চৈতালি নাগের স্মৃতি আলেখ্য



স্মৃতি কথা

কডাউনের মধ্যে প্রায় তিন মাস কি তার ও বেশকিছু সময় পর সেদিন কার্যোপলক্ষে একটু বাইরে বেড়োতে হয়েছিল। আমাদের ছোট শহর রাস্তাঘাট পরিবেশ প্রায় সবকিছুই  হাতের তালুর মত চেনা,কোন কিছুই সেরকম বিশাল পরিবর্তন হয়নি যা চোখ এড়িয়ে যায়, কিম্বা চোখ জুড়ে থাকে,মোটামুটি সবকিছু আগের মতই আছে। যে কোন জায়গায় যেতে গেলে একের বিকল্প রাস্তা সহজেই পাওয়া যায়।বড়ো রাস্তা, লোকের বাড়ির উঠোন কিংবা মাঠ ঘাটের মধ্যে দিয়ে স্বনির্মিত পথ আপনা থেকেই তৈরি হয়ে গেছে। এরকমই একটা পথ দিয়ে যেতে গিয়ে সেদিন একটি স্থান চোখে পড়লো, জায়গাটা ষষ্ঠী তলা,আমার বাড়ি থেকে বেশি কিছু দূরে নয়।আগে ছোটবেলায় সমবয়সীদের সাথে যখন খেলাধুলা করতাম, কানামাছি, কুমিরডাঙ্গা, বুড়িছোঁয়া আরো কত কি তখন কতদিন হয়েছে খেলতে খেলতে এখানে চলে এসেছি,জায়গাটা একটা গলির মধ্যে। প্রথম দিকে বাড়ি ঘর একদম ছিল না বললেই চলে, দু-একটি পুরনো ভাঙাচোরা বনেদি বাড়ি আর নতুন তৈরি হচ্ছে এরকম ছোট দরমা বা কুঁড়ে জাতীয় ঘর।  বাড়িগুলো প্রায় সবই পুরনো ভগ্নপ্রায় অবস্থা, তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্নর প্রমাণ স্বরূপ অস্থি চর্ম বের করে দাঁড়িয়ে আছে। দু এক ঘর শরিক অবশ্য এখানে কোন রকমে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে বাদবাকী সবাই অন্যত্র বসবাস স্থাপন করেছে। বাড়ি ঘর লোকবসতি কম হবার দরুণ সন্ধ্যের পর সেরকম একটা কেউ এদিকে আসতো না। এছাড়া বিভিন্ন রকম লোকশ্রুতি, কাল্পনিক ভয় ও ছিল এই জায়গাটা কে ঘিরে। বিজলী আলোও ছিল বলে মনে পড়ে না, প্রয়োজন না থাকলে এদিকে খুব একটা কেউ আসতো না ।রাতে তো প্রায় না বললেই চলে। অবশ্য কিছু সাহসী প্রকৃতির মানুষ বা ভিন জায়গার পথিকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা ছিল। এমন কিছু মানুষ  থেকেই থাকেন যারা অজানার মধ্যে,ভয়ের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায় মুক্তির স্বাদ খুঁজে পায়। তবে জায়গাটা খুব সুন্দর, একটা প্রশান্তি আছে। ছোট একটা ষষ্ঠী মন্দির,মাথার উপরে চূড়া, লম্বা একটা মানুষের বুক পর্যন্ত হবে,আর বহু পুরনোকাল থেকে পুজো হয়ে আসা পাথরের ছাঁচের ওপর তৈরী করা ষষ্ঠীর ঠাকুরের মূর্তি লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে আচ্ছাদিত অনেকটা পাড়াগাঁয়ের গ্রাম্য বধূর স্টাইলে শাড়ি পরানো।মন্দিরের চারদিকে সিমেন্টের চাতাল দিয়ে ঘেরা। গ্ৰীষ্মের প্রখর দুপুরে কিম্বা রাতের বেলা,কত লোক যে সেখানে বসে বিশ্রাম নিতেন, পাশে মন্দির লাগোয়া একটি অশ্বথ গাছ,আজন্মকাল থেকেই মন্দিরের পাশে বিরাজমান, গাছটার জন্ম কবে থেকে তা কেউই বলতে পারেন না। মন্দির টার পাশে একটা পুরনো পুকুর আছে,পুকুরের জল যদিও পরিস্কার নয়, স্নান বা আহার কোনটারই উপযুক্ত নয়, কিন্তু তার ঠান্ডা হাওয়ায় এক মনোরম পরিবেশ তৈরি করতো। মন্দিরের পাশ দিয়ে ছিল পাকা নয় ইঁটের খাদরি করা রাস্তা,কিছুটা গিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠেছে, বড়ো রাস্তার ভীড় কোলাহল এড়ানোর জন্য এটি দিয়ে লোক চলাচল করে। বর্ষা কালে অবশ্য তা যাতায়াতের জন্য পরিত্যক্ত হতো।  
জৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে জামাইষষ্ঠী পুজো হবার সময় ঠাকুমার সাথে যখন আসতাম এখানে পুজো দিতে কত লোকের যে সমারোহ হতো এই ছোট মন্দির টাকে ঘিরে। নানা বয়সী মহিলাদের ভিড়ে গমগম করতো জায়গাটা যেন ছোট খাটো একটা মেলা বসে যেত। আম, কাঁঠাল, লিচু, তালের গন্ধে ম ম করতো। সদ্য বিবাহিতা বধূ বা একটু পুরনো,তাদের গয়নার ঝনঝন আওয়াজ, নতুন শাড়ির গন্ধ, শ্যাম্পুর গন্ধ,  অবিবাহিতা তরুণীদের হাসিঠাট্টায় বেশ জমে উঠতো জায়গাটা।ঠাকুমাকে দেখতাম পুজো দেবার পর ষষ্ঠীর সন্তান ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দের হাতে কিছু কিছু প্রসাদ দিতেন...অবশ্য পুজো দিতে আসা সব মহিলারাই তা করতেন এটাই নাকি নিয়ম।বাড়ি এসে আমাদের ও দেওয়া হতো প্রসাদ। সেই প্রসাদ পাবার জন্য কে কতটা উৎসাহি ছিলাম তা বলতে পারি না, কিন্তু সেই প্রসাদের মধ্যে একটা অমোঘ আকর্ষণ ছিল, ছোট ছোট মাটির খুড়িতে যে একটু করে দই দেওয়া হতো,সেই দই ভর্তি মাটির খুড়িটা ।ওটা পাওয়ার জন্য  অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।আমাদের সমবয়সীদের দের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতো,কে কটা খুড়ি জমাতে পারে এই নিয়ে। কি যে আকর্ষণ ছিল ওই ছোট ছোট মাটির খুড়িগুলোর ওপর যেন লাখ টাকা দিয়ে কেনা সম্পত্তি, প্রানে ধরে তার এতটুকু অযত্ন করতে দিতাম না, সেগুলো কে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে তারপর রাখা হতো। তারপর সেগুলো নিয়ে রান্নাবাটি খেলা, সেগুলোর মধ্যে মোম জমিয়ে সলতেকরে প্রদীপ জ্বালানো,পুতুলের সাজপোশাক রাখা, ওইগুলো দিয়ে রান্না বাটি খেলা করা এসব করা হতো। এখনো কত জায়গায় সেই খুড়ি গুলো অনাদরে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখি কিন্তু সেইরকম আর আকর্ষণ হয়না।। বরং ছোটবেলার এইদিন গুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

একবার হয়ে ছিল কি,আমি তখন বেশ ছোট ক্লাস টু কি থ্রি তে পড়ি, বাড়ির কাছেই একটা প্রাইমারি স্কুলে। বাড়ির কাছেই ছিল বলে টিফিন নিয়ে যেতাম না টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুরা একসাথে এসে যে যার বাড়িতে খেয়ে যেতাম। মাঝে মধ্যে যখন কাকা পিসির ছেলে মেয়েরা বাড়িতে আসতো তখন স্কুলে যেতে আমার একেবারেই ইচ্ছে করতো না, মনে হতো সারা দিন তাদের সাথে হুটোপাটি করে খেলে,গল্প করে সময় কাটিয়ে দিতে, ভাবতাম এইতো বেশ আছি কি দরকার স্কুল নামক বিভীষিকার মাঝে গিয়ে,পৃথিবীর যত রাজ্যের পড়াশোনা ভার কি সব ছাত্রদেরই!  করোনা বাপু যারা সারাদিন এসব করতে ভালোবাসো। শুধু শুধু আমাদের কেন এরমধ্যে টানা, সেই দিন থেকেই এই বিভীষিকাময় দিন গুলির অবসানের  জন্য দিন গুনতাম, কিন্তু আজ বুঝেছি সেই দিন গুলোই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল।   
এরকমই একদিন ঠিক হল যে ষষ্ঠী তলার ওখানে একটু ভেতর দিকে একটা বাড়িতে খুব ভালো একটা কুল  গাছ আছে। কুল যেমন মিষ্টি তেমনি নিঁচুতে সহজেই পারা যায়, আমাদের দলের যে পান্ডা ছিল  সেই দিয়েছিল ওই কুল গাছের সন্ধান, অতএব তাকে অনুসরণ করেই আমরা চার পাঁচ জন বন্ধু চললাম সেই কুলের সন্ধানে । একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ির বাগানের শেষ প্রান্তে ছিল কুল গাছটি সাথে কয়েক টা আম , সেগুন, একটা নিম ও কয়েকটা জামরুল গাছ। আমরা তখন ছোট ছিলাম তাই বাড়ির মধ্যে ঢুকেই কুল পারতে হয়েছিল না হলে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যে কেউ সহজেই নিতে পারে। সে বয়সে কুল পারার ব্যপারেও খুব যে পটু ছিলাম তা না ,তাই, ঠিক হল মাটি থেকেই ছোট ছোট পাটকেল জাতীয় ইঁট ছুড়েই কুল পারা হবে, সেই মতো ইঁট ছোড়াছুড়ি চলতে থাকলো , তাতে করে ,কে কটা কুল পেলাম তা বলতে পারি না কিন্তু কার একটা ছোঁড়া ইঁট একেবারে সটান এসে পড়লো আমার কপালে, অল্পের জন্য চোখটা রক্ষা পেল। কুল পারার আনন্দে সেই যন্ত্রনাও তুচ্ছ করে ছিলাম তখন।
বাড়ির পৌড় ভদ্রলোক ছিলেন খুব ই ভালো মানুষ ওনার সাহায্য ছাড়া আমরা কখনই সেই কুল নিতে পারতাম না।সত্যি বলতে সেরকম মিষ্টি কুল আমি আর কখনো কোথাও খাইনি।
কুল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঘটেছিল বিপত্তিটা, আমাদের দলের যে পান্ডা ছিল যে আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কিছুটা  আসার পর সে নিজেই পথ হারিয়ে ফেলে,অগত্যা আমাদেরও তাই দশা। কোথা দিয়ে এসেছিলাম কোথায় যেতে হবে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কিছুটা গিয়ে যে পথের সন্ধান করবো বা কাউকে জিজ্ঞেস করবো সেই সাহসও ছিল না, জায়গাটা বেশি দূরে না হলেও আমরা তখন ছেলেমানুষ বাড়ির বাইরে সেভাবে বেড়োনোর অভ্যাস নেই, একা তো নয় ই। সবাই ই ভয়ে আতঙ্কে একেবারে থতমত , কাঁদো কাঁদো অবস্থা,সবই যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতো লাগলো।একটা কথাই কেবল মনে হচ্ছিল, কি কুক্ষনেই যে কুল পারতে এসেছিলাম, বাড়িতে থাকলে এমন কুল কতই খেতে পারতাম। এবার তো নির্ঘাত ছেলেধরা ধরবে আর বস্তায় পুড়ে নিয়ে চলে যাব মনেড়ির কারো সাথেই আর দেখা হবে না কোনদিন। 
আর কিছুক্ষণ এভাবে চললে কি হতো বলা যায় না  কিন্তু আমি যে হাত,পা ছড়িয়ে তারস্বরে কাঁদতে বসতাম সে ব্যাপারে প্রায় কোন সন্দেহ নেই,, ছোট থেকেই আর কোন গুন থাকা না থাক ওটা ষোলআনাই আছে আমার ।ভাগ্যিস আমার এক দাদু সেখান দিয়ে সাইকেল চড়ে কিছু একটা কাজে যাওয়ার পথে আমাদের দেখতে পান আর সেখান থেকে নিয়ে আসে।। সেদিন বাড়িতে নির্ঘাত কপালে দুঃখের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল ওই চোট টাই। না‌ হলে আর রক্ষা ছিল না।
এরপর আমরা সবাই বড়ো হয়েছি , প্রাইমারি পাস দেবার পর সব হাইস্কুলেও ভর্তি হয়েছি, পুরনো কারো সাথেই আর যোগাযোগ ছিল না সেভাবে। কিন্তু জীবনে প্রথম বন্ধুদের সাথে এভাবে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ আমি কখনো ভুলিনি। এরপর ও বন্ধুদের সাথে কতবার কত জায়গায় গিয়েছি,আনন্দ করেছি কিন্তু সেই প্রথম বারের মতো আনন্দ আর হয়নি।

মন্দির লাগোয়া যে একটি টিউবওয়েল ছিল সেটা অবশ্য এখনো আছে ,আগে লোক বসতি কম হবার দরুণ স্থানীয় লোকেদের স্নাহারের জন্য ব্যবহৃত হতো এটি । এখন অবশ্য প্রত্যেক বাড়িতেই টিওবয়েল, মোটরকল বসেছে, এখন আর  বাইরে পাড়ার মোড়ে কলতলা কিম্বা দুমাইল দূরে পুকুর পাড়ে পাড়ার বৌ, ঝি মিলে একসাথে কাপড় কাচতে যাওয়া,স্নান করতে যাওয়ার রেওয়াজ আর নেই সেভাবে ।তবে এখনো কিছু অত্যুৎসাহী ব্যক্তি বা পুরনোকে আকড়ে ধরে বাঁচতে ভালোবাসেন এমন লোকজন এখনো ব্যাবহার করে থাকেন এই কলটি।
এতদিন পর সেই ষষ্ঠী তলা কে দেখে আমি একেবারে অবাক,আপাদমস্তক তার অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগের কিছুই আর সেরকম নেই।  ইঁটের খাদরি করা রাস্তাটা ঢালাই করা পাকা রাস্তা হয়েছে, তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। আগে যেখানে প্রদীপ বা বাতির আলোয় ভরসা ছিল, সন্ধ্যার পর চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসতো এখন সেখানে বিজলী আলো জ্বলে,অন্ধকারে ঠাকুরের মন্দিরকে দেখতে কার ভালো লাগে।
তবে সেই অন্ধকারেও অপূর্ব শোভা বর্ধন করতো মাঝে মাঝে।একবার সপরিবারে একটা বিয়ে  বাড়ি থেকে আসতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি ফেরার উদ্দ্যেশ্যে ওই পথ ধরে আসতে গিয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। এরপর ও বেশ কয়েকবার সেই দৃশ্য দেখার লোভেই ওই পথ ধরে যাতায়াত করেছিলাম। দুচোখ সার্থক করে ছিলাম সেই দৃশ্য দেখে।  

আকাশে যখন ভরা পুর্নিমার চাঁদ উঠতো সেই চাঁদনী রাতের আলোর ছটা এসে পড়তো মন্দিরের গায়ে ও তার চাতালে, শুধু মন্দির চত্বরেই নয়, বিজলী আলো হীন সম্পূর্ণ গলিটাই আলোকিত হয়ে থাকতো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বথ গাছটার ছায়ায় এক অপূর্ব আলো আঁধারির পরিবেশ তৈরি হতো, ভাঙ্গা বাড়ির কানিশে বসে থাকা পেঁচার চোখ অন্ধকারে আরো জ্বলজ্বল করতো, কত যে রাতচরা পাখির আশ্রয়স্থল ছিল গাছটা ক্রমে মানুষের আধিপত্য আজ তারা অন্তর্হিত। তাদের বিভিন্ন রকম ডাক,পাশে পুকুরের ঝিরি ঝিরি হাওয়া, অন্ধকারে ঝোপের মধ্যে থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁর ডাক, ব্যাঙের ডাক,মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ উড়ে যাওয়া কোনো পাখির ডানার ঝাপটায় শিহরণ জাগতো।এক অদ্ভুত অনুভূতি হতো মনে।  মনে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে বসে সময় কাটিয়ে দিতে, এই  রাত পরীদের বিচরণ ক্ষেত্রে , যেমনটা গল্পের বই এ পড়েছি বা ঠাকুমার কাছে শুনেছি ঠিক সেই গল্পের মতো।  কি হবে শহুরে কোলাহল পূর্ণ জীবনের মধ্যে গিয়ে। আমাদের সামনে দিয়েই দুটো শেয়াল চলে গেল ওই ঝোপের মধ্যে মানুষ দেখে ওরা আর ভয় পায় না।জায়গাটা শহরের মধ্যে হলেও মনে হতো শহর থেকে অনেক দূরে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে, যেখানে শহুরে কোনো ছোঁয়ায় এসে পৌঁছায় নি এখনো পর্যন্ত, অথচ কে বলবে আর এক পা দু'পা এগিয়ে এই গলিটা পেরোলেই ঝা চকচকে শহুরে জীবন। 
 
আজ সেসব আর কিছু ই নেই, মন্দির ও তার পাশের সেই গাছটা এক থাকলেও,পাশের সেই ফাঁকা জায়গা, সেই ঝোপঝাড় আর কিছু ই নেই । একতলা দোতলা বড়ো বড়ো পাকা বাড়ি তৈরি হয়েছে তাদের আড়ালে চাঁদের আলো আর ঠিক মতো আসতে পারে না গলিটাই। তাছাড়া বৈদ্যুতিক আলোও এসেছে।পাশের পুকুর টাও হয়েছে এখন এইসমস্ত বাড়ি গুলির নোংরা জল ফেলার জায়গা। একটা বাড়িতো দেখলাম প্রায় মন্দিরের পেছনে অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েই তৈরি হচ্ছে। এখন তো প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই পাওয়ার লুম, কম সময়ে ও শ্রমে বেশি কাপড় তৈরি করার যন্ত্র,  আমাদের শহরে তাঁতের তৈরি শাড়িই অথনৈতিক ভিত্তির মূল। তার একটানা বীভৎস কটূ আওয়াজ, গৃহস্থের গৃহস্থালির নানারকম আওয়াজ, পুরোদস্তর শহুরে হাওয়া প্রবেশ করেছে অনেকটাই ।
 
আমাদের বাড়িতেই ষষ্ঠী ঠাকুরের প্রতিষ্ঠার পর আর ঠকুমাও মারা যাবার পর থেকে,বেশ কয়েকবছর ধরে ষষ্ঠী তলায় আর পুজো দিতে আসা হয় না, বাড়িতেই পুজো হয়। কিন্তু এখানটা দিয়ে যাতায়াত করতাম  মাঝে মাঝেই,অনেক দিন থেকেই এর পরিবেশের একটু একটু করে পরিবর্তন হতে শুরু হলেও এই ক মাসে যে এতটা পরিবর্তন হবে তা ভাবতে পারিনি।  তবে শুধু এই ষষ্ঠীতলা নয় আমার ছোটবেলা থেকে দেখে আসা অনেক জায়গায় আসতে আসতে কত যে বদল গেল,তার পুরনো রূপ, রস,গন্ধ একেবারে অন্তর্হিত হয়ে গেল। ছোট থেকেই দেখে আসা কত মাঠ বাগান খাল-বিল পুকুর তাদের পাশে থাকা বড় বড়  সেগুন বট অশ্বত্থ গাছ  আর তাদের মধ্যে কত অজানা পাখি ,প্রানীদের আশ্রয় স্থল সবকিছু আস্তে আস্তে অন্তর্হিত হয়ে গেল। আগে বসন্তকালে ফাল্গুন চৈত্র মাসের বিকেলের দিকে সন্ধ্যেবেলায় অজানা ফুলের গন্ধে মেতে থাকতো দূর থেকে সেই গন্ধ ভেসে আসত বাতাসে । অদ্ভূত ভালোলাগতো । এখন আর সেসব কিছুই নেই । সেই পরিবেশ পরিস্থিতি সেই মানুষজনই এখন আর নেই সব কেমন আছে আস্তে পাল্টে গেলো। আজকের যারা নতুন প্রজন্ম তারা এসব কিছুই আর দেখতে পাবেনা, তাদের নিজেদের জন্মস্থানের অনেক কিছুই তাদের কাছে অধরা থেকে যাবে। পৃথিবী পাল্টাবে পরিবেশ পাল্টাবে সমাজও পাল্টাবে, রয়ে যাবে শুধু স্মৃতিপটে থেকে যাওয়া কিছু মধুর সময়।

গল্পকার চৈতালি নাগ
সুত্রাগড়, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ 































0 Comments