দেবদাস কুণ্ডুর গল্প


রতন বৈরাগ্য 

গ্রামের নাম কুঠি বাড়ি শান্তিনিকেতন থেকে বাসে দু ঘন্টা। নামতে হবে বন গ্রাম। তারপর মেঠো রাস্তা ধরে হেঁটে এলে পড়বে পলাশ গ্রাম।পরেরটা সোনাঝুরি।আর একটু হাঁটলে কুঠি বাড়ি।এই গ্রামের বাইশ বছরের যুবক রতন বৈরাগ্য।গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটা নদী।সেটা মিশেছে দামোদরের বুকে।এই নদীতে মাছ ধরে রতন।তার বাবা ও মাছ ধরতো। কিন্তু তার বাবার নেশা ছিল পালাগান শোনা।রতনকে নিয়ে তিনি পালাগান শুনতে যেতেন। হাত জাল দিয়ে একটা বড় কাতলা ধরল রতন।মাছটার চোখ দুটো দেখে বউয়ের কথা মনে পড়ে গেল। না,এটা বাজারে নিয়ে বেচবে না। নদীর পাশে একটা গর্তে রেখে দিল।আর একদিন একটা চিতল ধরলো।তার চোখ দুটো বাবার মতো লাল।বাবা বড় ভালোবাস তাকে।সেই মাছটা ও রেখে দিয়েছে আর একটা গর্তে।এই রকম আরো দুটো গর্তে আছে মা আর দিদি।

অদ্ভুত মানুষ রতন বৈরাগ্য।রোজ সে মাছ ধরতে আসে না।কারণ রোজ মাছ পাওয়া যায় না।সেদিন গুলি সে উপোষই থাকে প্রায়।সারাদিন আপন মনে গান করে। কখনো কবির কখনো লালন,কখনো ভরতচন্দ,কখনো রামপ্রসাদ,কখনো কমলাকান্ত।এসব সে শিখেছে পালা দেখে।

যেমন আজ গাইল-

"যখনই কেহ নিজেরে জানিতে চায়-একে একে 
পায় লয়

দেহে কেন মাখিস মাটি
চলমান এই মূর্ত ধুয়ে কি লাভ বল?"

নেশা আজ গানের। ভুলে গেছে খাওয়ার কথা।আবার এক কলি গাইলো-
"মন্দির মসজিদ যেথা কিছু নাই,সেথা কার আধিপথ্য কহ?" 

মাঝে মাঝে সে মেলায় চলে যায়।শহুরে বাবুরা তার গান শুনে মুগ্ধ।টাকা দেয় মেলা। সব সে খরচ করে না।জেলে পাড়ায় গিয়ে তার চেয়ে যারা গরীব,তাদের দিয়ে আসে। মন ভালো হয়ে যায়।তারপর যায় নদীর ধারে।হাত জাল রেখে গর্ত গুলি থেকে মাছ তুলে দেখে।আদর করে।মুখের কাছে এনে চুমু খায়।যেন এরা তার সন্তান।রক্তের সম্পর্ক।কত কালের। 

অনেক জেলে এসে নদীতে মাছ ধরে। তামাক খায়। গল্প করে।সে দলে ভেরে না। তার একা একা থাকতে ভালো লাগে। 

'আমাদের ঐ ছোট গর্তে কেন রেখেছিস বাবা?ঐ গর্তে কি চলাফেরা করা যায়,তুই বল?আমাদের মুক্তি দে।' 

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল রতনের।বাইরে খইয়ের মতো সাদা জ্যোৎস্না।হেঁটে হেঁটে রতন চলে আসে নদী পারে।একটা একটা করে সবাইকেই মুক্তি দেয়।নদীর জলে তারা সাঁতার কেটে দূরে চলে যায়।তার চোখ ভিজে আসে। 

ভোর ভোর চলে যায় জেলে পাড়া। হাত জাল আর একটা ছোট টানা জাল নিয়ে। দুটোই দিয়ে দেয় দীনুকাকাকে।

দীনুকাকা অবাক হয়ে বলল 'এসব দিলি যে তা তু মাছ ধরবি লাই?' 

'না।ও কাম আর করবো লাই।' 
'কি করবি তু?' 

গান গাইবো। হাটে বাজারে মেলায়।কত গান। কি হবে এই মাছ ধরে?কত পয়সা হয় বল তুমে?কু কু দিন মাছ পাওয়া যায় না। সেদিন না খেয়ে থাকতে হয়ে লা।গান গাইবো,কিছু তু হবে।মেলা এলে আরো বেশি রোজগার।জেলের জীবন মানষের জীবন হলো?রোদে পুড়ে,জলে ভিজে ক টা টাকা হয় তু বল না?

দীনুকাকা মাথা নাড়ে।বলে,'বাপ জাঠার কাম ছাইরা দিবি তু?' 

'হ। এখন গান আর গান। তোমারে একটা গান শোনাই-
"প্রসাদ বলে - যখন আসবে জোয়ার,উজিয়ে যাবে,ভাঁটিয়ে যাবে,ভাসিয়ে ভেলা।"

আলপথ ধরে হাঁটতে থাকে জেলে রতন বৈরাগ্য।মুখে গান- 
"সে যে মেঘের বর্ণ করিয়া ধারণ--
কভু ব্রজপুরে আসি বাজাইয়া বাঁশি
বজ্রাঙ্গনার মন হারিয়ে লয়।"

 লেখক দেবদাস কুণ্ডু 
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত




 

0 Comments