শুক্লা মুখার্জি'র গল্প


রৌদ্র-ছায়া

স্যাঁতসেঁতে মাটির দাওয়ায় বসে দূরের দিকে ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে দেয় পরানের মা। হ্যাঁ, এই নামেই পরিচিত সে তার পৃথিবীর কাছে। পৃথিবী বলতে এই বামনদিঘীর মাঠ, ঘাট, আকাশ, আর এখানের মানুষজন।  এর বাইরে সে তো বেরোয়নি কোনওদিন, তাই এটাই তার পৃথিবী। এর বাইরেও যে আর একটা পৃথিবী আছে তা সম্পূর্ণই অজানা তার কাছে।    
তবে নাম একটা ছিল তার, পূর্ণিমা। মায়ের মুখে শুনেছিল পূর্ণিমার রাতে জন্মেছিল বলে তার বাপ আদর করে নাম রেখেছিল পূর্ণিমা। বাপকে তার মনে পড়ে না। কি করেই বা পড়বে, সে তো তখন বড়জোর বছর দুই। দিবাকর চাষী নিজের ভাগের দু'বিঘা জমিতে সোনার ফসল ফলিয়েছিল সেবার, কার্তিকের শেষ দিকের এক  সন্ধ্যায়, ধান কাটার সময়ও প্রায় হয়েই এসেছে, সামনে নবান্ন... মাঠ থেকে ফেরার পথে এক জাত গোখরোয় কেড়ে নিয়েছিল তাজা ত্রিশের প্রাণ। সেই থেকে ওইটুকু একরত্তি প্রাণকে বুকে করে আর ওই দু'বিঘা সম্বল করেই দিন কাটাচ্ছিল সুবলা, পূর্ণিমার মা।
কিন্তু গাঁ-ঘরে একা এক বিধবা,তায় আবার জোয়ান বয়েস, ছিঁড়ে খাবার লোকের তো অভাব নেই...তাই দত্তদের বড়গিন্নি, যে মায়ের মত স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন,বরাবরের মত তার কাছেই রেখে দিলেন তাদের মা-মেয়েকে।  গোয়ালের পাশে একটা একচালা ঘর, সেখানেই মেয়ে নিয়ে থাকতো সুবলা। ঘর সে যেমনই হোক, একটা নিরাপদ আশ্রয় তো মিলল। ওই দু'বিঘা জমি আর বড়গিন্নির বাড়ির কাজ মিলিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল তাদের মা -মেয়ের। 
পূর্ণিমাও দেখতে দেখতে বছর পনের হল। বয়সের দোষে নাকি বড়মার আদরে,(বেশ বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে মেয়েটার। বড়গিন্নির শরীর -স্বাস্থ্য আজকাল বিশেষ ভালো যায় না। কর্তা চলে যাওয়ার পর আরও ভেঙ্গে পড়েছেন। একদিন সুবলাকে ডেকে বললেন, 
---"হ্যাঁ রে, পূর্ণিমা তো বড় হল, বিয়ে -থা দিতে হবে তো নাকি? "...
---" আজ্ঞে বড়মা, আমি আর কি বলি বলেন? সে আপনেগো যা ভালো মনে হয় তাই করেন "....
তখন বড়মার কথাতেই  দু'গাঁয়ের পরে এই বামনদিঘীতে মিলল বাপ -মা মরা পাত্র সাধন। জোয়ান ছেলে, দিনে মাঠে চাষের কাজ করে আর রাতে মনের সুখে বাঁশি বাজায়। বড়মার কথাতেই একদিন সে এলো গোপালপুরে। পূর্ণিমা জানলার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল সেই পাথর-কাটা চেহারা, কালো রঙে দুটো মায়াবী চোখ। দেখলেই যেন মায়া হয়ে যায়। বড়মার ও খুব পছন্দ। কিছুদিন পরেই অঘ্রাণের এক সন্ধ্যায় চারহাত এক হল আর পূর্ণিমাও দু-চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে সাধনের সাথে চলে এল এই বামনদিঘীতে। 
তারপর দিনগুলো যেন স্বপ্নের মত কাটতে লাগলো। বছর ঘুরতেই পূর্ণিমার কোল আলো করে এলো পরান। সেই থেকেই সে পরানের মা। বেশ কেটে যাচ্ছিল এক একটা বছর। তবে সবসময় তো সমান যায় না। কোনও বছর প্র‍য়োজনের থেকে বেশি ফসল ঘরে এসেছে তো কোনও বছর বন্যা এসে ভাসিয়ে দিয়েছে সবকিছু, কখনও আবার বৃষ্টি হয়নি সময়মতো, ফসল নষ্ট হয়েছে। তবে কোনও পরিস্থিতিতেই তারা স্বামী-স্ত্রী ভেঙ্গে পড়েনি। হাতে হাত দিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে, চাষের কাজে। 

আস্তে আস্তে পরান বড় হলো। ছেলেটারও যেন মাঠ অন্ত প্রাণ। ছোট থেকেই চলে যেত মাঠে, বাবাকে চাষের কাজে সাহায্য করতো। বাপ -মায়ে চাইত ছেলে লেখাপড়া শিখুক, অন্য কাজ করুক...কিন্তু ছেলের যে অন্য মতি। মাঠ তাকে টানে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা... মাঠে সে রোজ একবার যাবেই। সাধনেরও বয়েস হচ্ছে, সে ভাবে, "ভালোই হইছে পরানটার চাষবাসে মন হইছে। আমি আর কদ্দিন? উয়াকেই তো হাল ধইরতে হবে ".....   
তারপর একদিন সেই ঘোর অনর্থটি করে বসল পরান। কাউকে কিছু না বলে শান্তিকে বিয়ে করে ঘরে এনে তুললো। পূর্নিমা কেঁদে ভাসালো,সাধন অনেক করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালো শান্তিকে বরণ করে ঘরে তুলতে। কিন্তু যেদিন থেকে শান্তি বউ হয়ে ঘরে ঢুকলো, সেইদিন থেকে আরেক শান্তি চিরতরে বিদায় নিল তার সাধের সংসার থেকে। নামের সাথে স্বভাবের যে এত অমিল হয়,শান্তিকে না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন।     

পরানের মত শান্ত স্বভাবের ছেলে যে কি করে অমন কালনাগিনীর খপ্পরে পড়ল, সেটাই ভেবে পায় না পূর্ণিমা। ও মেয়ে শুধু সাজগোজ করবে, ভালো-মন্দ খাবে আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, স্বামীরে গালমন্দ করবে। চাষিবাসির ঘরে এমনধারা অনাসৃষ্টি কেউ দেখেছে কখনো?  পাড়া ঘরের মেয়ে-বউরা বলে," কি করবে বলো? সবই কপাল "... তাই হবে হয়তো...

এর কিছুদিন পরে হঠাৎ করেই দিন তিন-চারের জ্বরে ভুগে মারা গেল পরানের বাবা, সাধন। 
এরপর থেকে শান্তি যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলো। পরান ঘরে না থাকলে শ্বাশুড়িকে তুচ্ছ কারণে গালমন্দ করা, খেতে না দেওয়া এসব যেন বাড়তেই লাগলো। সময়ের সাথে সাথে পূর্ণিমার শরীরও ভাঙ্গতে থাকে... 

এরইমধ্যে শান্তির কোলে এসেছে একছেলে, একমেয়ে...।কিন্তু শান্তির মনে সবসময় অশান্তির ছায়া লেগেই রইল। 
--" বলি চোখের মাথা কি খেয়েছো নাকি? এত বেলা হল নিজে দুটি বেড়ে খেতি পারো না?"...
শান্তির গজরানিতে হুঁশ ফেরে পূর্ণিমার। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সে। এই এক রোগ হয়েছে আজকাল, থেকে থেকে কেবল পুরনোদিনের কথাই মনে পড়ে, সেই ছোটবেলা, পুতুলখেলা, গ্রামের বাড়ি,পুকুরঘাট, বটতলা.... এইসব। 
--"সারাদিন কোনও কাজ নেই, কেবল বসে বসে খ্যাটন আর কিছু বললেই ফ্যাঁচর -ফ্যাঁচর....আমার হয়েছে যত জ্বালা ".....শান্তি গজরাতে থাকে। 
--" অমন ক্যানে করিস বউ?  চোখে দেখিনা বলেই তো কিছু করতে পারি না। যখুন গতর ছ্যালো তখুন  করি নাই? "....
---" তবে আর কি , আমার মাথা কিনে নিয়েছো"...
---"কিসের যে এত অশান্তি তোর মনে আইজও আমার মাথায় ঢুকতে লারলো "....
---" তা বুঝবে ক্যানে? করতে তো কিছু হয় না, আমি সারাটোদিন খেটেখুটে গতরের ব্যাথায় মরি.. কেউ দ্যাখে?"...
--"তোর সংসারে তুই তো খাইটবি? "....
---" নিকুচি করেচে অমন সংসারে...কখনও দু'বেলা দুমুঠো জোটে তো কখনও জোটে না, ঘরের চালটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়, একটা ভালো কাপড় নেই, সামনে পুজো আসছে ছেলেদের লতুন জামা দিতে পারে নাই অমন বাপ হইছে "....
শেষের কথাগুলো পরানের কান দিয়ে ঢুকে মাথায় প্রবেশ করে। সেইমাত্রই রোদে পুড়ে মাঠ থেকে ঘর ঢুকেছে সে। 
---" পরান আইলি বাপ? "..পরানের মা ব্যাস্ত হয়ে ওঠে। ঝাপসা চোখ আর যেন জলও তেমন আসে না.....  
---" হঁ মা, এলম "....
---" হঁ, এলেন, এবার দুটো গিলে নিয়ে আমায় উদ্ধার করেন "...শান্তির মুখ যেন কয়লার আগুনের মত জ্বলতেই থাকে। তবে আজ আর তার কোন কথার উত্তর দেয় না পরান। 

রাতেরবেলায় খাওয়ার পর শান্তি দুইছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরে শুয়ে পড়ে। পূর্ণিমা রোজকার মত বাইরের ঘেরা দাওয়াটার একপাশে একটা চৌকিতে শুয়ে পড়ে। অন্যদিকের চৌকিটাতে শুয়ে পরান আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেককিছু ভাবতে থাকে। সত্যিই তো চালটার ফাঁক দিয়ে বেশ আকাশ দেখা যাচ্ছে, সামনে পুজো আসছে ছেলেমেয়ের জন্য জামা কিনতে হবে, শান্তিটাকেও তো কোনদিন একটা ভালো কাপড় কিনে দিতে পারে না...কিন্তু কি ভাবে করবে এসব? এবার ফসলের যা অবস্থা তাতে খরচ উঠবে কিনা সন্দেহ। দু'বেলা দুমুঠো জোটে কিনা তারই ঠিক নেই...কি করবে?সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজেকে নিজেই ধিক্কার দেয় সে...হঠাৎ শরীরটা কেমন করে ওঠে পরানের। মনে মনে বলে, "এ জীবন রাখার চেয়ে না রাখা অনেক ভালো "...

ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে স্ত্রী, ছেলেমেয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে...." না, তাকাবো না..এ মায়ার জাল কাটাতেই হবে "...আস্তে আস্তে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দেয় সে।       
গুটিগুটি পায়ে মায়ের চৌকির পাশে এসে দাঁড়ায় পরান। মায়ের মুখটা হাল্কা চাঁদের আলোয় কেমন মায়াবী লাগছে। কত কথা মনে পড়ে যায় পরানের। সেই মায়ের সাথে মাঠে যাওয়া, ডোবায় গামছা দিয়ে মাছধরা, ধান কাটা, আরও অনেক কথা। দু'চোখ জলে ভরে ওঠে পরানের৷ মনে মনে বলে, " আমায় খেমা করে দিস মা "...না, আর সময় নেই, এখুনি যদি শান্তি উঠে পড়ে তো আর একটা কুরুকখেত্তর বাধাবে।চৌকির পাশের কুলুঙ্গিটাতেই রাখা আছে শিশিটা, জমিতে দেবে বলে গতকালই এনে রেখেছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দেয় কুলুঙ্গির দিকে....এই তো....অন্ধকারে ভালো ঠাহর হয়না, মায়ের চৌকির পায়াতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে শিশিটা হাত থেকে পড়ে যায়... 
---" কে? পরান নাকি?... কি ভাঙ্গলো বাপ?"...চোখদুটো গেলেও কান এখনো ভালোই আছে পরানের মায়ের। 
---"ও কিছু না মা... তুই শুয়ে পড় "....
ততক্ষণে তীব্র, ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ গন্ধ খুব চেনা পরানের মায়ের। 
--" পরান, ও পরান...কোথায় গেলি বাপ? একবার আমার কাছটো আয় না? "...আকুল হয়ে ওঠে মায়ের মন....  
---" হঁ মা, এই তো আমি"...
---"কি কইরতে যাচ্ছিলি বাপ আমার? তুই সাধন চাষির ব্যাটা বটিস, এত সহজে হার মানে নিলি? বুড়া মা টার কথা, ব্যাটা-বেটির কথা একবারও ভাবলিনি বাপ?...
 ---"কি করবো বল?  এবারে মাঠের অবস্থা খুব খারাপ, আর ঘরের অবস্থা তো তুই দেখছিস। আমি আর পারছি না"....মায়ের পায়ের কাছে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে পরান। 
---" চাষবাস তো অমনই বাপ, এবার হয়নি তো কি হবে, পরেরবার হবে। তুই হার মানবি না.... জীবন থেকে পালিয়ে কোথায় যাবি?.... সব ঠিক হয়ে যাবে "...পরানের মাথায় হাত রাখে তার মা। 
---" মা, তোর কোলে মাথা রেখে অনেকদিন শুই না, একটু কোলটা পাত না, শোব"...
পরানের মাথায় হাত বুলাতে থাকে পরানের মা। পাশে শিব মন্দিরের বাঁদিকের শিউলিগাছটা থেকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে...
দুগগা মা আসছেন যে, আর বেশি দেরি নেই..  
মায়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে কখন যে দু'চোখের পাতা জুড়ে যায়, পরান বুঝতেও পারে না...।।

গল্পকার শুক্লা মুখার্জি
সুভাষ পল্লী, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ




















0 Comments