
দূর! ভাল্লাগেনা
বাইরে ঢাকের কাঠি বেজে উঠল। ছোট্ট রিম্পি তড়াক করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। আজ তো ষষ্ঠী। এক্ষুনি নতুন ফ্রক পড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। এখন আর খাওয়ার সময় নেই।মা আজও পেছন পেছনে দুধের গ্লাস নিয়ে দৌড়োচ্ছে।একেবারে এক ঢোঁকে গ্লাসের দুধটুকু শেষ করে মার শাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে রিম্পি বাড়ির পাশের পুজো মন্ডপে এসে দাঁড়াল। বাঃ আজকে কত্ত সুন্দর লাগছে দুর্গা মাকে। গত একমাস ধরে রিম্পির বাবার হাত ধরে কুয়াশা মাখানো ভোরে বেরিয়ে দেখতে যাওয়া অজয় কাকুর কুমোরটুলির হাতের ছোঁয়ায় একটু একটু করে বেড়ে ওঠা মাটির অবয়বটি যেন আজ তার দিকে দেবী রূপে তাকিয়ে। আবার ঢাকের কাঠি বেজে উঠল। রিম্পি এক ছুট্টে কিছুটা দূরে আরেকটি পুজো মন্ডপে এসে উঁকি দিল। নাঃ এখানের দুর্গা মার পরণের লাল রঙের শাড়িটি যেন আগের দুর্গা ঠাকুরের থেকে বেশি সুন্দর। রিম্পি ছোট্ট শরীরের ভেতর দিয়ে প্রবল খুশির জোয়ার বয়ে চলেছে। বাঁধন ছাড়া এক দুর্নিবার খুশি।এরই মধ্যে পাড়ার রিম্পির দুই বন্ধু পলি, নীলা চলে এসেছে। তাদের হাতে ধরা ক্যাপ বন্দুক। রিম্পির যে একটা বন্দুক ফাটাতে খুব ইচ্ছে করছে। কাঁচুমাচু মুখে পলিকে তার ইচ্ছের কথা বলতেই পলি হেসে তার হাতে ধরা বন্দুকটি রিম্পির দিকে এগিয়ে দেয়। প্যান্ডেলের পাশে কাঠের চেয়ার পাতা হয়েছে। বিকেলে সেখানে সাংস্কৃতিক উৎসব। বিকেলে সবার আগে গিয়ে চেয়ারের সামনের সিটটা দখল করতে হবে। পাড়ার রিজু দাদাদের আজ নাটক আছে যে। আজ অষ্টমী পুজো। হাতে গুনে গুনে বারোটা নতুন ফ্রকের মধ্যে রিম্পি আজকে ছোটকার দেওয়া পিঙ্ক রঙের শার্টিনের ফ্রকটি পড়ল। একবারে দুর্গা ঠাকুরের হাতে ধরা পিঙ্ক রঙের পদ্মের মতো। নবমীতে পাড়ার বন্ধুদের সাথে প্যান্ডেলের কাঠের চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে খিচুড়ি ভোগ খাওয়া। আজকে খাবার সময়ে একটুকুও মার কথা মনে পড়েনি। বন্ধুদের সাথে খুশিতে ডগমগ হয়ে গল্প করতে করতে রিম্পির অনেক বেশি খিচুড়ি খাওয়া। সন্ধ্যায় বাবা মার হাত ধরে রিম্পির পুজোর মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে হাতের কর গুনে ঊনিশটা ঠাকুর দেখা। সাথে সস্তার দোকান থেকে কেনা লাল কুমড়ো সসের এগরোলে কামড় বসানো। দশমীতে মা, পাড়ার সব কাকিমাদের ঠাকুর বরণ ।তারপর সিঁদুর খেলা। রিম্পির পুজো মন্ডপের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে দুর্গা ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে থাকা। তার মতোই দুর্গা ঠাকুরের মুখটা কেমন যেন ভার ভার। অসুরের মুখটাও যেন আরো বেশি হিংসাত্মক। সন্ধে হয়ে গেছে সব ঠাকুরের আজ বিসর্জন হয়ে গেছে। চারিদিকে ঝলমলে রাস্তা গুলোও কেমন যেন ক্লান্ত। একটু একটু শীতের আমেজ আসছে। রিম্পির বড্ড মন খারাপ। পুজো শেষ, আনন্দ শেষ। আবার মার বকুনি, পড়াশোনা,স্কুলের হোমটাস্কের খাতা খুলে বসা,কঠিন কঠিন অংক মগজাস্থ করা। দূর! ভাল্লাগেনা।
ভোরে ঢাকের কাঠির অনুরণনে রিম্পির ঘুম ভাঙল। ষষ্ঠীর দিন আজ কোথাও যাওয়ার প্ল্যান নেই। কানের মধ্যে বালিশ চাপা দিয়ে রিম্পি আবার পাশ ফিরল। আজ সপ্তমীতে অবশ্য কলেজের বন্ধুদের নিয়ে রিম্পি ম্যাডাক স্কোয়ারের আড্ডায়। প্রবল চিৎকারে হৈ হুল্লোর করে এক জমাটি আড্ডা। সাথে হাতে ধরা পেপসির বোতল। রাতের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখে বাড়িতে ঢোকার মুখে পাড়ার পুজো মন্ডপে উঁকি দেওয়া। এখন সেই সাবেকি দেবী প্রতিমার বদলে ছোট ছোট , বেঁটে বেঁটে ঠাকুর। থিম পুজো। ছোটবেলার মতো দুর্গা ঠাকুরের হাসি মুখ যেন এই ব্যস্ত ধরনীতে উধাও। দুর্গা ঠাকুরের মুখে চিরপরিচিত মা মা ভাবটাও যেন অদেখা। দুর্গা ঠাকুরের সব ছানা পোনা লক্ষ্মী,সরস্বতী,কার্তিক, গনেশও এখন তাদের মায়ের সঙ্গ ত্যাগ করেছে। অসুরকেও তো দেখা যাচ্ছেনা। নবমীতে সকলের একসঙ্গে ভোগের খিচুড়ির বদলে বাড়িতে বাড়িতে পাড়ার ক্লাবের স্বপন কাকুর দেওয়া পোলাও এর প্যাকেট।সন্ধ্যায় পাড়ার ছেলে মেয়েদের নাটকের বদলে মিস জলির গানের অনুষ্ঠান। কাঠের চেয়ার নেই। সব প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। রিম্পির এখন পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার সময় নেই। সব বন্ধুরা মিলে আজ আমেনিয়ায় হামলে পড়া। রাতের দিকে মিস জলির প্রবল উদ্দামে নৃত্যের সাথে সাথে বিকট আওয়াজে গান গাওয়া। চেয়ারের পাশের এদিক ওদিক জনা কত শ্রোতার সিটি ছোঁড়া। দশমীতে ঠাকুর বিসর্জনের সাথে সাথে রিম্পির সামান্য মন খারাপকে পাত্তা না দিয়েই বই এর পাতায় মুখ গোঁজা।পরীক্ষা একেবারেই ঘাড়ের কাছেই। একটু সময় পেলে মনের মতো পরীক্ষা দেওয়া যেত। দূর ! ভাল্লাগেনা।
সকাল থেকেই মন খারাপের ঢাকের একটানা সুর। মনটা খুবই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এক অজানা মন খারাপ।সকাল হতে না হতেই স্মার্টফোনে শুভ ষষ্ঠীর সুপ্রভাতের টুং টুং শব্দ। ছেলেটা সকাল থেকেই বেড়িয়ে পড়েছে বন্ধুদের সাথে। বলে গেছে আসতে রাত হবে। রিম্পি তার বহুতলের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাস্তা ঘাটে লোকজন খুবই কম। সপ্তমীতে সঞ্জয়ের বন্ধুদের নিয়ে সন্ধ্যায় আড্ডা।আড্ডায় চলবে স্কচ, হুইস্কির, ফোয়ারা। আর সাথে গরম ধোঁয়া বের করা চিকেন বেকড। বাইরে ভিড় ভাট্টার মধ্যে ঠাকুর দেখার তো প্রশ্নই ওঠেনা। তার চেয়ে ঘরের শীতল মেশিনের হাওয়ায় গল্প করতে করতে নিজের স্ট্যাটাস দেখানোই ঢের আরামের। অষ্টমীতে অবশ্য দামি লাল পেড়ে ঢাকাই শাড়ি পরে কমপ্লেক্সের ভেতরে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি। নবমীতে কমপ্লেক্সের ভেতরেই চোখের সামনে অনবরত ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ দেখতে দেখতে গেট টুগেদার। দুর্গা ঠাকুরের বিসর্জনের পরেও রিম্পির মন খারাপ হলোনা। রিম্পির চোখের সামনে ধরা দশমীতে ঠাকুর বরণ, সিঁদুর খেলার ফেসবুকের বিভিন্ন পোজে তার ছবি পোস্ট। রিম্পির মুখটাও আজ দুর্গা ঠাকুরের বিসর্জনের মতোই কেমন ভার , ভার। পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস বাগচীর ফেসবুকের আপলোড করা ছবির লাইক, কমেন্ট যে তাকে ছাড়িয়ে তরতর করে দৌঁড়াচ্ছে। দূর! ভাল্লাগে না।
0 Comments