📚 সুমিতা চক্রবর্তী🔸বেলুর,হাওড়া🔸
অলস দুপুরে বসে বসে খবরের কাগজের পাতা উল্টে যাচ্ছিলো জয়া, কিছু পড়ছিলো না । কাগজ খুললেই তো একগাদা ধর্ষণের খবর - ভালো লাগেনা জয়ার, খুব কষ্ট হয় । তাই খুব একটা মন দিয়ে খবর পড়েনা জয়া | কিন্তু তবুও একটা খবরে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো । খবর টা ঐ ধর্ষণেরই, কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে ওদের আবাসনের কাছেই। এবার নড়েচড়ে বসল জয়া আর এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল খবরটা - একটা আট বছরের মেয়েকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে সারারাত ধর্ষণ...ভোর রাতে প্রাণহীন দেহটা ফেলে যায় রেল লাইনের ধারে...পুলিশ এসে...আর পড়তে পারেনা জয়া, দুহাতে মুখ ঢাকে। মনের ভেতর থেকে স্মৃতি গুলো বেরিয়ে আসতে থাকে হু হু করে...
আজ একটুর জন্য আটটা পঞ্চাশের ট্রেনটা মিস হয়ে গেছে জয়ার - নির্ঘাত স্কুলে লেট হবে,ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল জয়া। হঠাৎ শুনলো "একটা টাকা দাওনা গো,বড্ডো খিদে পেয়েছে "
- জয়া তাকিয়ে দেখলো একটা আট নয় বছরের মেয়ে ওর কচি হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে জয়ার সামনে।মেয়েটার গায়ে ময়লা ছেড়া ফ্রক,এক মাথা লাল চুলে ঘেরা মুখ খানা ভারী নিষ্পাপ !দেখে কেমন মায়া হলো জয়ার, বলল "এক টাকায় কি পাবি,ওতে কি খিদে মিটবে?"জয়া ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট বার করে দেয় মেয়েটাকে। মুহূর্তে খুশির ঝিলিক খেলে গেলো মেয়েটার চোখে। টাকাটা হাতে মুঠো করেই ছুট লাগালো একরাশ ধুলো উড়িয়ে।
তারপর থেকে রোজ স্টেশন এ এলেই মেয়েটা জয়ার কাছে এসে দাঁড়াতো জয়া দু টাকা, পাঁচ টাকা যাহোক দিতো। জয়া কে রোজই ট্রেন ধরে স্কুল যেতে হয়।ও একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা।একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে মেয়েটার বাড়ি গেলো জয়া । ও শুনেছিলো মেয়েটার নাম চাপা আর ও থাকে ওদেরই আবাসনের কাছে রেল লাইনের ধারে একটা ঝুপড়ি তে, ওর মায়ের সাথে । চাপার মা জয়ার কাছে অনুযোগ করলো " ওর বাপ্ টা মরার পর থেকে লোকের বাড়ি কাজ নিয়েছি, চাপাকে দেখার সময় পাই না। ওকে খিচুড়ি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম, সেখানে যায়না। দিদিমনি, তুমি আমার মেয়েটাকে একটু দেখো " জয়া বলল " চাপা কে আমার ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিও,আমি ওকে পড়াব " জয়া এমনিতে টিউশন করায় না।তবে ওর স্কুলের কিছু গরিব ছেলে মেয়ে পড়তে আসে ওর কাছে বিনা খরচাতে | চাপা ও ওদের সঙ্গে আসতে শুরু করলো।জয়ার শাশুড়ি আপত্তি করেছিল " এসব বস্তির মেয়েকে ঘরে ঢোকানো কেন? "জয়ার স্বামী তন্ময় অবশ্য মায়ের কথায় কোনো উত্তর দেয়নি, নীরবে স্ত্রী কেই সমর্থন করে। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে ওদের কোনো সন্তান আসেনি। আর অফিসের ব্যস্ততায় কতো টুকু বা সময় দিতে পারে জয়াকে।তন্ময় জানে জয়া ওর স্কুল আর নানা পরোপকার নিয়ে ডুবে থাকে। থাকুক না, মনে মনে ভাবে তন্ময়, ওর বেশ গর্ব হয় স্ত্রীকে নিয়ে। অফিসে ও জয়ার কথা বলেছিলো কয়েকজন কে । শুনে একজন কলিগ বলেছিলো "বাহ্ ! এতো ভালো উদ্যোগ,
তোমার স্ত্রী কে বলো আমাদের একটা এনজিও আছে -
ওখানে জয়েন করতে। ওরা দুস্থ মেয়েদের জন্য খুব ভালো কাজ করছে। "
কয়েক মাস বেশ আসছিলো চাপা, অল্প দিনে শিখে ও ফেলেছিল অনেক কিছু। কিন্তু হঠাৎ ই একদিন আসা বন্ধ করে দিল। ওর কোনো খবর না পেয়ে জয়া আর একবার গেছিল ওদের ঝুপড়িতে। দেখলো ওদের ঘরে কেউ নেই । পাশের ঘরে একটা বৌ বলল " দুদিনের জ্বরে হঠাৎ করে চাপার মা মারা গেলো। তারপর থেকে চাপা যেন কেমন হয়ে গেছে - কারোর সাথে কথা বলেনা, সারাদিন কোথায় ঘুরে বেড়ায়। " তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। চাপা কে আর দেখতে পায়নি জয়া। আর স্কুলে পরীক্ষা চলছিল - তাতেই খুব ব্যস্ত ছিল। তাই আর খোঁজ নেওয়া হয়নি চাপার। ধীরে ধীরে চাপার স্মৃতি ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছিল জয়ার মন থেকে। তারপর আজকে চাপার এই খবর পেলো !
রাতে বাড়ি ফিরে তন্ময় জয়া কে বলল " আজকের খবরের কাগজ টা পড়েছো?তোমার চাপা কে..."
জয়া কান্নায় ভেঙে পরে বলল "চাপার মা মারা যাবার পরে যদি আমরা ওকে একটু আগলে রাখতাম !
" তন্ময় সান্তনা দেয় "ওরকম কত চাপাই তো হারিয়ে যায়! " জয়া তাকায় স্বামীর দিকে,বলে "সব চাপা কে হারিয়ে যেতে দেবোনা। তোমার কলিগ যে এনজিও টার কথা বলেছিলো, আমি ওখানে কাজ করবো।তাহলে কিছু চাপাকে তো গাইড করতে পারব।কি তুমি রাজী তো? " তন্ময় জয়ার হাতটা ধরে বলে " তোমার সব ভালো কাজে আমি তোমার পাশেই আছি। "
0 Comments