জিপিদার ডায়েরি—১৫ ~ প্রবীর দে'র রম্য রচনা


প্রবীর দে'র রম্য রচনা 
জিপিদার ডায়েরি—১৫

'সৃজন প্রক্রিয়া' 

অতিমারী বা মহামারী বা ইংরেজিতে প্যান্ডামিক যা-ই চলছে বলি না কেন যারা বেঁচে আছি এখনও তাদের অধিকাংশই মনমারীর কবলে আছি নিশ্চিত ভাবে বলা  যেতে পারে ।

সকাল থেকে ওয়ার্ক ফর্ম হোম সামলে  ঘরের বউ এর ফাইফরমাশের গুঁতো খেতে খেতে কেমন যেন বোকা বোকা স্বভাবের হয়ে গেছি। হয়ত সত্যিই বোকা নই,কিন্তু নিজেকে কেন জানি না আজকাল ওরকমই মনে হয়।সন্ধ্যার পরে বউ যখন টিভির সিরিয়ালে ধ্যানস্থ হয় ,তখন একটু যা ফুরসৎ মেলে...।ঐ তখনই একটু অনলাইন আড্ডায় জিপিদাকে পাই।জিপিদারও তো আমার ই দশা...।

নাহ্,আজ আর বেশিক্ষণ রিংটোন এর মিউজিক শুনতে হয়নি মোবাইলে,জিপিদা শুরুতে ই ফোন এটেন্ড করতে সমর্থ হয়েছে। কি জানি,আজ হয়ত বাড়ির ডিউটি চার্টে  রিলাক্সেশন পেয়েছেন !

প্যান্ডামিকে অফলাইন পড়াশুনা র  সাময়িক অব্যাহতি,ধীরে ধীরে সাবজেক্টিভ প্রশ্ন প্যাটার্ন থেকে অবজেক্টিভ প্রশ্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন ব্যবস্থা র প্রবর্তন,আর চলতি পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক (জনমত ) সিদ্ধান্তের সংমিশ্রণে গৃহীত পরীক্ষাহীন মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রচলন ,অনলাইন লুকোচুরি র মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস ব্যবস্থার প্রচলন,(অনলাইন লুকোচুরি বিষয়টি না বুঝতে পারলে অবশ্যই  ছোট একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারি ---গুগল মিটে লাইভ ক্লাস করতে করতে  কয়েকটি অঙ্ক করতে দিয়ে  পারিবারিক ফাইফরমাশ খাটা...এরকম আর কি),ভুয়ো টীকাকরন হল কিনা সে টেনশনে জ্বর এসে গিয়ে করোনা টেষ্টের  বিড়ম্বনা...প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে জিপিদার গুরুত্বপূর্ণ মতামত নিতে নিতে বেশ সমৃদ্ধ হচ্ছি বেশ কিছুক্ষণ ধরেই...।
হটাৎ মনে হল আলোচনাটির ডাইমেনশন টা একটু ঘুরিয়ে দিই। 
বললাম," জিপিদা,বর্তমানে ইলেকট্রনিক সোসাল মিডিয়ায় এত যে সাহিত্য সৃজনের বিপ্লব (মূলত কবিতা বিপ্লব  বলা যেতে পারে ) চলছে ....সে সম্বন্ধে কিছু খবর- টবর রাখ কি তুমি?
একথা বলার পর একটা কথার ঝড় ওঠার সম্ভাবনা আছে জানতাম,তবে রিস্ক নিলাম ভার্চুয়াল সাক্ষাৎ বলেই।
টেলিফোনে ওদিক থেকে যে ভয়েসটা এতক্ষণ আসছিল,তার পরিবর্তন ঘটবে  জানতাম, হ্যাঁ সে অনুমান মিলেই গেল… 
"খবর রাখি মানে?তোর একথার আসল মানে টা কি?আরে গত সপ্তাহে এই বিষয়ে একটা  আস্ত  প্রবন্ধ লিখে ফেললাম...আর তুই বলছিস্ খবর -টবর রাখি কিনা"! 

জিপিদার মানভঞ্জন করতে তো বেশী সময় লাগে না ….একবার শুধু বললাম ,'জান তো জিপিদা,ম্যানেজমেন্ট চাইছে লকডাউনের বিধিনিষেধ একটু শিথিল হলেই অফিস খুলে দিতে...ওয়ার্ক ফ্রম হোম বাতিল! তোমায় জাস্ট খবরটা জানালাম …’ 
ব্যস! ওয়েদার চেঞ্জড্। 
আমার মুখ থেকে যখন শুনছে,তাতে হয়ত বিশ্বাসটা এসেই গেছে যে খুব শীঘ্রই  'রাতদিন সাতদিন' বাড়ির অফিসারের কড়া শাসনে থাকার জ্বালা থেকে কিছুটা অন্তত রেহাই মিলবে...  অর্থাৎ স্বাধীনভাবে একটু খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারবেন।

চুপ করে আছি বলে কিনা জানি না,দেখি নিজেই বর্তমান সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ভারচুয়াল সাহিত্য সৃজন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বলতে আরম্ভ করলেন...

“এই যে কথাটি বললি না ,’ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়াতে  সাহিত্য বিপ্লব ‘ –এটাকে একটুও হালকা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করিস না যেন । আরে বাবা,এই প্যান্ডামিক পরিস্থিতিতে মানুষ  ঘরের মধ্যে দিনের পর দিন ভারাক্রান্ত মনে প্রায় বন্দীদশায় দিন কাটাচ্ছে ।চারিদিকে বহু পরিচিতজনের মৃত্যু মিছিলে বিষন্ন মনকে  হাল্কা করতে সচেষ্ট হয়ে মানুষ  যদি  তার অনুভূতিকে সৃষ্টিশীল বিষয়ে রূপদান করতে চায় কিম্বা বলা যায় সৃজনশীল বিষয়কে আঁকড়ে ধরে কাটাতে চায় তো ক্ষতি কি ?

কিন্তু মুশকিল টা কোথায় জানিস!
সবক্ষেত্রে উদ্দেশ্যটা ঠিক এক রকম থাকছে না। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকুক বা না থাকুক সাহিত্য কর্মসৃষ্টির প্রকাশের দ্বারা  সোসাল এসটিম নিডস্ ফুলফিলের প্রচেষ্টান্মুখ কিছু ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হচ্ছে।অধিক উৎপাদন হচ্ছে হয়ত কিন্তু গুণগত দিক থেকে প্রশ্নচিহ্ন  রয়েই যাচ্ছে।আর লক্ষ্য করলে দেখতে পাবি বর্তমানে পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যা অনেক বেশী।পড়ছে না কেউ ঠিকঠাক,শুধু লাইক দিলেই হল। আর একটা বিষয় আছে ,সাহিত্যের সকল শাখায় কিন্তু সৃজন বৃদ্ধির হার তো আর এক নয়,  শুধু  কবিতা আর কবিতা...গল্প,প্রবন্ধ  ইত্যাদির সংখ্যা তো নগণ্য। আর কবিতাও এখন  টি টুয়েন্টি ম্যাচের মত অথবা বলা যায় অবজেক্টিভ টাইপ প্রশ্নের মত।  কবিতারও আবার এখন অনেক ভাগ  -- অনু কবিতা,পরমানু কবিতা ,চার লাইনের কবিতা, সাত শব্দের কবিতা… ইত্যাদি ইত্যাদি ।এরপর হয়ত এক শব্দের কবিতা লেখার প্রচলন ঘটবে । 
তখন কেউ হয়ত  সম্বন্ধী শব্দের প্রতিশব্দটি লিখে উপরে হেডিং দিল 
‘এক শব্দের কবিতা – ………
কবি……’।

কিন্তু জিপিদা,এসবের কারণটা কি সে সম্বন্ধে কোন আইডিয়া দিতে পার…

'আমার কি মনে হয় জানিস,সাম্প্রতিক কালের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন অর্থাৎ সাবজেক্টিভ থেকে অবজেক্টিভ টাইপ এ আসাটা কবিতাকে হয়ত প্রভাবিত করেছে।মানুষ এখন সৃজনের মানের চেয়ে  প্রচার যন্ত্রের সক্রিয়তার দ্বারা নিজেকে খুব সহজে প্রকাশিত করতে চাইছে হয়ত।নতুন নতুন কবিতা ঘরানার প্রবর্তনের প্রচেষ্টার পিছনেও হয়ত এ উদ্দেশ্য থাকতে পারে । হ্যাঁ,ঘরানা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে মৌলিকত্বকে অস্বীকার করছিনা,ঠিকই তবে গ্রহন করার বিষয়ে স্বাধীনতা তো রয়েছেই।তবে হ্যাঁ ,এসবের ফলে কালজয়ী সৃজনের ফোকাস কিছুটা হয়ত বাধাপ্রাপ্ত হয়।আর কবিতার ঘরানা তৈরির ক্ষেত্রে অনুমোদন প্রদানকারী কোন নির্দিষ্ট যোগ্য প্রতিষ্ঠান না থাকায় কবিতার বিচিত্রতায় হয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছি ঠিকই,কিন্তু ভাবিকালে এসবের গ্রহনযোগ্য অস্তিত্ব কতটা মজবুত হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।সেক্ষেত্রে পরে মনে হতে পারে ,সময় নষ্ট হয় নি তো !অবশ্য এগুলো আমার একান্ত নিজস্ব মতামত।

একনাগাড়ে অনেক কিছুই বলে গেলেন জিপিদা। খুব যে বিস্মিত হয়েছি তা বলবো না।জিপিদার থেকে আর নতুন কিছু তো পেতে হবে …
বললাম ,এত যে কবিতা প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে জিপিদা …কত যে অনুভুতি, কল্পনা, বাস্তবের অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি কবিতায় রূপ পাচ্ছে … তা এ সবই কি মৌলিক ভাবনা ?

প্রশ্নটা যে বিতর্কিত সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল বটে,কিন্তু জিপিদার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জিপিদা হয়ত একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। টেলিফোনে  স্বল্প সময়ের নীরবতা  … তারপর গলাখাকারির শব্দ...জিপিদা বলতে লাগলেন…

“জানিস তো ,ভালো কবিতা যে বেরোচ্ছে না  তা একদম নয়। প্রচুর ভালো ভালো কবিতা  হচ্ছে একালেও । ভালো লাগাটা আপেক্ষিক মানছি। তবে মৌলিক কবিতার সংখ্যা খুব বেশী  কিনা তা নিয়ে অবশ্য আলোচনার অবকাশ আছে।বেশ কিছু কবিতা খুব ভালভাবে পরখ করছি বেশ কিছুদিন ধরে। তা কিছু কবিতা সৃজনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে একটা ধারনা তৈরি করতে পেরেছি।  
আসলে কি জানিস ,আজকাল বেশ কিছু  কবিতা তৈরি হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক প্যাটার্নের  প্রশ্নের অন্তর্গত শূন্যস্থান পূরণের  মত  কিম্বা বলা যায় একত্রিতকরন শিল্পের প্রক্রিয়ার মত। 

খুব আগ্রহ সহকারে বললাম,‘তা একটু গুছিয়ে বল,শুনি… বেশ ইন্টারেস্টিং 
লাগছে …’।

জিপিদা হয়ত উৎসাহ পেলেন…আবার 
শুরু হল…

জীবনানন্দ বলেছিলেন,’সকলেই কবি নন,কেউ কেউ কবি ‘। কিন্তু  সকলে তা মানছে না রে!কবি হতেই হবে! আর এক্ষেত্রে  কবিতা তৈরির গল্পটা সেই একই রকম ।এই একটু আগে যা  বললাম …ঐ শূন্যস্থান পূরণ পদ্ধতি নাহলে একত্রীকরণ পদ্ধতি।তবে প্রযুক্তির ব্যবহার মাস্ট ।

একটা কাল্পনিক উদাহরন দিলে তুই হয়ত বিষয় টা ভালো বুঝতে পারবি …

ধর তুই গুগলে গিয়ে সার্চ করে জীবনানন্দের কবিতা বার করলি … এবার বুক ক্রিকেট খেলার ঢঙে  হয়ত  একটা লাইন  সিলেক্ট করলি …
                                  ‘ তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে ‘
এবার তোকে এই কনসেপ্টে একটা চার লাইনের কবিতা তৈরি করতে হবে ।
এবার তুই  কি করবি…গুগলে গিয়ে লিখে দে ‘মানুষ,  ভালবাসা,কবিতা …’ 
এইরকম একটা কিছু লেখ ,যা কিছু  তোর মনে হবে…
অনেক নামী কবির  কবিতা এল … খুঁজতে খুঁজতে হয়ত তুই সুনীল গাঙ্গুলির ‘ওরে পথিক কেমন কাটল ‘ কবিতা থেকে  দুটো লাইন কপি পেস্ট করলি …
                                     
‘এক জীবনে অনেক সুদূর ,গোটা জীবন সাদা কালায় বোনা
হলুদ ভেবে ধরতে গেলাম ,আগুন আর রক্তভেজা সোনা ।‘

ব্যস ,হয়ে গেল! এবার নিজের ক্ষমতা থাকলে শূন্যস্থান পূরণ করে চতুর্থ লাইন তৈরি কর নাহলে আবার গুগ্লিং করতে থাক।এবার  চলে যাও জীবনানন্দতে …
                                       
‘রণেক্লান্ত নাবিক ঘরে ফিরে আসে যেন অসীম আকাশে’

আর চিন্তা কি … এবার তো  চারলাইনের কবিতা  তৈরিই হয়ে গেল … 

“এক জীবনে অনেক সুদূর,গোটা জীবন সাদা কালায় বোনা
হলুদ ভেবে ধরতে গেলাম ,আগুন আর রক্তভেজা সোনা ।
রণেক্লান্ত নাবিক ঘরে ফিরে আসে যেন অসীম আকাশে’
তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে“। 

এবার গুছিয়ে একটা নাম দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেড়ে  দাও। কে আর পায় তোমায় ! দুশো লাইক আর একাত্তরটা কমেণ্ট তো রেডি হয়ে আছে।কবি তুমি হয়েই গেলে…‘।

কি উত্তর দেব বুঝতে না পেরে মোবাইল ফোনটার  দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে  নিশ্চিত হওয়ার চেস্টা করলাম ,রেকর্ডিং এর বাটন টাতে ক্লিক করেছিলাম তো…!

সাহিত্যিক প্রবীর দে
তুলসীবাগান ,বিরাটী, কোলকাতা -৫১



















0 Comments