বিকাশরঞ্জন হালদারের গল্প

মূল স্রোত থেকে দূরে...

"স্রোতস্বী-মর্যাদা  ধায়  মাটির  গড়া শীতে              জেগে থাকে ব্যথা ব্যথা জোনাক গল্প-গাথা"

তখন শীত।ভরা পৌষ।কাঁচা রোদে একটু বেলায় মোলায়েম সকাল।বসে আছি বাড়ির কাছাকাছি একটা টেলিফোন বুথে।পরিচিত।দেখলাম এক লম্বা ফর্সা মেয়ে এগিয়ে আসলো।বয়েস অষ্টাদশীর চূড়া ছুঁয়েছে আন্দাজ।একটা ময়লাটে চুড়িদার পরা।তুঙ্গী বুকের ওপর ময়লা ওড়না যথারীতি।শফেদ।এলোমেলো অপরিচ্ছন্ন ঝাঁকড়া চুল থেমে আছে ওর পিঠের ওপর ঝোপের মতো।

ময়ূখমালা মেয়েটিকে বোকা বলে মনে হলো না। বলল- "দাদা,একটা ফোন করা যাবে? আমার খুব দরকার! "বুথের ভদ্রলোকের  উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই চেষ্টা করলো।হলো না।অনুরোধ করল লাইনটা ধরে দিতে।শীতের কবোষ্ণ রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে ফাঁকা ফাঁকা বুথটায়,দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মুখের ওপর-চোখের ওপর। 

টেলিফোনে কথা বলতে দেখলাম। 

-"স্যার আমার কথাটা শুনুন।কাজটা কিন্তু আমার খুব দরকার স্যার!আপনারা একটা গরিব মেয়েকে চাকরি দিতে পারবেন না? কোনো দিনই কি পারবেন না?জানি স্যার জানি।আমার ভুল হয়ে গেছে।স্বীকার করছি স্যার..." বলতে বলতে কেমন যেন চুপসে যেতে থাকে!

আমার দৃষ্টির গোচরে একটা সবুজ-সোনালী মেয়ে ভেঙে পড়েছে,আমি দেখছি!ভ্যাঁ-ভ্যাঁ কান্নায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওকে দ্রুত নিঃসহায় নিরাশ একাকিত্বের মধ্যে তলিয়ে যেতে দেখছি!বুঝলাম শুধু বাইরে নয়, অন্তরেও এ-মেয়ে অনেক বেশি ভেঙে পড়েছে। দাঁড়িয়ে আছে।যেন স্ট্র্যাচিউ।কেবল দু-চোখে লবণাক্ত তরল,গলার কাছে ঘুলিয়ে ওঠা কষ্টের নিরব তোলপাড়!মুহূর্ত কেমন যেন নিথর হয়ে গেলো। 

বুথের ভদ্রলোক বললেন-"আপনার কি হয়েছে? না-মানে যদিও আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার...জানতে চাওয়াটা ঠিক নয়,  তবু...কি হয়েছে ?এরকম করছেন কেন?"আমি কি জানি কি সব ভাবতে ভাবতে,কোথায় কখন যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম।কথা শুনে ফিরে এলাম বাস্তবে।তবে একটা ঘোর লেগেই থাকলো!

মেয়েটি -"বলছি দাদা বলছি" বলে,কেঁদে কেঁদে হেঁচকি তুলে তুলে বলতে থাকলো-

"আমি ভুল করেছি।অন্যায় করেছি।নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি! বিশ্বাস করুন আমি আর পারছি না!"থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম-"আপনার বাড়ি?এখানে কোথায় এসেছেন? আগে তো কখনও দেখিনি। "বলল- "দাদা ছোটো বেলায় আমার মা'র মুখেই,বাবার কথা শুনেছি।কখনও দেখিনি।বাবা,মা'কে কষ্ট দিতো। তারপর একসময় মা কে ছেড়ে,  আমাকে ছেড়ে চলে যায়!কোথায় তা আমার কেউ জানিনা।আমি মামার বাড়িতে  বড়ো হয়েছি।বেশ লেখাপড়া শিখছিলাম। কি যে হল, প্রাইভেট টিউটর তরণদা'কে ভালোবেসে জড়িয়ে গেলাম!ভালো মন্দ বুঝিনি!ও অনেক চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ওর বাড়ির লোক মেনে নিলো না।আমার বাবার কোনো পরিচয় ছিলোনা তাই।ওরা আমাকে রাখলো না।তরুণদা অনেক চেষ্টা করে একদিন হাল ছেড়ে দিলো!আমি  প্রেগন্যান্ট্..."

কথা থামিয়ে দিয়ে,কথার মাঝে এক মাঝ বয়েস পার হয়ে আসা ভদ্রমহিলা বললেন- "তোমাকে তুমি বলছি।বয়েসে অনেক ছোটো।আমার মেয়ের মতো।তা তোমার মামার বাড়িতে থাকলেনা কেন মা ?তারা তো তোমাকে বড়ো করেছেন?"মাথা নীচু করে এ-মেয়ে  উত্তর দিলো- "তারা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।আমি তরুণদার সঙ্গে..."আবার থামিয়ে দিলেন ঐ মহিলা-"ঠিক আছে ঠিক আছে আর বলতে হবেনা বুঝেছি।শোনো,তোমার কিচ্ছু হয়নি।তুমি হেরে যাওনি।পৃথিবীতে ভালোবাসতে চাওয়াটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।তুমি-আমি কেউই সেই প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করতে পারি না।আর তাই আমাদের ভুল হয়ে যায়।বার বার করে ভুল হয়ে যায়!সাবধানী মানুষ ভীষণ প্রেমহীন- ভালোবাসাহীন!কোনো ঘাত নেই,প্রতিঘাত নেই,কিংবা থাকলেও তা যেন চোখেই পড়ে না।সর্পিল গতি সন্তর্পিত জীবন।তোমার জীবনে ট্র্যাজেডি আছে-স্টোরি আছে!" 

আমাকে দেখিয়ে স্থানীয় কে একজন কাছ থেকে বলে দিলো- "ছোটবাবুর সঙ্গে  ওনাদের বাড়িতে যাও।উনি ভালো মানুষ।তোমার ভালো হবে। "শীত যেন নিজেই শীতার্ত হয়ে উঠলো!প্রকম্পনে!একটা আশ্চর্য রকমের নীরবতা নেমে এল এই টেলিফোন বুথে। 

শৃঙ্খলা ভেঙে মেয়ে আবার বলতে শুরু করলো।কণ্ঠ আরও ক্ষীণ,আরও করুণ।"আপনারা আমাকে কিছু খাওয়াতে পারবেন ?বড্ড খিদে পেয়েছে। আমার কাছে সেরকম টাকা-পয়সা নেই।"বুথের ভদ্রলোককে  বললো-"কতো হয়েছে দাদা?এটুকু দিতে পারবো।" দিয়ে দিলো। 

আমি ওকে ডেকে নিয়ে এলাম বাড়িতে।খেতে দিলাম সামর্থ্য মতো।বললাম-"আপনার নাম কি ? উত্তর-"আমার নাম  ঊর্মিলা শর্পা।ডাক নাম ক্ষণিকে।"কি বলবো ভাবতে পারছিলাম না।বললাম-"সৎপথে থাকুন আমি আপনার সঙ্গে আছি।মাঝে মাঝে আসবেন।মনে করলে খোলা মেলা কথা বলতে পারেন।সত্যি কথা গুলো।মনে মনে বললাম- "কথারা কাকলি হয়। সুর তোলে!"বললাম-"আমি চেষ্টা করবো আপনার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে।" 

একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেয়ে বললো- "দাদা,এতগুলো বছর আগে যারা আমাকে তাড়িয়ে দিলো,যত ভালোই হোক্ সে বাসায় 'ভালোবাসা নেই!আমি আর ফিরতে চাই না।আমার সম্ভ্রম বোধ আমাকে বাধা দেয়।লজ্জা এসে চোখ চেপে ধরে!"  

যাওয়ার সময় একরকম জোর করেই আমাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে গেলো।বললো-"আমাকে আর আপনি বলবেন না। "বোকার মতো মেনে নিয়ে বললাম-"আবার এসো ক্ষণিকে।সংকোচ কোরো না। "ও,চলে গেলো।থমথমে মুখে ওকে চলে যতে দেখলাম!  

কতো শীত-রোদ এরপর খেলা করে গেছে কতোরকম করে!হাসি-গানে ভরে উঠেছে কতো আটপৌরে জীবন!ও,আর ফিরে আসেনি কোনো দিন!একটি বারের জন্যেও না !বিশ্বসংসারে কোথায় কোন পথে যে হারিয়ে গেলো অবুঝ অভিমানে কে জানে! 

মাঝে মাঝে বড় টান অনুভব করি!একি  বিচিত্র রহস্য জীবনের !নিয়ম আর ব্যতিক্রম একাকার হয়ে যায়!কেঁদে ওঠে মন!সে-কি বন্ধুতা?সে-কি প্রেম?কিছুই বুঝতে পারিনা...

লেখক বিকাশরঞ্জন হালদার 
রঘুনাথপুর, বিরেশ্বরপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা















0 Comments