেদিন ওর নতুন রিলিস করা দুটো সিনেমা দেখলাম । এতো কম বয়সে কি এমন ঘটলো? " তারপর থেকে তো চলছে তাকে নিয়ে শোক প্রকাশ - সোশ্যাল মিডিয়ার এটাই এখন বিষয় । এসব ভালো লাগছে না পিঙ্কির । ওর মনে হচ্ছে পুরো সিনেমা জগৎ টা মানুষকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখায়। আর এক্টর রা সিনেমারই হিরো - বাস্তবের হিরো নয় কখনোই। তা নাহলে যে সুশান্ত সিং সিনেমাতে ব্যর্থতা হ্যান্ডেল করার কথা বলে, সেই নিজের জীবনের সমস্যা ফেস করতে ভয় পায়। পিঙ্কির মনে হোলো - এর থেকে ঢের বেশি সমস্যা নিয়ে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকে, জীবন থেকে পালিয়ে যায়না । সিনেমা আর্টিস্ট দের নিয়ে মাতামাতি করার সত্যিই কোনো মানে হয়না - এটা ফিল করে পিঙ্কি। অনেক দিন পর বাপের বাড়ি এসেছে রিঙ্কি।ও খুব অবাক হোলো বোনকে দেখে ।পিঙ্কি পড়াশোনাতে খুব মন দিয়েছে। আরও অবাক হোলো ওদের দুই বোনের ঘরটাতে ঢুকে। দেখলো ঘরের দেওয়ালটা একেবারে পরিষ্কার - সেখানে একটাও সিনেমা আর্টিস্ট এর ফটো নেই !
গল্পকার সুমিতা চক্রবর্তী
বেলুড়, হাওড়া
0 Comments