কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা
পটভূমি আসাম।
শেষ দুপুরে ধান কাটা রোদ'টা তখন আমার বাসার সামনে আমলকী আর পলাশের ডালপালায় লুকোচুরি খেলছে। হঠাৎ - কি অসীম কি করছো? - কথায় পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম তাপস সরকার দা, ঝুমা আর তিন্নি গাড়ি থেকে নেমে আসছে। আমি ডালিয়া গাছগুলোর যত্ন করা ছেড়ে গেট টা খুলে দিলাম।
ঝুমা ঢুকেই বললো- বাহ !অসীম দা কি সুন্দর ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা আর সিজন ফ্লাওয়ারের বাগান করেছেন ! ডালিয়া গুলো কত বড় বড়,বাড়ির সামনেটা এক্কেবারে কালারফুল হয়ে রয়েছে ! গৌরী দি কোথায়?
আমি বললাম- ভেতরে আছে, যাও।
ঝুমা ভেতরে চলে গেলো।
সরকার দা বললেন- নাজিরায় হাঁপিয়ে উঠেছি তাই চলে এলাম শিবসাগরে।
আমি বললাম- চলুন ভেতরে গিয়ে বসি।
তিন্নি আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো- কাকু আমাকে একটা ফুল দেবে?
আমি বললাম- ঠিক আছে যাওয়ার সময় নিয়ে যাস।
সবাই মিলে ঘরে এলাম।
সরকার দা গৌরী কে বললো- ভালো করে পেঁয়াজ, কঁচালংকা আর চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখো, সাথে তোমার সেই বিখ্যাত দার্জিলিং টি খাওয়াও।
ওরা এলে সাথে করে নিয়ে আসে অনেক আনন্দ, উচ্ছাস আর হাসি।
সবে আড্ডাটা জমে উঠেছে ,বাইরে গাড়ির আওয়াজ শুনে তাকাতেই দেখি একটা লাল মারুতি গেটের সামনে এসে থামলো।ওটা আমাদের পরিচিত গাড়ি। আমার বন্ধু সুবীর সবকার এলো বৌদি,বান্টি আর বনি কে নিয়ে।
আড্ডাটা জমে উঠলো গৌরীর বানানো স্পেশাল ঝালমুড়ি আর দার্জিলিঙের চায়ে।
বাচ্চাদের মস্তির আওয়াজ'ও পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছিল।
আমি একটু ভেবে বললাম- চলো তাহলে সবাই মিলে কাজিরাঙার জঙ্গলে কয়েক দিনের জন্য হারিয়ে যাই। এক কথায় সবাই রাজি হয়ে গেলো।
সেদিনের সকাল'টা ছিল ১লা পৌষ। কাজিরাঙা আমাদের হাতছানি দিয়ে গেয়ে উঠলো- "পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে,আয় রে চলে,আয় আয় আয়।"
আমার সাদা মারুতিটা রাজহাঁসের মত লাগছিল। আমরা তৈরী হয়ে একটু অপেক্ষা করতেই সুবীর সরকার এসে গেল সপরিবারে।
চোখের পলক পরতে না পরতেই তাপস সরকারের গাড়িটা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ।
আমাদের যাত্রা শুরু হ'ল।
হাসি আর আনন্দে কখন যে আমরা জোড়হাট পৌঁচ্ছে গেছি বুঝিনি। আমাদের Lunch break টা হোল সেখানেই।
লাঞ্চের একটু পরেই আবার তিনটে গাড়ি দূরন্ত গতিতে ছুটে চললো কাজিরাঙার আকর্ষণে।
চারিদিক সবুজ বনানী - মাঝে মাঝে সবুজে ঢাকা ছোট ছোট গ্রাম,দোকান- হাট । হিমেল হাওয়ায় স্বপ্নের আবেশ নিয়ে আমরা এগিয়েই চলেছি! ছোটবেলা থেকেই মনে মনে অনেক কল্পনা করেছি কাজিরাঙার। কেমন সেই রূপ এবার তা নিজের চোখে দেখবার সময় এসেছে।
কালো অজগরের মত আঁকা বাঁকা মসৃণ রাজপথে আমাদের গাড়ির চাকা গুলো অজস্রবার ঘুরে গেলো। হঠাৎ দূরের কালো পাহাড়ে বিকেল এলো। সকলেই তখন ক্লান্ত প্রায়।
আমি গৌরীকে বললাম- এসে গেছি।
কথাটা ওয়েভ তরঙ্গে নিমেষেই অন্য গাড়ি গুলোতে ভেসে গেলো।
রাজপথ ছেড়ে একটু আঁকা বাঁকা পথ ধরে পৌঁছে গেলাম Wildgrass Resort এ। আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলাম।
তখনও সন্ধ্যা নামেনি। অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতির দিয়ে সাজানো, বড় বড় গাছ- গাছালির মাঝে সবুজে ঘেরা resort টা। একটা নাম না জানা পাখি বারবার গাছ পাল্টাতে ব্যস্ত তখন আর তার প্রেমিক এক মনে পাকা পেঁপে খেয়ে চলেছিল। সুইমিং পুলের নীল জলের পার দিয়ে দোতলায় আমাদের ঘর গুলো। সবাই নিজের নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হলাম। আমাদের সকলের ছেলেমেয়েরাও আনন্দে মেতে উঠলো।
তখন অন্ধকার হয়েছে। অনুভব করলাম শীত। তবুও সকলে চা খেয়ে এক সাথে নিচে নেমে এলাম। সামনে একটি বিরাট গাছের উপর চারিদিক রেলিং এ ঘেরা ঘর । আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এবং আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সেখানেই উঠে গেলাম। মাঝখানের বড় টেবিলটা ঘিরে জমে উঠলো আমাদের আড্ডা। ছেলেমেয়েরা খেলায় মেতেছে। মাথার উপর হলদেটে আলো। ছাউনির বাইরে ঘন অন্ধকারে অজস্র জোনাকি ঘুরে ঘুরে আলোর নাচে মেতেছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য!
মহিলারা এর মাঝেই কবিতা ও গানের আলোচনা জগতে চলে গেছে। আমরা সেই সুযোগে সোমরস পানে মগ্ন হলাম। অবশেষে অল্প আলোয় ওখানেই আমরা সবাই ভিনার করলাম।
ঘরে ফিরতে ক্লান্তি এসে সবাইকে ঘুমের দেশে নিয়ে গেল।
পরের ভোরে, মুখ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা ঠান্ডায় খোলা জিপসি তে সদলবলে বেড়িয়ে পরলাম অরণ্যের অজানা রহস্য ও আশ্চর্য কে জানতে ও দেখতে। পৌচ্ছালাম আকাঙ্খিত অরণ্য কিনারে। অনেক দূরে ঘন কুয়াশায় দেখলাম ছোট ছোট ধূসর পাহাড় হেঁটে আসছে। কাছে আসতেই হাতিরা স্পষ্ট হয়ে উঠল। দুটো হাতিতে আমরা মিলেমিশে দুলতে দুলতে গভীর গহণে হারিয়ে গেলাম, হাতির পিঠ ছুঁই ছুঁই বন্য ঘাসে শুধু খস খস আওয়াজ। চোখে পড়লো হরিণের পাল যেন প্রাত ভ্রমনে বেড়িয়েছে। হঠাৎ হাতির মাহুত চুপ করতে বললো, চোখ মেলে তাকাতেই দূরে ঘাসের মধ্যে খস খস আওয়াজ! ক্যামেরা রেডি করে চোখ রাখলাম কিন্তু কয়েক পলকের জন্য এক ঝলক হলুদের ওপর কালো কিংবা কালচে বাদামির ডোরাকাটা শরীর টা চোখে পড়লেও আর কিছু দেখতে পেলাম না। শুধু লম্বা লম্বা ঘাস গুলো দূর পর্যন্ত দুলে উঠে স্থির হয়ে গেল। মাহুত বললো- বাঘ। মাহুতরা ঐ জায়গার আশে পাশে অনেক দূর পর্যন্ত ঘোরালো কিন্তু বাঘমামার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। অবশেষে ফিরে এলাম যেখান থেকে হাতি সওয়ারি করেছিলাম।
একটু পাশেই আকাশ ছোঁয়া সারি সারি রাবার গাছ। গাছের একটা অংশে চৌকো করে বাকল কেটে একটা সরু নল ঢোকানো প্রতিটি রাবার গাছে। সেই নল বেয়ে সাদা ঘন দুধের মত তরল নিচে রাখা পাত্রে জমা হচ্ছে। গাইড বললো ওটাকেই প্রসেস করে কারখানায় রাবার তৈরি হয়। কফি ও রাবার গাছ আমার প্রথম দেখা- প্রথম অভিজ্ঞতা। অনেক ছবি তোলা হলো ওখানে।
ফেরার পথে ছোট্ট একটা পাহাড়ি নদী বয়ে যেতে দেখলাম। সেখানে সবাই পা ভেজালাম। সুবীর সরকার অনেক ছবি তুললো, আমি একটা লাল পাখির ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাপস সরকার দা 'ঝুমা' বলে চিৎকার করে উঠলো। পাহাড়ে পাহাড়ে প্ৰতিধ্বনিত হলো- ঝুমা ঝুমা ঝুমা! সবাই যেন শিশু হয়ে গেলাম। অবশেষে resort এ ফিরে এলাম।
তখন রোদের রঙটা লঘু Nitric acid এর মতো, আমরা খাওয়া দাওয়া করে শীতের পোষাকে দুটো জিপসি করে forest এর অন্য একটা দিকে, আরও গভীরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম।
Forest এর gate থেকে আমাদের সাথে এলেন একজন বন্দুকধারী। গভীর জঙ্গলে মানুষ সমান উঁচু ঘাসের মাঝদিয়ে সরু মেঠো রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো জিপসি দুটো। একদম সামনেই দেখলাম একটা গণ্ডার পরিবার। দুটো বিশাল আকৃতির গণ্ডার আর একটা ছোট্ট গণ্ডার জঙ্গলের একটু ফাঁকা জায়গায় ছোট ছোট ঘাস খাওয়ায় ব্যস্ত। আমাদের মাথার উপর দিয়ে একটা ঈগল পাখনা মেলে উড়ে গেল, হয়তো বা বন্ধুর খোঁজে। আমরা আরো এগোলাম- একদল বাইশন আর একপাল হরিণের কাছে। দূরের দূরবীনে ধরা পড়ল অনেক গণ্ডার। জীবনে প্রথম নিজের চোখে গণ্ডার দেখলাম। ছোট বেলায় পড়েছিলাম কাজিরাঙা গন্ডারের জন্য বিখ্যাত, সেটা খুব ভাল ভাবেই উপলব্ধি করলাম।
অবশেষে এলাম গভীর জঙ্গলে- যেখানে একটা বাঁক নিয়ে নদী বয়ে গেছে- যেন কোনো যুবতী পাশ ফিরে শুয়ে আছে শ্বেত বসনায়। চিতল মাছে ভরা নদীর ওপারে একপাল হরিণ জল খেতে এসে থমকে গেছে হাতির দল দেখে। বন্য হাতির রূপই আলাদা- ছোট ছোট হাতির বাচ্চা গুলো খুব সুন্দর। গাইড বললো হাতির দলের পেছনে বাঘ থাকে- আমি তখন সামনে জোড়া গন্ডারের বিশাল আর বন্য রূপ দেখে চলেছি।দেখলাম নদীর জলে একপাল বন্য মহিশের দূরন্তপনা। নদীর বুকে চিতল মাছ গুলো মাঝে মধ্যেই নেচে উঠছিল রুপোর গয়নার মত।
সবুজে সবুজে ঘন বিশাল এই অরণ্যে অফুরন্ত প্রানের চঞ্চলতা- এমনটা আমি ভাবিই'নি আর নিজের চোখে না দেখলে উপলব্ধি'ও করা যেত না।
এখানে না এলে এই গভীর অরণ্য মাতৃগর্ভের মত রহস্যময়ী হয়ে থাকতো সারাটা জীবন।
বিদায় বেলায় ধনেশ পাখি দুটো বুঝতে পেরে বলে উঠলো- আবার এসো তোমরা আমাদের প্রানের মাঝে।
এবার ফেরার পালা। ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগল সেই গভীর অরণ্য- আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল সেই পরিচিত কোলাহল। ফিরে এলাম অদ্ভুত সুন্দর এক জগত থেকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে।
পথে চা খেয়ে resort এ ঢুকলাম।
সেই সন্ধ্যায় resort এ আয়োজন ছিল আদিবাসী মেয়ে পুরুষদের নাচ। লাল পাড় সাদা শাড়ির ঐক্যতানে ছিল মাদলের দৃমি দৃমি আওয়াজ। মাঝে ছিল লকলকে আগুনের আঁচ। আমাকেও হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ওদের নাচে । অনেক ছবি তুললো সকলে।
আবার সকাল হলো, এবার ফেরার পালা। সকলেই তৈরী হয়েছি ফিরে আসার জন্য কিন্তু কেমন যেন মায়ায় পরে গেলাম সবাই। এত সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে যেতে কারো মন চাইছিল না।
সমস্ত ঘটনাটাই ছোট গল্পের মত মনে হলো- শেষ হইয়াও হইল না শেষ।
আমাদের গাড়ি তিনটে আঁকা বাঁকা পথ ধরে রাজপথে উঠলো।
তৃপ্ত মন নিয়ে শেষবারের মত দূরের সেই সবুজ নিরবতা কে দেখে নিলাম। আস্তে আস্তে আরো দূরে সরে যেতে লাগলাম আমরা। গাড়ির জানালা দিয়ে সদ্য ভেজা চুল উড়িয়ে গৌরী বন্য হাওয়ার অনুভূতি নিতে নিতে গেয়ে উঠলো- কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...।
0 Comments