
প্রিয় শহর আমার
একটানা অফিসে কাজ করতে করতে যখন খুব হাঁফিয়ে উঠি, এ শহরে'র উঁচু উঁচু বহুতলে'র ছোট ছোট খুপরি'তে অগণিত মানুষের ছোট ছোট কালো মুন্ডু কম্পিউটারে ঘাড় গুঁজে পার করে দেয় কত গোধূলী আলোয় ফেরা সময়, পাখিডানা ক্লান্তি মেখে, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখা'র ও ফুরসত মেলে না, সামনের মস্ত উইণ্ডস্ক্রিন দিয়ে দেখি সূর্য'টা নতুন বউয়ের সিঁথি'র মত লালচে হয়ে সমুদ্রে'র বুকে মুখ ঢাকবে বলে লজ্জারুণ! এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ওরলি সী লিঙ্ক! এত ওপরতলা থেকে নীচের রাস্তা'র ত্রিফলা আলোগুলোকে দেখে মনে হয় দিপাবলী'র রাতের মোমের আলো। খুদে খুদে গাড়িগুলো, সাঁইসাঁই করে ছোটবেলা'র পুশব্যাক গাড়ি'র মত ছুটছে, রাস্তাগুলো যেন রাতমোহনা'র নদী কিম্বা সেই যে সেবার ডুয়ার্সে'র জঙ্গলে, মাঘমাসের শেষবিকালে'র মরে আসা আলোয় দেখেছিলাম, একটি বিশাল, যুবতী, গর্ভিণী গহুমন সাপ, তেমনই ভরন্ত! সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া আসে এলোমেলো, জোলো হাওয়া! সামনের টেবিলে বসা যুবক'টি উসখুস করে ওঠে, ঘনঘন ঘড়ি দ্যাখে, মোবাইলে টুকটাক মেসেজ করে, প্রিয় নারী'টির সাথে বোধহয় দেখা করার সময় হয়ে এলো। এখানে সাতটা'র পর সন্ধে হয়! ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বেরিয়ে যায়, রেখে যায় একটা এ্যালকোহলিক ডিও'র ঝাপটা! আমার তোমার কথা মনে পড়ে, আমার প্রিয়তম শহর! আমার সদ্য কৈশোরে'র প্রেম, প্রথম অননুভূত অনুভুতি। বন্ধু'রা বলতো —দুসসসসস, অমন হয় নাকি!? শহরের সাথে প্রেম হয়? যত্ত বাজে কথা, ওসব শহর-টহর নয় কোন মনুষ্যপুত্রে'র সাথে মন বিনিময়, বলতো দেখি!
আমি তোমার, সবুজ খোঁচা খোঁচা দাড়ি, যত কৃষ্ণচূড়া আর মেহগ্নি'র, অশোকফুলে'র অফুরান লালচে আভা'য় তোমার ওষ্ঠব্রণ'র উদ্ভাসে কেঁপে কেঁপে উঠতাম! কী সজীব সোহাগ ছিলো তোমার একপাশে বয়ে চলা নদীটি'র তিরতির ছন্দে! জেলা-শহর, খুব বড় নয়, দু-চারটে সদ্য গজিয়ে ওঠা বহুতল আবাসন তখন সেই আমাদের সদ্যযৌবনে,পুরনো বাড়ি তার সমস্ত না-বলা ইতিহাসে'র রহস্যময়তা মেখে দাঁড়িয়ে থাকতো সন্ধ্যে'র অন্ধকারে,সেই নবীন ও প্রবীণতার অদ্ভুত মিশেলে মনে হতো, যৌবন ফুরিয়ে আসা নারী'র মোহনা'র সৌন্দর্য্য যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে মন দিয়েছে এনামেল করা'য়, সদ্য যুবতীর শরীরে'র নিবিড় ফেরোমেনে'র খোঁজে। আর তুমি, আমার প্রিয় শহর সেই দুইনারী'র বিলোল চোখের চাহনি'তে, ঢঙ আর শৃঙ্গারে এমনি আত্মমগ্ন যে আমার প্রতিদিনে'র ফুল ফোটানোয় তোমার মন নেই। নিখাদ প্রেমে পড়েছিলাম তোমার, বর্ধমান রাজাদের ইতিহাস জড়ানো এ শহর শতাব্দী-প্রাচীন, তিলোত্তমা শহর সুন্দরীদের থেকে ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি'তে অনেক এগোনো তোমায়, আমার সদ্য-যুবক কেন যে মনে হতো! যত মন্দির-মসজিদগুলো তোমার বুকে'র পাঁজর, ভোরে'র অস্ফুট আলো'য়, আজানে'র শব্দে তোমার দিন শুরু হতো, শেষ হতো আরতি'র ঘন্টাধ্বনি দিয়ে! চাঁদে'র আলোয়, পুরনো ছাদে'র আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কতো রাত আমি তোমায় প্রেমপত্র লিখেছি, চোখের জলে, তুমি জানতেও পারোনি। ঝড়ে'র বিকালে প্রকৃতি'র তান্ডবের পর, হেঁটে গেছি আনমনে একা উদ্দেশ্যহীন শুধু এটুকু দেখতে, কেমন আছে আমার শহর! আমার প্রথম ঐহিক প্রেম, বিয়ে, সন্তান সমস্ত তোমার বুকে, কিন্তু তারা কখনো তোমার সাথে বিচ্ছিন্ন করেনি আমায়, তুমি যেন সেই তুমি। আমার দুঃখজাগানিয়া, ঘুমভাঙানিয়া...
রুটি-রুজির তাগিদে ছেড়ে এসেছি তোমায়, তবু নিশিদিন তোমায় ভাবি, ভালোবাসি। তুমি আমায় একটুও মিস করো? তোমার ছোট ছোট অলিতে-গলিতে, রাজপথে, আজও খুঁজলে পাওয়া যাবে আমার পায়ে'র ছাপ, তোমার বৃক্ষ-বল্কলে চুমু এঁকেছি হাজারবার, আজও ঘষে তুলে ফেলতে পারিনি তোমার সান্নিধ্য। দিনে'র মতো জীবনও ফুরিয়ে আসছে, তোমায় দেখি রোজ, দেখিনা বলেই। তোমার জন্য বড় মনখারাপ, আমার শহর, তোমার মাটি'র বুকে যেন শেষ নিঃশ্বাসটুকু ফেলতে পারি, আমায় ফিরিও না তুমি। এই নশ্বর জীবনে'র সবটুকু গ্লানি অপনোদন করতে চাই তোমার কপাট বুকে! তুমি আমায় জড়িয়ে নিও তোমার নদী, গাছ,মাটি আর উদাত্ত আকাশে। বাঁচা'র জন্য একটা জীবন খুব ছোট গো, পরের জন্মে সূর্যাস্তে'র আলো হবো আমি, চুমু দেবো তোমার কপালে!
ইতি,
তোমার,প্রেমকাতরী আমি।
1 Comments
খুব ভালো লাগলো। কলমের অনবদ্য সৃষ্টি।
উত্তরমুছুন