নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী'র অণুগল্প


অগ্নিযুগ

মহাযুদ্ধ শেষে ধরা পড়ে গেছে ওরা। অবশ্য নিয়তি জানাই ছিল ওদের। তবুও পরাধীনতার বদ্ধ জলাশয়ে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে চেয়েছিল ওরা তিনজন, নিজেদের জীবনের পরোয়া ছিল না। ওরা বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। সংক্ষেপে বিনয় বাদল দীনেশ। বাংলা মায়ের তিন দামাল যুবকেরা একদিন অসীম সাহসে ভর করে বৃটিশের কার্যালয়ের সদর দপ্তর মহাকরণে এসে পৌঁছাল। দিনটা ৬ই ডিসেম্বর। সাল ১৯৩০।

তখন সবে সকাল হয়েছে। শীতের কুয়াশামাখা নিশ্চিন্ত এক সকাল। তিনজনেই ওরা সেদিন কোটপ্যান্ট পরে সাহেবি পোশাকে সেজেছে। তাদের পোশাক দেখে আর্দালি তাদের কোনো প্রশ্ন করেনি। তারা সোজা পৌঁছে গেছে সিম্পসন সাহেবের ঘরে। তারপর পকেট থেকে সাধারণ দেশি একখানা পিস্তল বের করে সিম্পসনের কপাল লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে। গুলি ব্যর্থ হয়নি। সাহেব মারা গেছে।

মুহূর্তের মধ্যে চিৎকার আর গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। বিপ্লবীরা এবার অফিসারদের ঘরগুলি তল্লাশি শুরু করল। ভয়ে অনেকে টেবিলের তলায় আশ্রয় নিয়েছে ততক্ষণে। চারিদিকে বিপদঘন্টি বাজছে। ওদের ধরা পড়ার আর বিলম্ব নেই। বাদল অপেক্ষা না করে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিল। বিনয় ও দীনেশ সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করল। বিনয়ের কপালে গুলি লাগল। গুলি তার কপাল ভেদ করে খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গেল। সে অজ্ঞান হয়ে গেল, তবে তখনও প্রাণ ছিল। দীনেশের গলা আর চোয়ালে গুলি লাগল। সে হাসপাতালে গিয়ে বেঁচে উঠল। বিনয় হাসপাতালে জ্ঞান আসতেই বৃটিশদের চিকিৎসা নিতে হবে মনে করে তাদের করা মাথার পটি প্রবল জোরে টান মেরে খুলে ফেলল। মাথার ঘিলু বেরিয়ে এল। অসহ্য যন্ত্রণায় তার দু চোখ লাল, মুখ চোখ ফোলা। গায়ে প্রবল জ্বর। ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকা মিটফোর্ড কলেজের ডাক্তারীর কৃতি ছাত্র বিনয় মারা গেল। বিচারে দীনেশের ফাঁসি হল।

আজও লালদিঘির কাছে তাদের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে শহরের বুকে। আজ সেই দামাল তরুণেরা নেই, কেবল তাদের নামের অপভ্রংশ হয়ে বিবাদীবাগ সরণি আজও শহরবাসীদের মনে করিয়ে দিতে চায়, ফেলে আসা সেইসব দিনের কথা! সেইসব দেশপ্রেমে ভাবোন্মাদ যুবকদের কথা!   


  গল্পকার নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

মধ্যমগ্রাম, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 

















1 Comments