লড়াই
যতবার বাবা 'সিন্দবাদ দি সেলর'এর গল্প বলতে শুরু করে, আসফাক বুঝে যায় যে বাবা আবার একটা কঠিন কাজ তাকে দেবে। আডভেন্চারাস কিছু একটা। তাকে অনুপ্রাণিত করবে। আসলে ক্লাস নাইনে উঠার পরে আসফাকের কাছে জীবনটা আবার এক নতুন অর্থ বহন করে এনেছে। পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় না হলেও প্রায় প্রথম দিকেই থাকে সে বরাবর। ওদিকে স্কুলের ফি,বইপত্রের খরচ মেটাতে তার বাবা আবদুলের নাভিশ্বাস উঠে যায়। কাঠমিস্ত্রীর কাজ করে কত আর পারা যায়। আগে ডুয়ার্সের জঙ্গল থেকে সস্তায় নিলামে কাঠ কিনে আনত।
তা দিয়ে আসবাব বানিয়ে বিক্রি করত।তবে সরাসরি ক্রেতার কাছে নয়। দোকানে দিত। বেশ ভাল আয় হতো। যদিও তার অনেক বেশি লাভ ওই মিডলম্যানরা মানে দোকানীরাই করে নিত! যাক্, ওদের ভালই চলত। ইদানিং কাঠ চোরেদের অত্যাচারে জঙ্গলও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। কাজেই ভীষণভাবে সেই কাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর প্লাস্টিক, উডডাস্ট সহ বিভিন্ন জিনিসের আসবাব বাজারে এসেছে। সেগুলো দামে যেমন কম, টেকসইও বটে! ফলে কাঠের জিনিস সৌখিনরা ছাড়া বিশেষ কেউ আর কিনতে চায় না। ফলে চাহিদা অনেক কমে গেছে। আবদুলকেও বাধ্য হয়ে কাঠের অন্যান্য কাজেই মনোনিবেশ করতে হয়েছে। অভাবের সংসারে টানাটানিও তাই অব্যাহত। তবে আবদুল তার অনেকগুলো অর্জিত সুঅভ্যাস কখনোই ত্যাগ করে নি। লোকের থেকে চেয়েচিন্তে হোক,গ্রন্থাগার থেকেই হোক বই তার পড়া চাইই চাই! আর ছোটোবেলা থেকেই তা পড়ে শোনাত ছেলে আসফাককে। একমাত্র ছেলে আসফাক।সেও বইয়ের পোকা! তবে কিছু গল্প সে বরাবর বাবার কাছেই শুনতে পছন্দ করে। যেমন নাবিক সিন্দবাদের গল্প। কি অসম্ভব সংগ্রাম!প্রতিপদে বিপদ,বেঁচে থাকার লড়াই।সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই উথালপাথাল জীবন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করার অদম্য মানসিকতা! আসফাককে মুগ্ধতার আবেশে আবিষ্ট করে রাখে। স্বপ্নের ঘোরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই গল্পগুলো আসফাকের ভেতরে এক অনুপ্রেরণার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। পথ দেখায়। আলোর দিশা দেখায়। বাবার মতোই সে স্বপ্নপ্রবণ। বাবা পারেনি, কিন্তু সে পারতে চায়। সেই মানসিকতার বশবর্তী হয়ে নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করে যায় আসফাক। স্কুল থেকে ফিরে নাকেমুখে কিছু গুজেই মাঠে দৌড়য় সে। সমীর স্যারের তত্ত্বাবধানে চলছে কসরত। জাতীয় স্কুল মিটে ডেকাথলনে সোনা জিতে ইতিমধ্যেই খবরের শিরোনামে। শুধু তাই নয়,রেকর্ড পয়েন্টও করে বসে আছে! এখন স্বপ্ন এশিয়ান স্কুল মিটে সোনা জেতা। লড়াই চলছে! স্বপ্নের ঘোড়া,পরিশ্রম ও একাগ্রতার পথ ধরে ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে!
এহেন এক বিকেলে ছন্দপতন। স্কুল থেকে পাওয়া সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় দুর্ঘটনা। একটি গাড়ি সজোরে ধাক্কা মারে আসফাকের সাইকেলে। আসলে অনুশীলন শেষ করে বাড়ি আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো আর শীতের দিনে অন্ধকারও তাড়াতাড়ি নামে!
সে যাত্রায় কয়েকটি সংগঠন আর শুভানুধ্যায়ীরা পাশে না দাঁড়ালে কি হত কে জানে! এত খরচ কি আবদুলের পক্ষে টানা সম্ভব হতো! ফতেমাও অবশ্য বাপের দেওয়া সব গয়নাগাটি বিক্রি করে দিয়েছিল। প্রাণে বাঁচলেও একটি পা হারাতে হয় আসফাককে! মুহূর্তে স্বপ্ন চুরমার! নেমে আসে দু'চোখে অন্ধকার। থুড়ি, ছয়চোখে মানে তিন জোড়া চোখেই। হয়তো আরো অনেক চোখেই! যারা ভালোবাসে আসফাককে,আসফাকের স্বপ্নে সামিল করে নিজেদের।যেমন সমীর স্যার! হয়ত আরো অনেকে!
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এলেও মাস তিনেক শয্যাশায়ী। ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানো, আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু। এক পা, দুই পা করে।
এই সময়টা বইয়ে ডুবে থাকে আসফাক। আর আবদুলের কাজ নতুন নতুন বইয়ের সাপ্লাই বজায় রাখা। হঠাৎ একদিন হাতে এল নর্তকী সুধা চন্দ্রনের জীবন কাহিনী। জীবনের আরেকটি বাঁক । বাবাকে বলল,তার কৃত্রিম পা চাই!সে আবার দৌড়াবে,ফিরে আসবে অনুশীলনে। দরকারে কৃত্রিম পায়ের সাহায্যেই।
প্রয়োজনে অংশ নেবে প্যারা এশিয়ান মিটে। তারপর প্যারা অলিম্পিক! লড়তে যে তাকে হবেই ।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ! বাবা যে আসফাকের আইডল। এই জেদের আগুনতো সেই জ্বালিয়েছে ছেলের মধ্যে। আজন্ম লালিত লড়াইয়ের বীজ তো স্বহস্তে সেই বপন করে দিয়েছে ছেলের অন্তরে। মনের গহনে।
জাহাজ যে আবার ছুটতে চলেছে জীবনসাগরে! এক নতুন লক্ষ্যে। এক নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। জীবন মানেই লড়াই! শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়াই।
আবদুল ছেলের অনুশীলনে সোজা পৌছে যায় কাজ থেকে ফিরে। মাঠ থেকে সে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায় রোজ বিকেলে। আসলে লকডাউনে কাজ অনেক কমে যাওয়ায় সংসারের চাপটা একটু বেশিই অনুভূত হয়।
তবে আবদুল ওসব আর পাত্তা দেয় না বিশেষ! এখন আসফাকই যে তার অনুপ্রেরণা! বেঁচে থাকার, লড়াই করার রসদ। কাজেই এই লড়াই যে তাকে লড়তেই হবে। আসফাকের পাশে থেকে। তার স্বপ্নের পাশে থেকে!
0 Comments