
ব্রাহ্মবাড়ির দুর্গাপুজো
ভালোবাসা - মন্দবাসার শহর আমাদের এই কলকাতা।এখানে ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাত্রে।প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা ব্যস্ত মানুষের ভিড় শেষে রাতের নিয়ন আলো গায়ে মেখে হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী থাকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা,যে ইতিহাস হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।আমরা তার খোঁজও রাখি না।
ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগ।চিৎপুর রোডের একটি বাড়ি তখন আপামর বাঙালির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।সাহিত্য - সংস্কৃতি - শিল্পকলা এককথায় ঊনবিংশ শতকের বাংলা ও বাঙালির নবজাগরণের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে।রবীন্দ্রনাথ থেকে অবন ঠাকুর একঝাঁক বিরল প্রতিভার চারণভূমি চিৎপুর রোডের এই বাড়ি।তবে আমাদের আজকের এই গল্পটা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শিল্প - সাহিত্যের চর্চা নিয়ে নয়,ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে এই গল্প।
সালটা ১৭৬৫।নীলমণি ঠাকুর তখন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেরেস্তাদার।অন্যদিকে তার ভাই দর্পনারায়ন ফরাসী সরকারের উচ্চপর্যায়ের চাকুরে।এরাই ছিলেন কলকাতার ঠাকুরবাড়ির আদি পুরুষ।সেরেস্তার কাজে বছরের বিভিন্ন সময় নীলমণি ঠাকুরকে শহরের বাইরে থাকতে হওয়ায় নীলমণি তার সমস্ত সম্পত্তি গচ্ছিত রাখতেন দর্পনারায়নের কাছে।পরবর্তীকালে এই সম্পত্তিই দুই ভাইয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরায় যার ফলে নীলমণি ঠাকুরকে একপ্রকার রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয়।নীলমণি ঠাকুর পাথুরিঘাটার আদি বাড়ি পরিত্যাগ করেন।এই সময় জনার্দন শেঠ নীলমণি ঠাকুরের আরাধ্য দেবতা লক্ষ্মী জনার্দনের নামে সিংহীবাগানে একটুকরো জমি দান করেন নীলমণি কে।এই বাড়ি থেকেই শুরু হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের জয়যাত্রা।তবে ঠাকুরবাড়ির পুজোর সঙ্গে যেমন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে নানান মিথ তেমনই জড়িয়ে আছে চাটুকারিতার করুন ইতিহাস।
দ্বারকানাথ ঠাকুর তখন বাংলার ব্যবসা - বাণিজ্যের অন্যতম মুখ।তার ব্যবসার বিস্তৃতি ছড়িয়েছে পাবনা রাজশাহী পর্যন্ত।বাণিজ্যের দিক থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে প্রতিমুহূর্তে টেক্কা দিতে চাইছেন দ্বারকানাথ।অন্যদিকে পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর এবং মীরকাশিমের বিশ্বাসঘাতকতায় শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে নবাব সিরাজের।ইংরেজদের বিজয় উৎসব পালনের জন্যই শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব এবং লর্ড ক্লাইভের তত্ত্বাবধানে শুরু হলো দুর্গাপুজো।বস্তুতপক্ষে ক্লাইভ বাংলার মানুষের মন জয় করতে দুর্গাপুজোকে কাজে লাগালেন।ইংরেজ অধীনস্থ দেশীয় জমিদাররা এই দুর্গাপুজোর মাধ্যমেই জনসংযোগ করতেন।দ্বারকানাথ তার ক্ষুরধার ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় রাখেন এক্ষেত্রে।দুর্গাপুজোকে অস্ত্র করেন দ্বারকানাথ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদের কর্মচারীদের টিকি বেঁধে নিয়েছিলেন নিজের কাছে।এই সব কর্মচারীদের মনোরঞ্জনের জন্য এলাহি আয়োজন হতো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোতে।একদিকে যেমন থাকতো খানাপিনার ব্যবস্থা অন্যদিকে তেমনি ঠাকুরবাড়িতে বসতো বাইজি নাচের আসর।
দ্বারকানাথের স্ত্রী ছিলেন দিগম্বরী দেবী।তিনি মাত্র নয় বছর বয়সে একান্নবর্তী ঠাকুর পরিবারের দায়িত্ব একপ্রকার নিজের কাঁধে তুলে নেন।দিগম্বরী দেবীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে দ্বারকানাথের ব্যবসার পরিধি আরও বাড়তে থাকে ফলে ঠাকুরবাড়ির অনেক সদস্যই মনে করতেন দিগম্বরী সুলক্ষনা,সাক্ষাত লক্ষ্মী এসেছে তাদের বাড়িতে।একইসঙ্গে দিগম্বরী ছিলেন অসামান্য সুন্দরী।ফলে ঠাকুরবাড়ির দুর্গার মুখ তার মুখের আদলেই তৈরি করা হতো।যদিও পরবর্তীকালে দ্বারকানাথের বিলাসিতার কারণে দিগম্বরী দেবীর সঙ্গে তার সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে।ব্যবসার কারণে এবং ইংরেজ কর্মচারীদের অ্যাপ্যায়নের জন্য বেলগাছিয়া অঞ্চলে একটি বাগানবাড়ি তৈরি করেন দ্বারকানাথ।সেখানে চলতো রাতভর পার্টি উঠতো মদের ফোয়ারা।যা স্বাভাবিকভাবেই না পসন্দ ছিল ধর্মপ্রাণ দিগম্বরী দেবীর।দ্বারকানাথের বিলাসিতা এক সময় তার কানে পৌঁছলে তিনি এর প্রতিবাদস্বরূপ দ্বারকানাথকে তাদের আরাধ্য দেবতার পুজো করতেও নিষেধ করেন।এমনকি এও শোনা যায় দ্বারকানাথের সঙ্গে কথা বললেই তিনি সাত - ঘড়া গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করতেন।এমনকি তিনি পণ্ডিতদের থেকে বিধান চেয়েছিলেন যে স্বামী দ্বারকানাথের সঙ্গ পরিত্যাগের জন্য শাস্ত্রমতে তার কি করা উচিত?
তবে এই দ্বারকানাথের হাত ধরেই ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো পরবর্তীকালে ভিন্নমাত্রা লাভ করে।এমনকি দুর্গাপুজোর প্রায় দু - মাস আগে থেকেই ঠাকুরবাড়িতে গরীব - দুঃখীদের ভিড় লেগেই থাকতো,দ্বারকানাথ কিন্তু তাদের কাউকে হতাশ করতেন না।এমনকি পরবর্তীতে দ্বারকানাথের উদ্যোগেই সোনার গয়নাসহ প্রতিমা বিসর্জন করা হতো দশমীর রাতে।যে ঠাকুরবাড়ির বেশ কিছু সদস্য একসময় মূর্তিপূজার বিরোধিতা করতেন প্রত্যক্ষভাবে সেই ঠাকুরবাড়ির বুকেই দুর্গাপুজো অনেকাংশেই আশ্চর্য ঘটনা।এমনকি সেই সময়ে এই দুর্গাপুজো কলকাতার অনেক সমৃদ্ধ পরিবারকেও পিছনে ফেলে দিয়েছিল,যার পুরোধা ছিলেন দ্বারকানাথ।
জোড়াসাঁকোর এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করেই যেমন দ্বারকানাথের ক্ষুরধার ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় মেলে তেমনই পরিচয় মেলে ইংরেজ তোষামোদের।আবার অতিরিক্ত বিলাসিতার জন্য যে দ্বারকানাথের হাত থেকে গৃহদেবতার পুজোর অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন তার স্ত্রী সেই দ্বারকানাথের হাত ধরেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর।অর্থাৎ এককথায় বলা চলে দ্বারকানাথ চরিত্রটি ছিল নানা রঙে রঙিন।ইংরেজ তোষামোদ থেকে ব্যবসা - বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হেলায় টেক্কা দিয়ে দ্বারকানাথ প্রমাণ করেছিলেন বাঙালি জাতি এবং বাংলার মানুষ শুধুমাত্র শিল্প - সাহিত্য বা সঙ্গীত চর্চা অর্থ্যাৎ ' থিওরিটিক্যাল সায়েন্স ' - এর মধ্যে আবদ্ধ নয়,প্রয়োজনে সে পাড়ি জমাতে পারে সপ্তসমুদ্র।
*তথ্যসূত্র - ' ঠাকুরবাড়ির জানা - অজানা ' - সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রচ্ছদ ছবি-Pinterest
0 Comments