অন্তরা দাঁ'র মুক্তগদ্য


জমিন ছুঁয়েছি যেই... 

বি গান বেঁধেছেন-
'ফসলে'র সম্ভারে ধরা দেয় অঘ্রাণ/তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান এই আমাদের পৃথিবী/তুমি সুর আমি কথা মিলেমিশে হই গান/এই আমাদের...' 
সম্বচ্ছর মাথা'র ঘাম পায়ে ফেলে, রোদ-বিষ্টি,খরা-হাজা,বাদল-বান মাড়িয়ে তবে দুটো ফসলের মুখ দেখা। এ যে কী সুখ! মাঠ,জমি,আলপথ সব একেবারে মুখস্থ যেন,জমি তো মা,ফসল দেয়, সারাবছরের অন্ন জোগায়।ধান্যলক্ষী'র পুজো-আচ্চা,গাঁ-ঘরে তাই রেওয়াজ। চাষা'র ঘরবাড়ি,জমি-জিরেত,সুখ-দুঃখ,ওঠা-বসা সবই ওই মাঠ আর ফসল নিয়ে! গ্রীষ্মের শুখা মাঠে'র দিকে তাকিয়ে যখন বুক ফেটে যায়,তখনই আষাঢ়ে'র সবটুকু সম্ভাবনা ঘনিয়ে ওঠে শ্রাবণের মাসেদিগন্তের ঈশান কোনে আশা'র বিদ্যুৎঝমঝম করে বৃষ্টি আসে,মাটি'র খর বুকে ঝরে পড়ে প্রেমে'র অঞ্জলি হয়ে,তখনই মাঠে হাল ধরেছে কৃষক,চষামাটি'র গন্ধে ভরে যাচ্ছে মাঠ, বীজবোনা হচ্ছে। তারপর কোমল সবুজ, ঘাসফড়িঙে'র দেহে'র মত চারাগাছে জমি'র বুকে এক চিলতে করে যেন সুখে'র প্যাচওয়ার্ক! সেই সুখ ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ আদিগন্ত,যেন সবুজ কার্পেট বিছিয়ে দিচ্ছে কেউ,আলো এসে ছুঁয়ে যাবে বলে।আলো'র নরম পায়ে যাতে না ধুলো লাগে,তাইই এই জাজিম। নিড়ানি,সার,কতরকমের যত্ন-আত্তি তার! শারদ আকাশে সোনা রঙ ধরলে ধানে'র শীষে'র ভেতর পুরু হয়ে ওঠে দুধ,পাড়াগাঁ'য় বলে 'ধান ফুলিয়েছে' আসলে তখন প্রেগন্যান্ট উইথ পসিবিলিটি, সিরেসে'র অফফ-হোয়াইট গাউনে'র লেসে'র প্রান্ত তখন অলিভ-ক্ষেতে'র ফাঁকে ফাঁকে,এগ্রেসিয়া'র সাথে লুকোচুরি খেলার অবসরে ঝিলমিল করে উঠছে, আঙুরের খামারে উড়ে আসছে টিয়াপাখি'র ঝাঁক, দিমিতির লাবণ্য ছড়িয়ে পড়ছে যব আর ভুট্টাক্ষেতে'র হলুদে। তখন তিসি আর মকাইয়ের ক্ষেতে চঞ্চল মেঠো খরগোশ, সবুজ মাঠে হলুদের নরম আদরের কনট্রাস্ট, তখন ঘরে ঘরে মাটি'র হাঁড়িতে বন-মোরগে'র মাংস সুসিদ্ধ হয়ে আসছে, হাঁড়িয়া আর চালে'র পিঠে,শুয়োরের লাল মাংস। ছোট্ট কাঠে'র টেবিলে,পাথরের বাটিতে ঘন গরম বাঁধাকপি'র ঝোল,সস্তা'র ফেনি আর মাদিরা,ময়দা'র কেক। টুংটাং বেজে ওঠে চার্চ ক্যারল । 
তারপর প্রোষিতভর্তৃকা নারী'র বিরহে'র মত কুয়াশায়,সেই ফসল পরিনত হয়ে ওঠে, আর সেই রোপণ থেকে সংগ্রহ,এমনকি সংরক্ষণ পর্যন্ত এই যে পারষ্পরিক শৃঙ্খল কিম্বা আরোহন থেকে অবরোহনের সিঁড়ি ছুঁয়ে যারা বেঁচে থাকে,তারা কিষান-কিষানী। এই বৃত্ত'কে ছুঁয়ে তাদের যাপন,সুখ,উল্লাস আর প্রত্যাশা। আমোদ-আল্হাদ'ই বলো আর শখ-সাধ,ইচ্ছে-অনিচ্ছে,রোগ-ভোগ সব'ই তো ওই জমিনটুকু ছুঁয়েই! টুসু গানে'র আশ্চর্য ঘুমপাড়ানিয়া লৌকিক টানের ভিতর দিয়েই কখন চলে আসে নবান্নের দিন,নতুন চাল-বাটা,ফল-মাকড় সন্দেশ দিয়ে মাখা নৈবেদ্য, লাল টুকটুকে কাপড় পড়া এতটুকুন নবান্নলক্ষী'র উদ্দেশ্যে অর্পণ করে গা-গঞ্জের খেটে খাওয়া চাষ-আবাদ করা মানুষের পরিবার।গোবর-নিকানো উঠোনে, পিটুলি'র আল্পনা,কাঁসা বা তামা'র মঙ্গলঘটে সিঁদূরে'র স্বস্তিকচিন্হ এঁকে আমশাখা,লক্ষী'র পাঁজ,নতুন গুড়ের পায়েস,পাঁচ-সাত রকম ভাজা,আখভাজা, নারকেল-ভাজা,পুয়োভাজা, মাছে'র পদ, নতুন চালের ভাত। গান-বাজনা,পুতুল-নাচ, রামযাত্রা'র আসর,নবান্নের আঘ্রান বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই চলে আসতো সংক্রান্তি,পউষ-ডাকা,পিঠেপুলি। মাঘ-মাসে,মড়াইতলায় তখন বুনুই পুজোর ঝুড়ি,মইয়ের আঁকিবুঁকি! রাতে'র পেঁচার ডেকে ওঠা'র সাথে সাথে তুলে নিতে হবে সব যোগাড়-যন্তর। সরষে -তিল-আলু ওঠার সময় হয়ে আসে আবার! সে'সব পব্ব মিটতেই আবার আউশ-আমন-বোরো'র চাকা। দুটো রবিফসল,উচ্ছে,ঢ্যাঁড়স, মেঠো-শশা,ঝিঙে'র মাচা'র গল্প,আরেকদিন বলবো তবে। 

ওঠো গো সব,পোষ পোয়াতে হবে যে! 
কাজে'র আর শেষ আছে গো! 

গদ্যকার অন্তরা দাঁ
কাঁটাপুকুর উত্তর, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ












0 Comments