
দুগ্গাপুজোর দম্পতিকথা
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা...”
কুহু - কি ব্যাপার সকাল দশটায় উঠে আগমনি শ্লোক আওড়াচ্ছো?ভোর চারটেতে তো কোনওকালে চোখ খুলতে পারোনা।আজও কতোবার ডাকলাম।সেই কোলবালিশ অন্য দিকে ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লে।কেমন বাঙালি গো তুমি?
অর্চি - যেমন বাঙালি দূর্গাপুজো মানে শুধু চুটিয়ে আড্ডা আর বিরিয়ানি খাওয়া বোঝে,তেমন
নির্ভেজাল শ্রেণিহীন বাঙালি।
কুহু - হ্যাঁ,সেইইই।দেখেছো কতো কিছু হয় এই দেশটায়।সকাল চারটে থেকে আজ আগমনি প্রোগ্রাম হচ্ছে বিভিন্ন মন্দিরে।কি সুন্দর সব নাচ,গান।কতোরকম আগমনের সাজে ফটোশুট।মহালয়ার স্তোত্রপাঠ।কেমন দেখো ঠান্ডা উপেক্ষা করেও সবাই নতুন শাড়ী পাঞ্জাবি পড়ে...
অর্চি - এই তো পথে এসো গিন্নি,শেষ অব্দি সেই পাঞ্জাবি,শাড়ী।কলকাতায় থাকাকালীন এমন
পাঞ্জাবি পড়িনি যা তোমার পাল্লায় পড়ে এই নিউজার্সিতে পড়ছি।ভাবছি আগে বাঙালি ছিলাম না এখন বাঙালি হচ্ছি?যত্তসব।
কুহু - হুহ,ওই তো না তোমার শুধু কথার মারপ্যাচ।যেমন দেশ তেমন বেশ শোনোনি কথাটা?আর তাছাড়া ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না।বরং এই দ্রুতগতির জীবনে যখন অনেককিছুই খুব জটিল ,
তখন এরকম সখ আহ্লাদ যদি একটু মন ভালো করে,সেটাকে আমি বেঁচে থাকার রসদ বলি।
বুঝেছো?
অর্চি - হমমমম তা মানলাম।শুধু শেষ অব্দি সবটাই শারদসম্মান প্রতিযোগীতা না হলেই হলো।
কুহু - মানে?
অর্চি - মানে কিছুনা।আচ্ছা কুহু তোমার মনে পড়ে আমাদের ফেলে আসা পুজো?
কুহু - হমমম,মনে আবার পড়ে না?জানো কি চমকে উঠতাম ক্যাপ ফাটানোর আওয়াজে?চিরকালই কেমন যেনো একটা ভীতুর ডিম আমি।
অর্চি -সে তো তুমি এখনও বার্থডে পার্টিতে বেলুন ফাটলে আমায় খোজো।অথচ কি বির মহিলা তুমি বিভিন্ন এসোসিয়েশনে।
কুহু -দূর আমি এখনও বেমানান এই সব হাই-এন্ড বাঙালি পার্টিতে।ভাবি কতক্ষণে হাইহিল ছেড়ে চপ্পল গলাবো আর দশ কেজি ওজনের শাড়ী ছেড়ে রং ওঠা টিশার্ট পড়বো।উফফ রং ওঠা জামায় যা আরাম তা কি আর রাফেল শাড়ীতে আসে।
অর্চি - আমার দুর্গাপুজো কিন্তু রং ওঠা টিশার্টে কেটেছে অনেকবার জানো।উফফ সেই সব দিন।বাড়িতে পুজো হলেও পাড়ার প্যান্ডেল যেনো চিরকালই আমার নেশা।কবে যে প্যান্ডেলের সামনে ক্যাপ ফাটানো থেকে প্যান্ডেলের পেছনে প্রথম সিগারেট টানা হয়ে গেছিলো,বুঝতেই পারলাম না।সাকুল্যে দুটো কি তিনটে টিশার্ট,শার্টই তখন বেশি।এখনও মনে আছে মা মাসিকে বলতো “ছেলেকে শার্ট দে।স্কুলের ফাংশন বা কলেজের ইন্টারভিউতে তাহলে পরতে পারবে।” সারাদিন তখন ভোগ বিতরণ পাড়ায়।সন্ধ্যেবেলা দেদার ঢাক বাজানো। অষ্টমিতে সবাইকে সাহায্য করা যাতে সবাই ঠিক মতন অঞ্জলি দিতে পারে।এই তোমার মনে আছে কুহু,পাড়ার ফুলদিদা আবার চোখে কম দেখতো,ভালোজেঠিমার কোমরে ব্যথা,তাদের সব হুজ্জুতি পুইয়ে সন্ধিপুজো দেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া...
কুহু - সে সব সুখস্মৃতি গো।
অর্চি - তাহলে?এসব করে পাঞ্জাবি পড়ার সুযোগ থাকতো না বুঝলে?যখন ধুলো উড়িয়ে জনস্রোত
ঢুকতো প্যান্ডেলে ওমন ফুলবাবুটি হয়ে থাকলে কোচা খুলে হাতে চলে আসতো।
কুহু - ঢপ মেরো না তো।বলো ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে কি আর কুমারশানুর গানে নাচা যায়?তাই পরতে না।সব জানি আমি তোমার ফন্দি।একপাড়ায় বড়ো হয়ে তো চোখের সামনেই দেখলাম কি বাজে ফ্যাশন সেন্স তোমার।আমি না এলে যে তোমার কি হতো????
অর্চি -তা অবিশ্যি ঠিক।।তোমায় ইমপ্রেস করতে প্রথম পাঞ্জাবি পড়ে অষ্টমির অঞ্জলি দিয়েছিলাম ।মাইরি বলছি বন্ধুরা হেব্বি প্যাক দিয়েছিলো সেদিন।
কুহু - সেই।তাও সেই জিন্সের ওপর পড়েছিলে।কি না পাজামার দড়ি ভরার জন্য বাড়িতে নাকি সেফটিপিন নেই।যত্তসব আজগুবি।আমার বাড়িতে না এসব হতো না।
অর্চি - হ্যাঁ ওটা তো আভিজাত্য নিকেতন।পাড়ার প্যান্ডেলে রবীন্দ্রসংগীত চলে না বলে নাকি
অভিযোগ এনেছিলো তোমার বাবা।একটা জিনিষ বটে!আর শোনো সব বাঙালি বাড়িতেই দরকারের সময় সেফটিপিন পাওয়া যায়না।এটা হলো রবীন্দ্রনাথ সত্যজিতের পরেই বাঙালি হওয়ার প্রমাণ।
কুহু - সেই তো।আর শ্বশুরকে “জিনিষ” বলাটা কি হওয়ার প্রমাণ শুনি?
জানো আমি,বাবা,মা, ভোর চারটে উঠে মহালয়া শুনতাম রেডিওতে।বাবাকে জড়িয়ে ধরে
ঘুমিয়ে পড়লেও শুরুটা মিস হতো না।তারপর দূরদর্শনের মহিষাসুর মর্দিনি।তারপর প্রত্যেক
বছর রবীন্দ্র মিস্টান্ন ভান্ডারের জিলিপি মহালয়ার সকালে আর পুজোসংখ্যার গন্ধ আর পুজো শপিং মানেই তখন শ্রীরাম আর্কেড বা বর্ধন মার্কেট।
নতুন জামার গন্ধ বারবার নিতাম আলমারি খুলে।
অর্চি -সেই গোডরেজ আলমারি!জঘন্য ক্লোসেটের চক্করে নেপথলিনের গন্ধটাই ভুলে গেলাম।
কুহু - আহ শোনোনা।তারপর থাকতো সপ্তমিতে আলতা পড়া।অষ্টমিতে অঞ্জলি দিয়ে এসে দই চিরে কলা মাখা।কবে কি পড়বো সব রেডি করে রেখে দিতাম।তাই সেফটিপিনটাও পেয়ে যেতাম
বুঝলে।বাবার ফটোগ্রাফি,কখনও গিটারে নতুন গান তোলা পুজোর জন্য।বাড়িটা রজনীগন্ধার তোড়ায় সাজানো হতো।বেলফুলের মালা রাখা থাকতো আমার জন্য সবসময় যদি খোপায় লাগাই।তারপর পরিবারের সবাই মিলে খেতে যাওয়া,নবমীর দুপুরে বাঙালি জলসা।ন’মাসি কি সুন্দর এমব্রয়ডারি করা চালচিত্র বানিয়েছিলো একবার জানো।বিসর্জনে মায়ের ঠাকুরবরণ।
জানো অর্চি বাবা দেখিয়েছিলো দুগ্গা ঠাকুর কেমন কাঁদে দশমীর দিন।আমি দেখতে পেতাম।
অর্চি -ফুল মেলোড্রামা।
কুহু - যাওতো আমি আর কিছু বলবোনা।
অর্চি - কুহু আজ নাহয় “তুইটা” তুমি হয়েছে।কিন্তু আমি যে এই তুইটাকে বড়ো হতে দেখেছি
একডালিয়ার ভীড়ে,ম্যাডক্সের ঢাকের তালে,দেশপ্রিয় পার্কের দেদার ফুচ্কা খাওয়ায়,শ্রীভুমির বিপুল জনস্রোতে ভেঁপু বাজানোয়,পাড়ার প্যান্ডেলের ধুনুচি নাচে আবার বিসর্জনের উদ্দামতায়।তুমি আজ এগুলো চাপা দিয়ে দিচ্ছো কেনো আমি যে জানি।
কুহু - যেমন তুমি চাপা দিয়ে দিয়েছো প্যান্ডেলের কাজ সেরেও চারশ বছর পুরণো বাড়ির ঠাকুরের সামনে দিনে দুবার হলেও গিয়ে পরিবারের সবার সাথে আড্ডা মারা।সবার সাথে কথা বলা।বাড়ির জমজমাট পুজোয় অংশগ্রহণ করা।মাসি-জেঠিমণির আদরের খোকা হয়ে থাকা।চাপা দিয়ে দিয়েছো তো?ফিরে যেতে পারবেনা বলেই তো?আমিও তাই।কিছু জিনিষ চাপা থাকাই ভালো।
অর্চি - ছাড়ো এসব।জানো আমার দুর্গা পুজোয় একটা জবরদস্ত কষ্ট ছিলো।তোমায় বলিনি।শুনবে?
কুহু - কষ্ট আর কলকাতা বিপরীতমুখী।
অর্চি -দুর বাবা শোনো না।মাঠে প্যান্ডেল বাধার চক্করে যে একমাস ফুটবল খেলা যেতো না,এর থেকে বেশী কষ্ট আরকিছুতে ছিলো নাগো।
কুহু - আ্যা!এ কেমন কথা।
অর্চি - তুমি বুঝবে না।ধরো তোমার থেকে কেউ তোমার কবিতা লেখার ডায়েরিটা সরিয়ে নিতো কেমন লাগবে তোমার?তবে পড়াশুনা করতে হতো না পুজোর পাঁচদিন তাই পুশিয়ে যেতো ব্যাপারটা।
কুহু - আরও অনেককিছু করেই পুশিয়ে যেতো।মেয়েদেখে,সিদ্ধি খেয়ে।
অর্চি - আমি মেয়ে দেখতাম?ছিছিছি শোনাও পাপ।
কুহু - ন্যাকা!কলকাতার বাঙালি,পুজোপ্রেম করবে না তা আবার হয় নাকি?ওতে আমার রাগ নেই।
অর্চি - ইয়ে,যা সব মেয়ে ছিলো না কলকাতায় সেসব তো আর এখানে নেই।এখানে সবই কেমন কৃত্রিম।তুমি বা কম কি ছিলে?কতো হৃদয় ভেঙেছো তুমি জানো?
কুহু - মানেটা কি?সেইরকম বাঙালি মেয়ে পেলে তুমি এই বুড়ো বয়সে প্রেম করতে?
অর্চি -নানা মানে তা বলিনি।কিন্তু ওমন পুজোপ্রেম গন্ধ শুধু ওই শহরটাতেই আছে,এখানে আমি পাইনা।মনে আছে তোমার কুহু পঞ্চমীর বিকেলে যেবার প্রথম তোমার বাবাকে বলেছিলাম আপনার মেয়ের সাথে পুজোয় বেরোবো,সেদিন তোমার বাবা জিজ্ঞেস করেছিলো তুমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়তে না?এখন মাল্টিনেশনল কোম্পানিতে আছো ?তোমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় তো?সেদিন মনে হয়েছিলো বলি আমি কাদায় ফুটবল খেলি।আমি ক্লাসিকলের তালিম নিয়েও পাড়ার ঠাকুরের সামনে বসে চেচিয়ে হিন্দি-বাংলা গান গাই।আমি নন্টেফন্টে থেকে সুনীল-শক্তি পড়ে বড়ো হয়েছি।আমি কলেজে আন্দোলন করি আর আমি দুগ্গাপুজোয় দেদার মেয়ে দেখি।
কুহু - বলতে পারতে।গেছিলে তো সেদিনও খেলার জার্সি পড়ে।আমার তো এমন রকবাজ
ছেলেটাকেই পছন্দ।কি আর হতো?পাঁচটা মিষ্টি হয়তো দিতো না।একটু নাটক হতো।তাতে আমায় তো আর হারাতে না।বলতেই পারতে।প্রিন্সেপঘাটের অস্তমিত সূর্যটা জানে আমি এই বাউন্ডুলে বাঙালিটাকেই ভালোবেসেছি।
অর্চি - তাহলে আগের মতন সাজো না কেনো তুমি কুহু?কাজল,একটা কালো টিপ ,সুতির শাড়ি,
এলোকেশি কুহু।নাহলে যা হোক করে একটা খোঁপায় ফুল আর দাঁত কেলিয়ে হাসা প্রাণখোলা আমার কুহু।কলেজের দ্বিতীয় বছর একটা লাল সুতির শাড়িতে এসে আমায় বলেছিলে,”যেখান থেকে হয় একটা সাদা গোলাপ এনে দে।খোপায় লাগাবো”।
কুহু - তোমার এখনও মনে আছে সেসব!তুমি ঠিক এনে দিয়েছিলে বেহালার ফুলের মার্কেট থেকে।
অর্চি - একদম কলকাতার দুগ্গা ঠাকুর ছিলে তুমি।সেই ব্যাপারটা ছিলো যার মধ্যে।আজ এতো ভীড়ে তোমায় হারিয়ে ফেলি মনে হয়।
কুহু - আসলে কি জানো ভীড় ওখানে ছিলো ।বন্ধুদের ভীড়।চেনা অলিগলির ভীড়।পাড়ার ভীড়।শাসনের ভীড়ে হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতা।এখানে সব ভালোতে যেনো সব ফাঁকা।
অর্চি - কে বলে সোনা এখানে ভীড় নেই!এখানেও পুজোর আড্ডা আছে।এখানে তো আবার তোমার বাড়ির পাশেই অন্নপূর্ণা।যখন পাচ্ছো তার বাগান থেকে গিয়ে আলুটা মুলোটা নিয়ে আসছো।
সবথেকে বড়ো কথা এখানে আমার বাড়ির একচালা ঠাকুর আছে।তোমার থিমপুজো ভালো
লাগে না,না?এখানেই তো মায়ের সনাতনী রুপ আছে।আরে কলকাতা টু কৈলাশরঙ্গ তো এখানেই।চোখ খোলো গিন্নি,নিউজার্সিতেই পানাপুকুর পাওয়া যায় কারণ টাউনের ফান্ডিং নেই।চলো চলো ওঠো,দুগ্গা পুজো আর বাঙালি জানবে অবিচ্ছেদ্য।মন খারাপের কোনও জায়গা নেই বুঝেছো।এখনই নাটকের মহড়া শুরু হবে ওঠো দেখি।
কুহু - আর আছো তুমি।
অর্চি -হ্যাঁ আমি না থাকলে তোমার মতন হ্যাংলাকে কলকাতার বিরিয়ানি আর সন্দেশ কে বানিয়ে
দিতো?আগে পুজো মানেই তোমার জেলুসিল,এখন বিদেশী টামস্ ...।
কুহু - এটা তুমি বলতে পারলে?আমি হ্যাংলা?সে তো তুমি বলবেই।এসো পুজোয় সিঁদুর দেওয়ার
অছিলায় আমায় ছুতে,দেখাবো খন মজা...।।
কুহু আর অর্চির আপ্রাণ চেষ্টায় ওরা ঠিক বেঁধে রাখতে পারে ফেলে আসা কলকাতার শিউলিফোঁটা ভোর নিজেদের অন্তরে।ওই যে কথায় আছে না,দুগ্গাপুজো শুধু একটা উৎসব না,একটা অনুভূতি যার মধ্যে যত্নে রাখা আছে শিকড়ের টান।তাই দেশান্তরিত হয়েও মা দুগ্গা বারবার ফিরে আসেন দম্পতিকথার রাগে অনুরাগে।দুগ্গাদুগ্গা!
0 Comments