
ধানের গোলা বর্ধমান: নতুন প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে
ধানের গোলা জেগে উঠেছে, মাঠে মাঠে সোনালী ধান মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা মাঠে মাঠে চাষীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। পশ্চিম, উত্তর প্রান্ত থেকে দলে দলে লোক কাজের আশায় বর্ধমান এ ভিড় করছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই স্বর্ণ মসূরী ধান চাষীদের খামারে উঠতে শুরু হবে, চীনের হোয়াংহো উপত্যকার মত এখানকার দামোদর এবং খড়ি নদীর দুই দিকেই বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধান চাষের জন্য বিখ্যাত।
বর্ধমান জেলার শিল্পাঞ্চল বাদ দিয়ে ৩৩ টি ব্লকের মধ্যে প্রায় ৩৩টি ব্লকে প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপাদিত হয়, তারমধ্যে বর্ধমান সদর মহকুমার, কালনা মহকুমা এবং কাটোয়া মহকুমার সমস্ত ব্লকে প্রচুর পরিমাণে ধান চাষ হয়। এমনিতেই বর্ধমান জেলার যে ভৌগোলিক পরিবেশ টা ধান চাষের জন্য আদর্শ।বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ, ভাতার, বর্ধমান-১, রায়না, গলসি, মঙ্গলকোট, মন্তেশ্বর প্রভূতি ব্লকে প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপন্ন হয়। এক কথায় বলতে গেলে পূর্ব বর্ধমানের প্রায় সমস্ত ব্লক ধানের জন্য্ পৃথিবীতে বিখ্যাত।এই ফসল কে কেন্দ্র করেই এখানে গড়ে উঠেছে রাইস মিল, চিড়ে মিল, মুড়ি মিল প্রভৃতি। সবই ঠিক,তবুও এই ঐতিহ্যবাহী পেশা নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে পারছেনা ধানের গোলা।
নতুন প্রজন্ম কেন এই ঐতিহ্যবাহী পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে? এর কারণ খুঁজতে গেলে আমাদেরকে এই পেশার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটু পর্যালোচনা করতে হবে। বলতে গেলে বর্তমানে কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলি চাইছে না নতুন প্রজন্মকে এই পেশায় যুক্ত করতে। তাছাড়া অন্য পেশায় এত পরিশ্রম নেই, এবং রোজগারও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। একজন কৃষকের কাছে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম তার উত্তরে তিনি বলেন এই শ্রী হরনকারী পেশায় পরিশ্রমের তুলনায় রোজগার অনেক কম। কৃষক পরিবারগুলির মানুষের মানসিকতা যদি এরূপ হয় তাহলে বলতে হবে ধানের গোলা বর্ধমানের ঐতিহ্য আর কতদিন টিকে থাকবে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
বর্তমানে উন্নত বীজ, সার কীটনাশক ইত্যাদি প্রয়োগের ফলে ফসলের উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে, কিন্তু উৎপাদনের তুলনায় খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, তাই এই পেশাকে অবশ্যই আর লাভজনক বলা যাবে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশেষ করে চীন,জাপান,থাইল্যান্ড প্রতিটি দেশের উৎপাদন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি,এবং পুরোটাই প্রযুক্তিনর্ভর হওয়ার জন্য খরচ অনেক কম। আমাদের দেশের চাষিরা এই দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছে,ফলে বিশ্ববাজারের সিংহভাগ এরা দখল করে নিচ্ছে। ভারতের বাসমতী,বাঁশকাঠ প্রভৃতি চাল বিশ্ববাজারে ভালো চাহিদা আছে, কিন্তু দামের হেরফের জন্য তেমন সুবিধা করতে পারছে না।
বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ, এর ব্যবহার যেমন শিল্প ও বাণিজ্য বেড়েছে, তেমনি কৃষিতে যথেষ্ট প্রয়োগ ঘটেছে। চীন জাপান থাইল্যান্ড ইন্দোনেশিয়া প্রকৃতি দেশগুলি উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে চাষে যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশের চাষিরা প্রযুক্তি ব্যবহারে যথেষ্ট অনীহা, তারা ম্যানপাওয়ার এর ওপর অনেকখানি নির্ভর করে, ফলে ফসলের উৎপাদনের তুলনায় খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। কিন্তু ঐ সমস্ত দেশ ফসলের উৎপাদন থেকে শুরু করে গোলাজাত বাজারজাতও করার জন্য সমস্তটাই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে ফলে তাদের চাষে লাভ অনেকটাই বেশি।
আর একটা কথা না বললেই নয়, বর্ধমানের চাষীরা এখনো অনেকটাই সাবেকি প্রথায় চাষে অভ্যস্ত, নতুন প্রযুক্তি জ্ঞান এদের যথেষ্ট কম, তাছাড়া নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম যেহেতু এই পেশায় যুক্ত নয়, তাই তারা নতুন প্রযুক্তি নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না। শিল্পায়ন ও নগরায়ন এর হাত ধরে ভারতীয় সমাজ জীবনে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে, পাশ্চাত্যের প্রভাবে ভারতীয় সমাজের অনেক উলটপালট ঘটেছে, বা ঘটছে। সাবেকি যৌথ পরিবার গুলি ভেঙে টুকরো টুকরো নিউক্লিয়ার পরিবারে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে জমির খন্ডীকরণ ঘটছে, জমির আয়তন ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার অসুবিধাজনক।
সবুজ বিপ্লবের পরবর্তীকালে ভারতের কৃষিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে, দেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংভর হয়েছে, উন্নত সার, বীজ, প্রযুক্তির ব্যবহার বহু গুণ বেড়েছে। তবে এই সবুজ বিপ্লবের প্রভাব কয়েকটি ফসলে বিশেষ করে গম চাষে সীমাবদ্ধ থেকেছে, তাছাড়া অঞ্চলভেদে এর প্রভাব যেমন পাঞ্জাব হরিয়ানা প্রভৃতি মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাজ্যে লক্ষ্য করা গেছে, দেশের অন্যান্য অংশে এতে মন প্রভাব পড়েনি।
চাষবাসের প্রয়োগ বিধি এবং কৌশল নিয়ে সরকারি তরফ থেকে আলোচনা বা সেমিনার হয়না তা নয়,তবে তা প্রায় খাতায়-কলমে সীমাবদ্ধ থেকেছে, চাষবাসের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ বিধি যথেষ্ট কম। আমি নিজে বেশ কয়েকটা সেমিনার বা আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে দেখেছি,লোকের জানার ইচ্ছা,বা উপস্থিতির হার যথেষ্ট কম, সত্যি কথা বলতে কি এই নিয়ে মানুষের উৎসাহ প্রায় তলানিতে। তাছাড়া যারা সেমিনারে অংশগ্রহণ করে বা আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকে তাদের জানার ইচ্ছা যেমন লক্ষ্য করা যায় না।
ধানের গোলা বর্ধমানের মত সমতল ভূমি খুব কম দেখা যায়, এই জেলা ভৌগলিক দিক থেকে ফসলের উৎপাদন এর পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে, ধান কে কেন্দ্র করে নানান শিল্প গড়ে ওঠার যথেষ্ট পরিবেশ এখানে আছে, তবুও নতুন প্রজন্মকে এই পেশায় যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে না, বলতে গেলে অনীহার একটা চোরা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। তারা এই পেশা থেকে বিশেষ কিছু ভাবতে পারছে না, অনেকেই কর্মসংস্থানের আশায় বিশেষ করে নির্মাণ শিল্পে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ভিড় করছে। হয়তো এই পেশার প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে, বা নিশ্চয়তার জন্য অন্য পেশা তাদের কাছে লোভনীয় মনে হচ্ছে। তবে একটা কথা ঠিক চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী এই পেশাকে এখনো বাণিজ্যিক রূপ দেয়া যায়নি, বা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি, সবশেষে একটা কথা বলা যায় যতদিন না এই পেশাকে বাণিজ্যিক ভাবে গ্রহন করা না হবে ততদিন নতুন প্রজন্ম এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
0 Comments