চন্দন আচার্য'র ভ্রমণ কাহিনি


লোথাল ভ্রমণ কাহিনি 

মেদাবাদ আসার আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল লোথাল দেখার।আমরা প্রাচীন যুগের আবিষ্কৃত বসতি হরপ্পা,মহেঞ্জোদারোর নাম শুনেছি।এখন কার ইতিহাসের বইতে পড়ানো হয়।আজ হতে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বন্যা কিংবা বহিঃ শত্রুর আক্রমণে সভ্যতা দুটি ধ্বংস হয়। প্রায় একশ বছর আগে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ায় হরপ্পা মহেঞ্জোদারো পাকিস্থানের অংশে পড়েছে।দেখার ইচ্ছে হলেও সম্ভব নয়পাকিস্থানে প্রায়ই এখানে সেখানে উগ্রপন্থী হামলা ঘটেহরপ্পা মহেঞ্জোদারো দেখতে গিয়ে পৈতৃক প্রাণটি বিসর্জন দিতে মোটেই রাজি নই।

প্রাচীন সভ্যতা বা পুরাতত্ত্ব দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হয়।মিশর,ব্যাবিলন বা গ্রীক ইত্যাদি প্রাচীন সভ্যতা বা  প্রতিবেশি দেশ পাকিস্থানের মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার কথা বইয়ে পড়েছি।অথচ আমরা অনেকেই জানি না,হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সময়কার অনেক প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে ভারতর বিভিন্ন জায়গায়এর  মধ্যে একটি হল গুজরাটের লোথালএটি ঐ সময়কার বন্দর নগরীআমেদাবাদ থেকে লোথালের দূরত্ব প্রায় প্রায় আশি কিলোমিটার

আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল,যে কোন প্রাচীন সভ্যতার মাটিতে দাঁড়িয়ে সে সময়কার মানুষের সৃষ্টিকে ছুঁয়ে দেখারচোখের মাধ্যমে সেই সময়কে অনুভব করারইতিহাস নাকি কথা বলেভাবলাম দেখিই না গিয়ে,ইতিহাস আমাকে কোন কথা বলে কিনা

লোথালের সঙ্গে দেখার ইচ্ছে,মহাত্মা গাধীর সবরমতী আশ্রম,সিড়ি কুঁয়ো,শকিং টাউয়ার,আরও যা যা আছেহোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললামওরা এই প্রথম শুনল লোথালের নামকি দেখার আছে জানতে চাইলসব শুনে বললআপনি শিক্ষক বলেই লোথাল সর্ম্পকে জানেন,যেতে চাইছেনআর তো কেউ আমাদের লোথালে যাবার কথা বলেনিশুভ গুগল ম্যাপে লোথালের অবস্থান এবং দূরত্ব  দেখিয়ে দিল তাদেরআগে এবং পরে এই প্রযুক্তি আমাদের কোন জায়গারঅবস্থান খুঁজতে সাহায্য করেছেযাইহোক ফোনাফোনি করে একটি ইন্ডিকা গাড়ি ঠিক করে দিলভাড়া প্রতি কিমি নয় টাকা হিসাবে শেষে ঠিক হল আড়াইশো কিমি আমরা ঘুরবতার মধ্যে লোথাল সহ যা যা দেখার দেখে নেবগাড়ি আসবে সকাল আটটায়

রাতে বের হলাম বাঙ্গালী খাবার খুঁজতেভাতের সঙ্গে যদি সবজি অথবা আমিষ খাবার পাওয়া যায়চাইনিজ খাবার,বিরিয়ানী মাংস এন্তার পাওয়া যায়কতটুকু পর পর ফাস্ট ফুডের দোকান কিংবা রেস্টুরেন্ট আছেখূঁজতে খুঁজতে বেশ খানিকটা হাঁটার পর রাস্তার ধারে খোলা এক ফাস্ট ফুডের দোকান রাজি হল ডিম ভাজি আর ভাত দিতেঠাণ্ডা ভাতডিমের অমলেটতাই আমায়ের  কাছে অমৃত বলে মনে হচ্ছিলপরিবেশনকারী একটি ছেলে আমাদের কথা শুনে এগিয়ে এসে বলল,আমিও বাঙ্গালিওর কথায় হিন্দি টান স্পষ্টজিজ্ঞেস করলাম,বাড়ি কোথায় রে? –আজ্ঞে,ঝাড়খন্ডে বেশ ভাল লাগল দূরদেশে এক বাঙ্গালিকে দেখতে পেয়ে।হোক না বাংলা ভাষায় হিন্দি টান।খাওয়া শেষের পথে এমন সময় দোকানদার ফোনে কাকে যেন বলল, ওয়ালিকুলাম সেলাম।মুখে গ্রাস নিতে গিয়ে একটু থেমে গেলাম।চিরাচরিত হিন্দু সংস্কারে কোথাও যেন একটু টাল খেল।

সকাল আটটায় গাড়ি এসে হাজির। ড্রাইভার অল্প বয়সের ছেলে।নাম তোশিব।নিজের ঢাক পেঠাতে সব সময় ব্যস্ত।গাড়ি চালাতে চালাতে বলে দিল,ওকে সবাই পছন্দ করে।প্রায় সময়ই ট্রিপ থাকে।অনেক সময় পুরানো পার্টি দূরের ট্রিপে ওর সঙ্গে ওর স্ত্রীকে নিয়ে যেতে বলে।লাল দরওয়াজার সামনে ওর চৌদ্দ কামরার বাড়ি আছে।ভাড়াটে বসায় নি,পছন্দ করেনা।বুঝি,ওজন বাড়ানোর জন্য এ সব কথা।যদিও যাওয়ার সময় চেয়ে বকশিশ নিল।

গাড়ি শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরল।দিগন্ত বিস্ত্রৃত সমতল জমি।লোকালয়ে কোথাও জলসেচের সুযোগ থাকায় চাষ হচ্ছে।পেঁয়াজ,গম,ভুট্টা,আখ ইত্যাদি।দু’লেনের রাস্তার ধারে অনেক জায়গা নিয়ে গাড়ি, বস্ত্র,কেমিক্যাল ইত্যাদি শিল্প গড়ে উঠেছে।প্রায় দুঘণ্টা পর তে রাস্তার মোড়ে লোথাল যাবার পথ নির্দেশ মিলল।লোথাল শুনশান জায়গায়।তাই এখান থেকে ফল,আঁখের রস দ্বারা উদর ভর্তি করে নিলাম।আবার গাড়ি চলল।এক সময় দেখা মিলল, লোথালের।যে ছবি আমরা ইন্টারনেট বা অন্য কোথাও দেখেছি।

মাথার উপরে গনগনে রোদ।বাতাসে যেন আগুনের হলকা।বড় কোন গাছ এদিকে চোখে পড়ল না।তাড়াতাড়ি সামনের অফিস ঘরে ছুটে যাই।এটি একটি মিউজিয়াম।এখানে মাটি খুঁড়ে যে সব জিনিস পত্র পাওয়া গিয়েছিল,তাই রাখা আছে।অবশ্য গুরুত্ব পূর্ণ দামী জিনিস এখানে রাখা হয় নি।দিল্লীতে নিয়ে গেছে।ঐসব জিনিসের ছবি কিংবা রেপ্লিকা রাখা আছে।

জন প্রতি ত্রিশ টাকা করে এন্ট্রি ফি।বন্ধ থাকে শুক্রবার। মিউজিয়ামে ঢুকে লোথাল সর্ম্পকে একটি লিফলেট চেয়ে নিলাম।পড়ে যা জানলাম,- লোথাল শব্দের অর্থ,মৃতের শহর।এটি হরপ্পার সময়কার সভ্যতা।যার সময়কাল,২৫০০-১৯০০খ্রীষ্টপূর্ব।১৯৫৫-৬২ খ্রীষ্টাব্দে ডক্টর এস,আর,রাও এর নেতৃত্বে জায়গাটির খনন করা হয়।এই জায়গাটি গুরুত্ব পূর্ণ এই জন্য যে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বন্দর।

মিউজিয়ামে তিনটি গ্যালারি আছে।প্রথমে লোথাল নগরীর একটি সম্ভাব্য ম্যাপ দেওয়া আছে।বাদিকের গ্যালারি গুলিতে পুঁতির মালা,টেরাকোটার গয়না,বিভিন্ন প্রকার সিল মোহরের রেপ্লিকা, শামুক,ঝিনুক,হাতির দাতের,তামা এবং ব্রোঞ্জের ব্যবহৃত জিনিসপত্র।ডান দিকের গ্যালারিতে খেলার সামগ্রী,পশু পাখি এবং মানুষের প্রতিকৃতি (পুতুল)।বিভিন্ন মাপের বাটখারা,চিত্রিত মাটির পাত্র,বিভিন্ন আকারের ইট,লোথালে পাওয়া দুটি মৃতদেহের রেপ্লিকা।লোথালে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর পর তৃতীয় বৃহৎ্‌ সিল মোহরের (পাঞ্জা) সংগ্রহ পাওয়া গেছে।লোথালে ছক্কার মত গুটি দেখেছি,যে গুলিতে গর্ত করে ফুটকি দিয়ে এক, দুই বোঝানো হয়েছে।দাবা খেলার মতো কিছু গুটি দেখেছি।খেলনা গরুর গাড়ি,গণ্ডার,গরিলার প্রতিকৃতি দেখেছি।তামার মাছ ধরার বড়শি,সূঁচ,সছিদ্র কলস ইত্যাদি।আরও খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল,সময়ের তাড়ায় বের হয়ে এলাম।

দু,শো টাকা দিয়ে গাইড ঠিক করে আবিষ্কৃত নগরীতে চলে এলাম,যা মিউজিয়ামের পার্শ্ববর্তী।কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা।ঢুকতেই চোখে পড়ে ডক্‌ ইয়ার্ড।যা দৈর্ঘে প্রস্থে হল ২১৪মিx৩৬মি।এই ডক্‌ ইয়ার্ডটি পোড়া ইট দিয়ে বাঁধানো,এটি একদিক দিয়ে আরব সাগর এবং অন্য দিক দিয়ে সবরমতী নদী ও সিন্ধুর একটি নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। বন্দরে মাল পত্র রাখার  জন্য গুদাম ঘর ছিল,যার মাপ ৪৯x৪০বঃ মিঃ।শহরটির উচু জায়গায় নগর প্রধানেরর ঘর।এখানে বাঁধানো কুঁয়ো,বাঁধানো জল রাখার পাত্র,স্নানাগার,পায়খানা ঘর,সবই উঁচু জায়গায় এবং বাঁধানো।বর্জ্য পদার্থ বের হবার পাকা নর্দমা ছিল।কুয়োর গোলাকার গাঁথনি দেবার জন্য ইটের প্রস্থে দু রকম মাপ ছিল।এক মাথায় ৬ইঞ্চি,অন্য মাথায় ৪ইঞ্চি।নগরের নীচের দিকে ছিল পুঁতি তৈরির কারখানা,অন্য মালামাল তৈরির কারখানা এবং বাজার।এক পাশে শ্রমজীবি মানুষের বাসস্থান।কবর স্থান পাওয়া গিয়েছে,এখনও খনন আরম্ভ হয়নি।ঐ স্থান গুলিতে হাঁটতে গিয়ে মানস চোখে কর্মব্যস্থ বন্দর এবং বাজারের ছবি ফুটে উঠল।কিন্তু সবই অস্পষ্ট।তারা কি ভাষায় কথা বলত,কেমন কাপড় পরত,মালিক শ্রমিকের সর্ম্পক কেমন ছিল সেই প্রশ্ন গুলি আমায় মনে হল আরও ভাল করে খুঁটিয়ে দেখা দরকার ছিল।আবার সুযোগ হলে যাব একবার।উতক্ত করে তুলেছিল।স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে একটা কলস কিংবা পেতলের ভাঙ্গা টুকরো কুড়িয়ে নিলাম।  

লেখক চন্দন আচার্য 























0 Comments