সুকুমার হালদারের গল্প



ফুড়ুৎ

‘বন্দু তোর লাইগা রে, বন্দু তোর লাইগা রে
আমার তনু জ্বরো জ্বর 
মনে লয় ছাড়িয়া রে যাইতাম’...
গানটা গাইতে গাইতে মাঠ থেকে ফিরছিলো বাবুপাগলা।যত গ্রামের কাছাকাছি আসছে তার উদাত্ত কন্ঠের গান ছাপিয়ে ভেসে আসছে কোলাহল চিৎকার আর কান্নার শব্দ।গান থামিয়ে জোরে ছুটলো সে।উর্দ্বশ্বাসে ছুটে পৌঁছে গেল গাছ-গাছালি তে ঘেরা একটা বাগানে।যেটাকে এখনো লোকে কালাচাঁদের বাগান বলে।আগে লোকজন খুব ভয় পেত,বিশেষ করে দুপুরে কেউ যেত না ওই বাগানের কাছাকাছি।সন্ধ্যায় বা রাতে তো কথাই নেই। নব জেঠু,শীতল দাদু,অবনী খুড়ো এইরকম হাতে গোনা কয়েকজন ডাকাবুকো লোক ছাড়া কেউ ওই বাগানে যেত না।তবে এখন ছেলেমেয়েরা ভয় পায় না।বরঞ্চ ওখানে লুকিয়ে প্রেম করে।উঠতি বয়সের ছেলেরা বিড়ি গাঁজা মদ খাওয়ার হাতে খড়ি দ্যায়।পুরনো দিনের লোকেরা যেন এখনো মাঝরাতে বাঁশী শুনতে পায়।কালাচাঁদের বাঁশী।যার নামে বাগান সে নাকি খুব ভালো বাঁশী বাজাতো।ঐ বাগানে যেন আত্মহত্যা করে গলায় দড়ি দিয়ে।  

বাবু পাগলা হাঁপাতে হাঁপাতে দেখল প্রচুর লোক জমা হয়েছে।সবার দৃষ্টি উপরের দিকে। ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখলো গাছের ডালে একটা শরীর ঝুলছে। কোমরে তার নতুন গামছা বাঁধা।বাবু পাগলা কয়েক মুহূর্ত দেখলো এবং তার নিজের মাথা থেকে গামছার পাগড়ী খুলে দেখছে আর ঝুলে থাকা মানুষটার কোমরে বাঁধা গামছাটা দেখছে।হঠাৎ গগনভেদি চিৎকার করতে করতে গোল হয়ে ঘিরে থাকা ভিড়ের মাঝে গোল হয়ে দুরন্ত বেগে ঘুরতে লাগলো।অত বড় ভিড়ের কিচির মিচির কান্না সব চুপ,গোটা ভিড়ের দঙ্গলটা নিস্তব্ধ নিঝুম।কেউ একজন বাবুপাগলাকে ধরতে যাবার আগে ধড়াম করে পড়ে গেল বাবু পাগলা।নিস্তব্ধতা ভেঙে আবার ভিড়ের দঙ্গলটা হৈহুল্লোড় শুরু করলো।বাবুপাগলা বললো-মোহন খুড়ো কাল আমাকে এই গামছাটা দিয়েছিলো।দুটো গামছা কিনেছিলো কাল বাজার থেকে।আমাকে বলেছিল পাগলা তুই যদি আমার জমিতে আলু লাগানোতে সাহায্য করিস তাহলে তোকে মজুরি ছাড়া একটা গামছা দেব নতুন।দ্যাখো তোমরা সবাই দুটো গামছা এক,নতুন।আচ্ছা লোকে যে বলে ‘নতুন গামছা বা বস্ত্র দিলে পুণ্য হয়’।তবে কি এই!এ শালা সব পুণ্য ওই  ব্যাঙ্কের লোকগুলো খেয়েছে। আমাদের মতো চাষা ভূষোদের বাঁচতে দেবেনা।চারদিন আগে ব্যাঙ্কের লোকগুলো পুলিশ নিয়ে এসে মোহন খুড়োর বাড়িতে ধমকে গেছিল।সেই থেকে কেমন মনমরা ভয় ভয় ভাব নিয়ে চলছিলো।মাঝ থেকে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে খুকু পিসী বললো- ওরে পাগল আজ আবার পুলিশ সকাল ১১টায় এসেছিলো।বলে গেছে কাল ২টোর মধ্যে ব্যাঙ্কে গিয়ে সব টাকা জমা দিতে হবে।মোহন খুব কাঁদছিলো আর বলছিলো- দিদি গো ঐটুকু জমি যদি বেচে দিই তাহলে সংসারটাকে বাঁচাব কি করে।মেয়েটার তো পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবে,আমি কি করব!জানি না কি হবে।ওরা কি জানে না গত বছর চাষের কি অবস্থা হয়েছিল।আমাদের কথা কেউ ভাবে না।এতক্ষণ চুপ ছিল গোঁসাইবাবু। চিৎকার করে বললো ,কে বলেছে ভাবে না আমাদের কথা।ভোটের সময় তো ভাবে!তখন কত পিরিত! দাঁত কেলিয়ে হাসি!এমন ভাব করে শালারা কত কাছের সম্বদ্ধি।ভোট ফুরলে সব ফুড়ুৎ।এবার বাবু পাগলা আবার চিৎকার শুরু করলো, ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ। যাদের যাদের ব্যাঙ্কে লোন আছে তাদের সবাইকে ফুড়ুৎ হতে হবে।মোহন কাকুর মতো ফুড়ুৎ হোতে হবে।গত বছর শিমুলতলায় দুজন ফুড়ুৎ হয়ছে।তার আগের বছর তিনটে গ্রামে চারজন ফুড়ুৎ হয়েছিলো। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ বলতে বলতে আবার দুরন্ত বেগে গোল হয়ে ছুটতে লাগলো।গোঁসাইবাবু বললো ওরে পাগল থাম থাম। না! ওর মাথাটা আবার গরম হয়েছে।বলি ওরে থামা,ওর মাথায় একটু জল দে রে জল দে। হঠাৎ পাগলা থেমে গিয়ে গোঁসাইবাবুর কাছে এসে গোঁসাইবাবুর চারধারে গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো আর বলতে থাকলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ।গোটা ভিড়ের দঙ্গলটা ঝুলে থাকা লাশটা ছেড়ে তখন বাবু পাগলাকে দেখতে লাগলো।মুহূর্তে গোটা ভিড়ের শোক মনে হয় কিছু সময়ের জন্য উবে গেল।কখন সবার মাথার ওপর সন্ধ্যা নেমেছে বুঝতে পারলো না।পাগলা গোঁসাইবাবুকে প্রশ্ন করলো,আচ্ছা বলতো মাষ্টার যারা সারাদিন কোমরে গামছা বেঁধে মাঠে কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে থাকে তারা এত স্বপ্ন দেখে কেন?তাদের এত অপমানের ভয় কেন?বলতে পারলে না তো।ফুড়ুৎ ফুড়ুত!আচ্ছা মাষ্টার বলতো যারা গলায় টাই ঝুলিয়ে ব্যাঙ্ক লুটে এদেশ থেকে ফুড়ুৎ হয় অন্য দেশে তাদের অপমানবোধ নেই কেন? পারলে না তো!মাষ্টার এর উত্তর তোমার জানা নেই,তবু তুমি মাষ্টার!ফুড়ুৎ। খুকু পিসি রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো ওরে তোরা পাগলটাকে ধরে মাথায় জল ঢাল।না হলে ওটা এবার মরবে।বাবুপাগোল বলে চলেছে –খেত খামারে নীল বিষ ফুড়ুৎ, গাছের ডালে গামছা ঝোলে ফুড়ুৎ, টাইগুলো সব ব্যাঙ্ক লোটে ফুড়ুৎ।পাগলার চিৎকার ছাপিয়ে পুলিশ ভ্যানের কর্কশ আওয়াজ এগিয়ে আসছে ভিড়ের দিকে।পুলিশ ভ্যানের হেড লাইট লক্ষ্য করে পাগলা এগিয়ে চলেছে পুলিশ ভ্যানের দিকে।ভ্যানের আলো তীব্র হচ্ছে পাগলা এগিয়ে আসছে।ভ্যান এগোচ্ছে পাগলা ভ্যানের সামনে আসছে,ক্রমশ গোটা ভিড়টা পাগলার পিছনে পিছনে আসছে।পুলিশ ভ্যান এগোচ্ছে। পাগলা,গোটা ভিড়,গোটা গ্রাম এগোচ্ছে,সবার মুখে পাগলার মণত্রধ্বনি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ,ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ... 

সাহিত্যিক সুকুমার হালদার
৪/১ যাদবগড়, হালটু, কলকাতা
















0 Comments