অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ
মুক্তি দাশ
“রবীন্দ্রনাথই দেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা” -এরকম একটি দুঃসাহসিক উক্তি স্বয়ং নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির। বাংলা ১৩৩৬ সনে আশ্বিন মাসে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যখন তপতী নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে, তখন বহু বিদগ্ধ নাট্যপ্রেমী গুণী্জনের মধ্যে শিশিরকুমারও একজন অভিভূত দর্শক। ‘তপতী’ আসলে ‘রাজারানী’ নাটকেরই নবকলেবর। পরপর তিনদিন এই নাটকটি অভিনীত হয় ঠাকুরবাড়ি প্রাঙ্গণে। এবং তিনদিনই শিশিরকুমার দর্শকের আসনে সমাসীন। প্রতিদিনই নাটক শেষে তাঁর আবেগাপ্লুত উত্তেজিত চিৎকার : ‘স্ট্যুপেনডাস! স্ট্যুপেনডাস! স্ট্যুপেনডাস!’
বলাবাহুল্য, এই আবেগমথিত অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করেই। কবি নিজেই এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘রাজার’ ভূমিকায় রূপদান করেছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, কবির বয়েস তখন প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। একজন রীতিমতন বৃদ্ধের পক্ষে যুবক রাজার রোম্যান্টিক চরিত্রে রূপদান কী করে সম্ভবপর হয়েছিল, সে এক সত্যিই রহস্যময় ব্যাপার। সমগ্র দর্শকমন্ডলী অবিশ্বাসভরা দৃষ্টি নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে কখন কবি মঞ্চে আবির্ভূত হবেন।
তরুণ রাজার বেশে অবশেষে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিনের উপস্থিত দর্শকমন্ডলী বাকরুদ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। ইনি প্রকৃতই রবীন্দ্রনাথ তো? কোথায় গেল তাঁর সেই শ্বেতশুভ্রশ্মশ্রু? কে বলবে ইনি সত্তরোত্তীর্ণ বৃদ্ধ? এমন নিখুঁত রূপসজ্জাও কি সম্ভব? আসলে দাড়িতে কালোরং লাগিয়ে, মুখের দু’পাশে গালপাট্টা তুলে দিয়ে কবি সেদিন অন্তত অর্ধেক বয়েস কমিয়ে পরিণত যুবকের বেশে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এরপর যদি জানা যায় যে, এই নিখুঁত রূপসজ্জা কবির নিজেরই রচনা তাহলে কি খুব আশ্চর্য হবার কিছু আছে?
শুধু রূপসজ্জাই নয়,অভিনয়-নৈপুণ্যেও রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট প্রতিভাধর ছিলেন।প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিভিন্ন চরিত্রে দাপটের সংগে অভিনয় করে গেছেন।যেমন ছিল তাঁ অভিনয়োপযোগী সুললিত কন্ঠ, তেমনি ছিল তাঁর মনোমুগ্ধকর অভিনয়-কৌশল। এবং এতদৃশ সহজাত প্রতিভা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেও দস্তুরমতো সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্রহসনে ‘অলীকবাবু’র ভূমিকায় ষোলো বছর বয়সে কবির প্রথম মঞ্চাবতরণ। এই প্রসংগে কবি তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন : “আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই কার্যে আমার স্বাভাবিক নিপুণতা আছে। আমার এই বিশ্বাস অমূলক ছিল না, তাহা প্রমাণ হইয়াছে।”
বিলেত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর কবি ঠাকুরবাড়িতে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই নাট্যাভিনয়ে সশরীরে উপস্থিত থেকে বাল্মিকীরূপী রবীন্দ্রনাথের অভিনয় উপভোগ করেছিলেন।
অতঃপর ছেদহীন গতিতে এগিয়ে চলে কবির অভিনয়-জীবন। বিভিন্ন সময়ে অভিনীত ‘অচলায়তন’-এ (১৩২০) আচার্য, ‘ফাল্গুনী’তে (১৩২১) অন্ধবাউল, ‘বৈরাগ্যসাধন’-এ (১৩২২) কবিশেখর, ‘ডাকঘর’-এ (১৩২৪) ঠাকুরদা, ‘শারদোৎসব’-এ (১৩২৬) সন্ন্যাসী, ‘ঋণশোধ’-এ (১৩২৮) কবিশেখর, ‘বিসর্জন’-এ (১৩৩০) জয়সিংহ, ‘নটীর পূজা’য় (১৩৩৩) উপালি প্রভৃতি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কবি নাট্যজগতের ইতিহাসে তাঁর আসনটি পাকা করে নিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ‘বিসর্জন’ নাটকে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ গোবিম্দমাণিক্যের চরিত্রে রূপদান করেছিলেন। আর জয়সিংহের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তীকালে কবি রঘুপতির মতো বিতর্কিত চরিত্রেও জীবনদান করেছিলেন। এবং ‘নটীর পূজা’য় নটী সেজেছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরীদেবী – যিনি পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনৃত্যে আশ্রমে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
অভিনেতা রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্তি এমনই বিশাল যে, তার সম্যক পরিচয়দান – কবির অন্যান্য শিল্পকর্মের মতোই – ধৃষ্টতা। রবীন্দ্রনাথ যে কত উঁচুদরের অভিনেতা, তার পরিচয় পেতে হলে আমাদের শুধু এটুকুই মনে রাখা প্রয়োজন যে, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মানে ভূষিত স্বয়ং শিশিরকুমার ভাদুড়ি মশায়ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বকবিকে গুরু বলে স্বীকার করে নিতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেননি।
0 Comments