শৈবাল মুখোপাধ্যায়ের গল্প



চন্ডীদাসের ঘর সংসার

ক’দিন ধরে সূর্যের তেজটা লকলকে জিভ বের করে জমির সমস্ত জলটুকু শুষে নিতে চাইছে। এই কিছুদিন আগেও জমিগুলো জলে ভরা ছিল। টানা তিন চারদিনের বৃষ্টিতে মনটা আনন্দে মেতে ছিল চন্ডীদাসের। মনে মনে ভেবেছিল মাঝে মধ্যে এই রকম বৃষ্টি হলে আর আল কেটে কিংবা ক্যানেলের জল তুলে জমিতে দিতে লাগবে না। কিন্তু তার মনের আশা পূরণ হল কই?

সকাল সকাল মাঠে চলে আসে চন্ডীদাস। রাস্তা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’চোখ দিয়ে দেখতে থাকে জমিটাকে। দেখে জমিতে জল নেই। দু’দিন আগেও মাটি ভিজে একটা থকথকে প্রলেপ পড়ে ছিল। আজ  এসে চক্ষু চড়কগাছ। সূর্যের তাপে মাটি ফেটেছে। তার মানে আবার জল দিতে হবে।

মাত্র আধঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেই গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে।
চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করছে। সকালের প্রথম রোদের যদি এই তেজ হয় বেলাতে যে কী হবে সেটা বুঝতে পারে চন্ডীদাস। সে একটু তফাতে এসে কদমগাছের ছায়াতে বসল। গামছা দিয়ে মুখের হাতের ঘাম মুছল। এই কদমগাছটা ওঁর কিশোরকালের সাথী।
জমির কোণ ঘেষে উঠেছিল। চন্ডীদাসের বাবা চেয়েছিল গাছটা কেটে দিতে। কিন্তু বারণ করেছিল চন্ডীদাস। সে জানে গাছটা বড় হবে। কিছুটা জমি চলে যাবে গুড়ি বাবদ। তবু সে কাটে নি।

ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্ডীদাস। একটা আপশোশ থেকেই গেল। ছেলেগুলো কথা শুনল না। তারা বলতে পারত- বাপ বেটাতে আদা-জল খেয়ে খেতের কাজ করব। দেখি ভাল ফলন না হয়ে যায় কোথায়! কিন্তু এসব কথা ওদের মুখে এল কই?

চন্ডীদাসের তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় সংসার। তবু চাষ আবাদ করেই সংসার টেনে নিয়ে এসেছে। মাঝে মধ্যে যে অভাবের মধ্যে পড়তে হয় নি তা নয় তবু সেটা কাটিয়ে উঠেছে।

বড় ছেলে স্বপন বিস্কুট কারখানায় কাজ করে। মেজো তপন যায় বর্ধমানে।কোন এক অফিসের সিকিউরিটি গার্ড। আর ছোট ছেলে রতন এখনও পড়াশোনা করছে।
অবিবাহিত মেয়ে। ঘরে চিররুগি চন্ডীদাসের বউ যোগমায়া। ওরা যার যার তার তার মতো চলছে। কেউ কী চন্ডীদাসের কথা ভাবে?

মাত্র তিরিশ বিঘে জমি। সে একা হাতেই সামাল দেয়। এখন বয়সের ভারে এর বেশি আর করে উঠতে পারে না। তাইবা কেন- এই বিঘে তিরিশ জমির চাষ দেওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। এই বয়সে এখনও পরিশ্রম করে নিজের হাতে ফসল বুনছে। আগে যখন শরীরে জোর ছিল তখন একাই দিনরাত পরিশ্রম করে ষাট সত্তর বিঘে জমি চাষ করত। অবশ্য বাকিটা ছিল অন্যের জমি। ভাগে চাষ করত। দিন দিন শরীরের জোর কমতেই জমি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

আবার একটা শ্বাস ছাড়ল চন্ডীদাস। কদমের ছায়াতে বসে শরীরটা একটু জুড়িয়ে নিয়ে হাতে কোদাল নিয়ে মাঠে নামল। যে জমিটা একটু উঁচু তার কাছে এসে দেখে জমিতে জল জমে আছে। সে একহাত মতো আল  কেটে দিল। বাধন ছাড়া পেতেই জল কল কল করে নিচু জমিতে পড়তে লাগল।

ফিরে এসে কদমছায়ায় বসল চন্ডীদাস। লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বিড়ি বার করল।
হাওয়া থেকে আগুন বাঁচাতে দুটো পা মুড়ে বসে মাথাটা গুজে দেশলাই জ্বালাল।
বিড়ি ধরিয়ে একটা মস্ত টান দিয়ে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ল। তার পর চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকল গাছের নীচে। কিন্তু চুপ করে বসে থাকলেও মাথাতে নানা কথা ভিড় করে।

ঘরে ষোল বছরের সোমত্ত মেয়ে। পার্বতী। ওঁর বিয়ের জন্য যোগমায়া মাঝে মধ্যেই বলে- ‘তুমি কী চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? মেয়েটার কিছু একটা ব্যবস্থা কর।’

‘তুমি তো সবই জান যোগমায়া। মন্ডলদের মেজো ছেলে। দিবাকর। ও তো বিয়ের জন্য রাজি। কিন্তু ওর বাবা অধীর রাজি হচ্ছে না। যৌতুক হিসেবে ক্যানেল ধারের জমিটা চাইছে। টানা আট বিঘে জমি। ওটা দিয়ে দিলে সারা বছর খাবে কী?’

‘তাই বললে হয়? হাজার হোক মেয়ে। পরের ঘরের ধন। ওকে তো আর বেঁধে রাখতে পারবে না।’

‘সেই বলে ওই জমিটাই!’

'দেখছ তো ছেলেপিলেদের চাষবাসে মন নাই। ওরা চাকরি করবে।’

‘পারবে না। তুমি দেখে নিও যোগমায়া, ওরা পারবে না। জাত ব্যবসা বলে একটা কথা আছে। চাষার ছেলে চাষ করবে নাতো চাকরি করবে। আর ওদের যা লেখাপড়া এতে ভাল কাজ পাবে না। মন দিয়ে চাষ করলে ওই জমিতে সোনা ফলানো যায়।’

‘ওরা এখনকার ছেলে। ওরা এসবের মর্ম বুঝবে না।’ যোগমায়া হাঁপাতে হাঁপাতে সংসারের কাজ করে আর চন্ডীদাস শোনে। অনেক ভেবে চিন্তে চন্ডীদাস বলল- ‘ঠিক আছে। ছেলেদের সঙ্গে একবার কথা বলি। দেখি ওরা কী বলে।’

চন্ডীদাস বিড়ি ফেলে মাঠের দিকে চোখ রাখে। সারা মাঠ জুড়ে ধানগাছ। কচি সবুজ পাতায় ভরা। হাওয়ায় মাথাগুলো দুলছে। এখনও শীষ বের হয়নি। এই জমিগুলো চন্ডীদাসের প্রাণ। জমি দেখতে দেখতে কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল।গায়ে তাপ
লাগতেই চন্ডীদাস ধড়ফড় করে উঠে বসল। দেখল কদমগাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য এসে ওঁর গায়ে পড়েছে। দূরে তাকিয়ে দেখল অন্য চাষীরা গাছের ডালে ঝোলানো পুটুলি থেকে খাবার বার করে খাচ্ছে। চন্ডীদাস উঠে দাঁড়াল। গামছা মাথায় বেঁধে নেমে গেল জমিতে। কাটা আলটাকে জুড়ে বাড়ির পথ ধরল।

                          (২)

গরুগুলো বাড়ি ফিরেছে। একটাও গোয়ালে ঢোকে নি। দুটো গরু গাদা থেকে টেনে বিচুলি খাচ্ছে। তাই দেখে যোগমায়া অসমর্থ শরীরটাকে নিয়ে হ্যাট হ্যাট শব্দ করে। চন্ডীদাস দেখতে পেয়ে সামনের পাচন দিয়ে সপাং সপাং করে ঘা কয়েক বসিয়ে দিল। মুরগিগুলো এদিক ওদিক ঘুর ঘুর করছিল। এবার ওদের তাড়া দিল।
হাসগুলো পুকুর থেকে উঠে এসে ওদের ঘরে ঢুকে গেল। একটা গামছা নিয়ে চন্ডীদাস গেল কলতলাতে। সারাদিনের রৌদ্রদগ্ধ শরীরের ঘাম, কাদা মাটি জল দিয়ে ধুয়ে ভিজে গা মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল।

আলো জ্বালায় যোগমায়া। রতন বিকেলের খেলা শেষ করে ঘরে ঢুকল। ওদিকে চা বসায় যোগমায়া। তিন কাপ চা করে। ছেলেটা মুড়ির মধ্যে চা মেখে খেয়ে নেয়। তার পর র‌্যাক থেকে বই নামিয়ে পড়তে বসে। রতনকে পড়তে দেখে গা রি রি করে ওঠে চন্ডীদাসের। খেঁকিয়ে বলে- ‘পড় বেটা পড়। পড়ে পড়ে মানুষ হ।শালা চাষার বেটা চাষা, চাষ না করে চাকরি করবে। চাকরিতে কী এমন মধু আছে শুনি? কত এমে বিয়ে পাশ করে বসে মাথা কুটছে আর এরা- একটুখানি লেখা পড়া শিখে কারখানায় কাজ করতে গেল। তুমি দেখে নিও যোগমায়া- শরীরটা ওরা নিংড়ে নেবে। তখন এই মুখ্যু বাপটার কথা মনে পড়বে।’

যোগমায়া আর কী বলবে। সে তার মতো রাতের রান্না করতে নিল। গরমে হাঁপানির টানটা একটু কম। তবু একটা কষ্ট। তারমধ্যে যতটুকু পারে করে।
মেয়েটা আজ ক’দিন বাড়ি নেই। মামা বাড়ি গিয়েছে। মেয়েটা থাকলে যোগমায়াকে রান্না করতে হয় না। কিন্তু ক’দিনই বা এই ঘরে রান্না করবে। একদিন তো বিয়ে দিতে হবে। শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে।

রাতের খাওয়া শেষ হয়। স্বপন সিগারেট ধরিয়ে পেচ্ছাব করতে গেল। তপন বারান্দায় বসে খইনি ডলছে আর মোবাইলে গান শুনছে। যোগমায়া বিছানা পাতছে।
পাশের ঘরে চন্ডীদাস আবছা আঁধারে বসে আছে। আজ একটা আলোচনা করবে। ওরা এলেই শুরু করবে চন্ডীদাস। আলোচনা বলতে মেয়ে পার্বতীর বিয়ের জন্য মন্ডলদের দাবি মতো ক্যানেল পাড়ের আট বিঘে জমি যৌতুক হিসেবে দেবে কিনা। বাকি জমি তিন ছেলের নামে।

চন্ডীদাসের কথা শুনে ছেলেরা প্রথমে কেউ মুখ খুলতে চাইল না। রতনকে বাদ দিয়ে বাকি দু’জন দু’জনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। যোগমায়া ঘরের ভিতরে নেই। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

‘কী হল, চুপ করে আছিস কেন? কিছু বল।’

‘কী বলব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। পার্বতীর বিয়ে দিতে হবে এটা তো ঠিক।
আবার বলছ মন্ডলখুড়ো ওই জমিটা চাইছে।’

চন্ডীদাস বিরক্তি প্রকাশ করে বলল- ‘আরে বাবা, এতো সোজা ব্যাপার। ওই জমি পেলে ছেলের বিয়ে দেবে পার্বতীর সঙ্গে। নইলে নয়। এখন আমার বক্তব্য, ওই জমি দিয়ে বিয়ে দেব কিনা। তোরা তো বলছিস চাষ আবাদ করবি না। চাকরি করবি।
আমি যতদিন বেঁচে আছি চাষ করে যাব। মরে গেলে কী করবি সেটা তোরা বুঝবি।’

তপন বলল- ‘তুমি কী ঠিক করেছ?’

‘তোরা যদি চাষ না করিস, তাহলে’- আর বলতে পারে না চন্ডীদাস। জিভে কথা আটকে যায়। চোখদুটো ছল ছল করে ওঠে। মনে মনে ভাবে, তাঁর এত সাধের জমিটা চলে যাবে।

স্বপন বলল- ‘ঠিক আছে। আমাদের দু’দিন সময় দাও। ভেবে বলছি।’

                    (৩)

অবশেষে মন্ডলদের মেজো ছেলে দিবাকরের সঙ্গে পার্বতীর বিয়ে হয়ে গেল।
আজ ক’দিন হল চন্ডীদাস কাজে যাচ্ছে না। দুটো বলদকেও সেরকম যত্ন আত্তি করছে না। গোয়াল ঘরটার চালা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এবার বর্ষায় খুব কষ্ট পাবে গরুগুলো। কীভাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না চন্ডীদাস। সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে। সেই সাত সকালে বের হয়ে যায়। দুপুরে খেতে আসে। সারাদিনমান এদিক ওদিক ঘোরে। কখনও জমিতে লাউ কুমড়ো দেখতে চলে যায়।

বেলা বাড়ে। মাথার উপর সূর্য আলোকছটা ছেটায়। চন্ডীদাস ক্যানেল পাড়ে যায় না। সে উত্তরদিকে হেঁটে চলে। দূর থেকে কদমগাছটা দেখা যায়। দেখতে পায় খেত মজুরের দল গামছা পেতে বেঁধে আনা মুড়ি গুড় কাঁচালঙ্কা পেয়াজ নিয়ে খেতে বসেছে। কেউ কেউ চটের থলে থেকে বের করছে টিফিন বাক্স। ভাত তরকারি মেখে দুপুরের খাবার খাচ্ছে।

চন্ডীদাস একটু তফাতে বসল। মনে পড়ে যোগমায়াও দুপুরে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতো। সঙ্গে থাকত স্বপন। যোগমায়া গাছতলাতে বসে যত্ন করে ভাত খাওয়াত চন্ডীদাসকে। তখন ওই ফাকে পুচকে স্বপন দৌড়ে নেমে যেত জমিতে। লাঙল ধরে মুখ দিয়ে বাপের মতো কত রকম শব্দ করত। বলদ দুটো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত।
দুষ্টুমি করত না। ছেলের ওই কান্ড দেখে চন্ডীদাস আর যোগমায়া হেসে গড়াগড়ি যেত। তার পর চন্ডীদাস পেট ভরে জল খেয়ে আবার যখন মাঠে নামতো, বলত,নে, নে,শিখে নে। বাপকা বেটা। স্বপন সেসব কিছুই শিখল না। সে পড়তে লাগল। মাধ্যমিক ফেল করে চলে গেল বিস্কুট কারখানায় কাজ করতে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্ডীদাস। তার পর উঠে দাঁড়ায়। খিদের টানে চড়া রোদ উপেক্ষা করে বাড়ির পথ ধরে।

যোগমায়া বোঝে। কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। পার্বতীর বিয়ে হয়ে যাওয়াতে লোকটার মন যত না খারাপ তার থেকে বেশি মন খারাপ ক্যানেল পাড়ের জমিটা চলে যাওয়াতে। লোকে শ্যালো বসিয়ে জল তোলে। সেখানে চন্ডীদাস ক্যানেল থেকে জল পায়। আল  কেটে দিলে পর পর জমিতে চলে যায়। আজ বাদে কাল যখন সে চাষ করবে, বেয়াই-এর দয়ার উপর তাকে থাকতে হবে।

এর মধ্যে একদিন চন্ডীদাস দেখল গোয়াল ঘরের পাশে যে ভাঙা ঘরটা পড়ে ছিল, স্বপন সেটাকে ঠিক করতে নিয়েছে। কী হল, হটাৎ ওটা সারাই করতে কেন নিল?
‘কীরে ওটা সারাই করছিস কেন?’ স্বপন চুপ করে থাকল। এমন কী মাকেও বলল না।
এর দিন কতক বাদে স্বপন বিয়ে করে বউ নিয়ে ঘরে ঢুকল।

যোগমায়ার সেকি আনন্দ। নতুন বউ। সবসময় তাঁর কাছে ঘুর ঘুর করছে।
যোগমায়া ওঁর কাছে নানা গল্প শোনে। এমনিতে সারাদিন সে একাই থাকে। এখন তবু একজন সঙ্গী হয়েছে।

বউ পেয়ে স্বপনের মন ভরলেও চন্ডীদাসের মন ভরল না। খান কতক জামা কাপড় ছাড়া আর বিশেষ কিছুই দেয় নি। অথচ মন্ডল ওঁর কাছ থেকে কত সাধের জমিটা যৌতুক হিসেবে নিয়ে নিল।

চন্ডীদাস এখন অনেকটা আত্মভোলা হয়ে গিয়েছে। সারা বছরের খোরাকের জন্য চাষ করে। বাকি সময় লাউ কুমড়ো ডাটা আলু এসব বোনে। ঘরে আসে। খায় দায় আবার চলে যায়। এরইমধ্যে কয়েকদিনের জ্বরে ভোগে চন্ডীদাস। জীবনে বোধহয় এই প্রথম
তার জ্বর এল। যোগমায়াও এই প্রথম দেখল। বুঝতে পারল এটা রোদে জলে ভিজে হয়নি। প্রতি বছরই এভাবে কাজ করতে হয়। এটা জমি চলে যাবার চিন্তায় চিন্তায় হয়েছে। তবে এখন যোগমায়া কিছুটা রেহাই পেয়েছে। ঘরের সব কাজ করে বড় বউ। শুধু তাই হয় শ্বশুর শাশুড়িকেও সেবা যত্ন করে।

মাত্র মাসখানেক হল স্বপন বিয়ে করেছে। একই সংসারে খায়। মাস গেলে নগদ টাকা ধরিয়ে দেয় বাবাকে। সারা মাসের খরচ খরচা বাবদ। চন্ডীদাসের অত টাকার দরকার হয় না। সে ব্যাঙ্কে রেখে দেয়। বেশ কিছুদিন হল মাস শেষ হয়েছে। স্বপন টাকা দিল না। যদিও চন্ডীদাসের প্রয়োজন নেই। তবু কেমন একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আরও ক’দিন অপেক্ষা করে চন্ডীদাস স্বপনকে বলল- ‘এখনও মাসের টাকা পাস নি?’

স্বপন নিরুত্তর। কী উত্তর দেবে সে। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে স্বপনের বউ। স্বপন বউএর দিকে তাকাতেই সে সরে গেল।

চন্ডীদাস ভাবল এখন থেকে ওই হয়তো সংসার চালাবে। সেই ভেবে বলল- ‘বেশ তো, তুই-ই রেখে দে। চাল মুড়ি কিনতে টাকা লাগবে না। সবজি কিনতেও লাগবে না।
খাল বিল থেকে মাছটা গুগলিটাও জোগার হয়ে যায়। একটু বুঝে শুনে খরচ করবি।
বুঝলি।’ এই বলে চন্ডীদাস পিছন ফিরতেই স্বপন ডাকল, ‘বাবা’—

ঘুরে দাঁড়াল চন্ডীদাস। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বল’-

স্বপন খুব আস্তে আস্তে বলল- ‘বাবা, কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল। মালিক বলছে লস হচ্ছে। আমরা ছাড়ছি না। ইউনিয়ন লড়াই করবে কারখানা খোলার জন্য।’

চন্ডীদাস একটা কষ্টের হাসি হাসল। শেষে বলল- ‘শোন, তোকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি তো আছি। ঘরে বসে না থেকে আমার সঙ্গে মাঠে যাস। লাঙল টানা হয়ে গিয়েছে। আরও বার দুই দিয়ে দিলে জমি তৈরি হয়ে যাবে। তার পর আলু পুতব।’

এখন বাপ বেটা জমিতে। চন্ডীদাস ছেলেকে লাঙল ধরিয়ে দিয়েছে। স্বপন হাতে পাচন নিয়ে লাঙল ধরে মুখে আওয়াজ দিতে দিতে জমি চষছে। এবার বোধহয় ক্যানেল পাড়ের জমি চলে যাওয়ার শোক সামলে নেবে চন্ডীদাস। সে আলের ধারে বসে বিড়িতে সুখ টান দিচ্ছে। ‘বুঝলি স্বপন, লেখাপড়াকে আমি অছদ্দা করছি না। কিন্তু সরকারি চাকরি পেতে যে যোগ্যতা লাগে তা তোদের কারও নেই। 
আর একটা কথা কী জানিস বাপ, সবার দ্বারা সব কাজ হয় না। আমরা হলাম চাষা। এই জমি হল গে আমাদের পেরান। এসব ফেলে চাকরি? আমার তো মন সায় দেয় না।’

ঘন্টাখানেক লাঙল টেনে স্বপন হাঁপিয়ে যায়। সে লাঙল রেখে বসে পড়ে।গামছা দিয়ে ঘাম মোছে।

‘কীরে,এর মধ্যে হাপিয়ে গেলি? তোর মতন বয়সে কতক্ষণ লাঙল টানতাম জানিস?’

স্বপন নিজেকে আড়াল করার জন্য বল- ‘আজ কত দিন পরে লাঙল টানলাম বল তো।’

চন্ডীদাস ছেলের কথা শুনে একটু ভেবে বলল- ‘তা অবিশ্যি ঠিক। কদিন একটু কষ্ট হবে বইকি। গা হাত পা টাটাবে। শরীরে শক্তি থাকবে না। তখন আবার পড়ে পড়ে ঘুমুলে চলবে না। ঝেড়ে উঠে পড়তে হবে। দেখবি দু’দিনেই শরীরের ব্যথা মরে যাবে। নিজের জমি নিজের লাঙল। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। তাহলে আজকে ছেড়ে দে। কালকে করবি। নে, লাঙল গরু নিয়ে ঘর চল।’

কিন্তু কদিন ধরে চন্ডীদাস লক্ষ্য করছে স্বপনের আর সেই শক্তি নেই।
একটা বছর তিরিশের জোয়ান মরদ। শরীরের হাড় থাকবে শক্ত মজবুত। তা না, এ ছেলের যে দেখছি ঘন্টাখানেক কাজ করেই এলিয়ে যাচ্ছে। বহুদিন আগে যোগমায়াকে একটা কথা বলেছিল চন্ডীদাস। আজ  সেই কথাটাই আবার মনে পড়ল। কারখানায় বসে বসে দেখভালের কাজ করে করে শরীরের সব রসটুকু মরে গিয়েছে। এখন বয়স থাকলেও শরীরের শক্তি বলে কিছু থাকল না।

চন্ডীদাস কপাল চাপড়ে সগোক্তি করে বলল- ‘হায়রে আমার পোড়া কপাল, চাষার ছেলে চাষা, জমিটুকু চাষ আবাদ করতে পারলে দুধে ভাতে থাকতি। তা না করে কি মতলবে শহুরে লোকের মতো চাকরি করবি বলে নেচে উঠে জীবনটা শেষ করে দিলি। তাও যদি ঠিক মতো লেখাপড়া শিখে বড় পাশ দিয়ে সরকারি চাকরি করতি– সে সব কিছুই হল না।’

স্বপন আপশোশ করে কিনা জানে না, চন্ডীদাস এখনও আপশোশ করে বেড়ায়- এরা না পেল সেরকম বিদ্যা, না পেল চাকরি, মাঝখান থেকে হারিয়ে ফেলল জমিতে ফেরার মন আর গতর।

    সাহিত্যিক শৈবাল মুখোপাধ্যায়
         সুকান্ত পল্লি, কালনা গেট, পূর্ব বর্ধমান



















0 Comments