উত্তম সিংহের গল্প


সুনীল নির্বাসন

“ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দূরে, 
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ, হতভম্বআমি যদি চিৎকার করে বলি ভালোবাসো? চুপ করে থাকবে? নাকি সেখান থেকেই আমাকে বলবে ভালবাসি,ভালবাসি...”

-“বা খুব সুন্দর হয়েছে অনিন্দ্য। মানতেই হবে তোমার গলায় জাদু আছে। তা কেমন আছো বল?”

-“এই সব ভালোবাসা বাসী নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছে।বৌমা দাদুভাইকে নিয়ে ফেসবুক লাইভেই এখন আমার প্রতি সন্ধ্যা কাটে।ইউটিউবে কবিতায় অনিন্দ্য নামে একটা 
চ্যানেলও খুলেছি।সাবস্ক্রাইব করে রাখতে পারো, সব 
আপডেট পেয়ে যাবে।”

-“ ওসব আমার পোষায় না ভাই। কাল তুমি ভার্চুয়াল আড্ডার কথা বলার 
পর থেকেই কসরত শুরু করেছিলাম।আজ নাতিটা হেল্প করায় তবে চালু হল।বুঝতেই পারছ আমার দৌড়!”

-“ তাইতো বলতাম দীপকদা একটু মর্ডান 
হন। তখন তো গায়ে মাখতেন না।কেবল খেসসা করতেন।মোবাইল নাকি জাহান্নামে যাওয়ার পথ।এখন মুদির দোকান থেকে ব্যাঙ্কের কাজ সবই মোবাইলে সারতে হচ্ছে!”- কথা গুলো কে বলল দেখা গেলনা।কেবল টিপ্পনীটি ভেসে এলো কানে।মোহন বাবু গলা শুনে ঠিক ধরেছেন।বুকের বোতাম ঠিক করতে করতেই চেঁচিয়ে উঠলেন- “অতুল কোথেকে বলছ ভাই? তোমাকে তো দেখতেই পাচ্ছিনা।আড্ডায় মুখ না দেখতে পেলে কথা বলে 
মজা হয়?”

ভিডিও বটন অন করে অতুল চন্দ্র প্রকট 
হলেন। তাকে দেখে বাকিরা এক সুরে বলে উঠলেন-“ অতুল 
এতটা ওজন কমালে কি করে? তোমায় তোবছর তিরিশের যুবক লাগছে হে!”

অতুল বর্মন মুচকি হেসে বললেন- “সবই নিখুঁত যোগ বিয়োগের ফল দাদা”

আবার সমস্বরে-“ মানে?”

-“ মানে।সকাল বিকাল ঘণ্টা খানেক ব্যায়াম যোগ 
করেছি। বিয়োগ করেছে খাওয়া দাওয়া।ভাত ছেড়ে ধরেছি ডালিয়া ওটস”

পাশের ফ্রেম থেকে দীপক বাবু মুখ 
বাড়ালেন-“ তুমি দেখছি বাড়ির নতুন বউ 
হয়ে গেছ।খামোখাই জিরো ফিগারের দিকে ছুটছ।বাবা বছর ঘুরতেই পেট তো বড় হবে”।কথা গুলো হজম হল না অতুলের।সে বেশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল-“ দীপকদাএই হল আপনার সমস্যা।ভাল কিছু দেখতে পারেননা”

পরিস্থিতি উওপ্ত হতে দেখে অনিন্দ্য ভট্টাচার্য মধ্যস্থতায় এগিয়ে এলেন-“ 
তোমাদের এইলেগ পুলিং ছাড় তো।অনেকদিন পর আবার সবার সাথে দেখা 
হল, সবাই কেমন আছো বল?”

মোহন রায় মোবাইলের ফ্রান্ট ক্যামেরা 
সামলাতে সামলাতে একরাশ হতাশা উগড়ে 
দিলেন-“ আর আছি! ফাইন দিতে দিতে লকডাউনে আমার পকেট ফাঁকা হয়ে গেল?”

“অকারনে বাইরে বেরুলে পুলিশ তো ধরবেই। তার জন্য ওদের দোষ দেওয়া যায় না”- দীপক ধড়ের কথা গুলো বিজ্ঞের মতই শোনায়।

“ না রে ভাই।ছেলের স্ট্রিক ওর্ডার আছে বাইরে যাওয়া যাবে না।কেবল বিকালে ছাদে উঠে পাচারি কর।প্রথম দিন থেকে তাই অক্ষরে অক্ষরে 
পালন করে যাচ্ছি।আসলে মুশকিলটা হল বৌমার 
ফতোয়াতে।”

নিজের কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারল না অতুল-“ ফতোয়া? কিসের ফতোয়া?”

মোহন নিষ্পাপ গলায় বললেন-“ হাঁচির।প্রতি হাঁচিতে দশ টাকা করে ফাইন।আমার আবার ডাস্ট অ্যালার্জির ধাত।কাজের বউকে বারবার বলেছি আমার সামনে ঝাঁট দিবিনা, ঝুল ঝারবি না।কিন্তু কে শোনে কার কথা।আমি যেখানে যাই ঝাঁটা হতে সেও আমার পিছনে পিছনে ছোটে।তার পিছনে বৌমা খাতা হাতে রেডি।হাঁচি নাক থেকে বেরুল কি বেরুলনা ট্যালি মার্ক উঠে গেল খাতায়।শেষে হিসেব করে পাওনা গণ্ডা আদায় করেতবে রেহাই।আমার পকেট কাটা টাকায় কি হচ্ছে শুনলেআরও অবাক হবে।সে টাকা জমা হচ্ছে আমার অধাঙ্গিনীর 
ভাঁড়ারে। প্রতি রবিবার তা দিয়ে যোমাটো না ফোমেটো কিসব আছে না! ওখান থেকে ছাইপাঁশ সব অর্ডার করে খাওয়া হচ্ছে।”

মোহন বাবু মনের দুঃখ প্রকাশ করতে পেরে কিছুটা হালকা হলেন।তার কথা রেশ ধরে দীপক ধড় বললেন-“ মোহন তোমার তো তাও ভাগ্য ভালো।পেটে যাচ্ছে। আমার তো সব ধোঁয়ায়।”

নিজের দোসর পেয়ে মোহন রায় এতক্ষণে তরতাজা-“ কেন কেন, তোমার আবার কি 
হল?”

“আর বল না, দিনে একটা সিগারেট না 
খেলে আমার আবার রাতে ঘুম আসেনা।বাইরে বেরুতে পারছিনা,খাব কি করে? 
প্রথম কদিন খুব চেষ্টা করলাম,এই সুযোগে 
যদি সিগারেট ছাড়া যায় তবে বেশ ভালোই হয়।কিন্তু কথায় আছে না চোর না শোনে ধর্মের কথা।সন্ধ্যে হলেই সিগারেটের নেশা চাগর দিয়ে ওঠে
রাতের দিকে নিজেকে পাগল পাগল মনে 
হয়।ঘুম আনতে রীতিমত কসরত করতে হয়।কখনো কান ধরে উঠবস।কখনো ডন বৈঠক।একদিন তাতেও ঘুম এলো না।পাচারি শুরু করলাম।দেখি নাকে কেমন চেনা চেনা গন্ধ ঠেকছে।রাত পাওয়া নিশির মত আমি গন্ধের পিছু নিলাম।দোতলা পেরিয়ে তিনতলায় গিয়ে দেখি সদ্য কলেজে ওঠা দাদুভায়ের হাতেখড়ি হয়ে গেছে।আমাকে দেখে প্রথমটাই ভীমরি খেয়েছিল ঠিকই তবে কাউন্টার পার্ট চাইতেই বেশ সহজ হয়ে গেল।ফটাফট মোবাইল ক্যামেরায় গোটা কতক ছবি ও তুলে নিল।ছবি কি হবে জানতে চাইলে বলল কাউন্টারের পার্টনার কে, তা বন্ধুদের দেখাতে হবেনা”

অতুল হাসতে হাসতে বলল-“ দীপকদা আপনি করেছেনটা কি! বায়ু দূষণে নাতিকে সঙ্গী করলেন!”

-“ ওখানেই তো যত গণ্ডগোল। শালার ছেলে প্রতিদিন আমার কাছে এক প্যাকেট সিগারেটের দাম নেয়। আর আমার ভাগ্যে জোটে মাত্র একটা কাউন্টার। বেশি কিছু বললেই, বলে ছবি গুলো বাবার হোয়াটসআপে পাটিয়ে দেব নাকি?”

অনিন্দ্য হাসতে হাসতে বললেন-“ এতো রীতিমত ব্ল্যাকমেলিং”

দীপক বাবুর গলায় একরাশ আপসোস-“তবেই বোঝ আমরা কোন যুগে বাস করছি!”

হো হো করে হেসে উঠল সকলে। লকডাউনে এই প্রাণ খোলা হাসি থেকে বঞ্চিত এরা সবাই। রিটায়ার্ড লাইফের বিনোদন বলতে ছিল বিকালে ঘণ্টা দুয়েক গোলাপবাগ মোড়ের রামগোপালের চায়ের দোকানে নির্ভেজাল আড্ডা। কোভিড এসে কেমন যেন সব ছন্নছাড়া হয়ে গেল। এক শহরে থেকেও কেউ কারও সাথে দেখাটুকু করতে পারছে না। তবে বিজন বাবুর কথা আলাদা। মার্চের প্রথমে মেয়ের কাছে উড়ে গেছেন। এমনিতে তার পিছুটান বলে কিছু নেই। বছর খানেক হল স্ত্রী গত হয়েছেন। এখন নিজের বলতে ওই এক মেয়ে। বছরে মাস খানেক তার কাছে থাকেন আবার ফিরে আসেন কবিতার টানে। ওনার আবার অদ্ভুত যুক্তি, তেইশ তলার উচ্চতায় নাকি কবিতা আসেনা। কবিতা লিখতে মাটির কাছাকাছি থাকতে হয়। তাই ওখানে বেশিদিন থাকলে তার মন খারাপ করে। এবার তো দেখতে দেখতে প্রায় সাত মাস হয়ে গেল।

-“বিজনটা কেমন আছে কে জানে। বর্ধমানের জল হওয়া না পেলে ও ভীষণ ঝিমিয়ে পড়ে”- অনিন্দ্যর গলায় বন্ধুর জন্য একরাশ উদ্বেগ বেড়িয়ে এলো। আর তখনই সবাইকে অবাক করে বিজন মৈত্র স্কিনে ভেসে উঠলেন।–“ দাদা অনেকদিন বাঁচবেন, আপনার কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ”- একসাথে আড্ডা দিলেও অতুল সবসময় তাদের বয়সের তফাতকে মান্যতা দিয়ে আসে।

কেউ আশা করেনি বিজন আড্ডায় যোগ দেবে। এখানে বিকাল হলেও অ্যারিজনায় ভোর রাত। তাই বিজনকে চোখের সামনে দেখে সবাই আনন্দে আত্মহারা। দীপক বাবু তার রুপ দর্শনের তারিফ করলেন-“ চাপ দাঁড়িতে বেশ মানিয়েছে তোমাকে। ফ্রেমটা চেঞ্জ করেছ মনে হচ্ছে। কেত পড়ল? ওখানে তো সবই ইক্সক্লুসিভ তাই না?”

বিজন মৈত্র মুচকি হাসলেন-“ আমার কথা ছাড়। তোমরা কেমন আছো বল? রামগোপাল চায়ে চিনির হাত কমিয়েছে না আগের মতই আছে? মোহন তুমি চিনি দেওয়া চা টা ছেড়েই দাও। শেষ বার তোমার পিপি হাই ছিল মনে আছে তো? আর অনিন্দ্য, তোমার হাঁটুর ব্যাথা, সে কি হরতাল দিয়েছে নাকি নতুন উদ্দমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দীপক তোমার ছেলের অফিসে কিসব গণ্ডগোল চলছিল বলেছিলে না?  তা সব ভালোয় ভালোয় মিটেছে তো? অতনু ভাই তোমাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। এটা ধরে রেখ।”

বিজনের এই আন্তরিকতার কাছে সবাই মুগ্ধ হয়ে থাকে। দূরকে কাছে টানার অপার জাদু যেন বিজনের করায়ত্ত। ভালোবাসার প্রতি নিষ্ঠা তাকে অনন্য করে তুলেছে। স্ত্রী চলে যাবার পর তিনি একাই থাকতেন তবু নিজেকে কখনই বিপন্ন মনে করেননি। সবাই কার মাঝে নিজের একাকীত্বকে ভুলে থেকেছেন।

দীপক বাবুর ছেলের অফিসে শুধু হাঙ্গামাই মেটেনি, ছেলের প্রমোশনও হয়েছে। সেই খুসির খবরটা দিয়ে দীপক বাবু বিজনকে বললেন-“ অনেক দিন তোমার গলায় কবিতা শুনিনি। আজ একটা কবিতা বলতো, শুনি।”

বন্ধুর অনুরোধ ফেরাতে পারলেন না বিজন। স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে শুরু করলেন –“ যদি নির্বাসন দাও,আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো। আমি বিষপান করে মরে যাবো...”

কবিতা শেষ হল না। যান্ত্রিক গোলযোগে কেটে গেল। একে একে সবাই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সান্ধ্যকালিন আড্ডা, যাকে বলে মাঠে মারা গেল।

বিরক্তি নিয়ে অনিন্দ্য উঠতে যাচ্ছিলেন। তখনই ফোনটা বেজে উঠল। সুমনা, মানে বিজনের মেয়ে ফোন করেছে। অনিন্দ্য বন্ধুকেই আশা করেছিলেন ওপাশে। তার বদলে সুমনার ভারাকান্ত গলা ভেসে উঠল-“ কাকু, বাবা আর নেই। গতকাল হঠাৎ ...” কথা শেষ করতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।

স্বগত উক্তির মত একরাশ বিস্ময় মনকে আকুল করে বেড়িয়ে এলো-“ নেই মানে?”

সুমনার কাছে সবটা শুনে অনিন্দ্য ভেঙে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন-শেষে মাটির অমোঘ টানই মানুষটাকে সমূলে উচ্ছেদ করে গেল। সম্বিৎ ফিরল সুমনার কথায়–“ শেষদিন অবধি কেবল আপনাদের নাম করত। আপনাদের না দেখতে পাড়ার আপসোস নিয়ে মানুষটা চলে গেল”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অনিন্দ্য। সুমনাকে কি সান্তনা দেবেন। একটু আগের আড্ডার কথাটা ইচ্ছা করেই চেপে গেলেন। সুমনার সাথে কথা শেষ করে অনিন্দ্য সবাইকে ধরলেন কনফারেন্সে।

বিজনের মৃত্যুর খবরে সবাই স্তম্ভিত। সবার চোখে মুখে একটাই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে-“এতক্ষণ আমরা তবে কার সাথে কথা বলছিলাম?”

কারোর আর বুঝতে অসুবিধা হল না, অতৃপ্ত আশা পূরণ করতে মৃত্যুর পরও বিজন মৈত্র তদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন। এভাবেই বোধহয় অতৃপ্ত ইচ্ছে নিয়ে তারা ফিরে ফিরে আসে।

বেদনার রঙ মেখে গাঢ হল রাত। তুমুল বর্ষনে জোড়াল পৃথিবীর বুক। যোজন ক্রোশ থেকে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে এলো চেনা সেই কণ্ঠ- যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াব...

 গল্পকার উত্তম সিংহ 
বড়শুল, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ

















1 Comments