চন্দন কুমার কুণ্ডু'র ছোটগল্প

 

মাস্টারমশাই 

অনেক কষ্ট করে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে,পরের কাছে বই চেয়ে নিয়ে পড়াশোনা করেছেন অবিনাশবাবু। এখনও সেকথা মনে পড়লে চোখে জল এসে যায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত চাষি ঘরের সন্তানের কাছে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করাটাই ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। ছোটবেলায় যখন পড়তে যেতেন পণ্ডিত মশাই মাঝে মধ্যেই কানমলা দিয়ে বলতেন

--চাষার ঘরের হেলে নাকি পণ্ডিত হবে!

বড় হয়েও এসব ব্যঙ্গ,গ্ৰামীণ টিটকারি গায়ে মাখেন নি অবিনাশ। আগের দিনের বেড়ে যাওয়া বাসি ভাত আলু সেদ্ধ আর পেঁয়াজ, লঙ্কা দিয়ে দিব্বি খেয়ে নিয়ে কয়েক মাইল পথ পায়ে হেঁটে ইস্কুলে পৌঁছাতেন। সেখানেও সব সময় ভাল ব্যবহার পেতেন এমন নয়। কেননা ভাল বুদ্ধি হলে কি হবে, 

--কে কবে শুনেছে যে চাষার ছেলে বিদ্যান হয়েছে! আর হলেই বা কি হবে, এ বিদ্যা চাষের কোন কাজে লাগবে তা ঈশ্বর জানেন। 

কোন কোন  শিক্ষক এমন মতামতই দিতেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অবিনাশের  অসম্ভব জেদের কাছে হার মানতে হয় এহেন সমালোচকদের। 

এন্ট্রান্স পরীক্ষায় স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করে জেলায় সুনাম অর্জন করেন অবিনাশ। পরে কলেজেও সুনামের সঙ্গেই ডিগ্ৰি অর্জন করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় নি তাঁকে। তবে তাঁর পড়াশোনার ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল পারিবারিক অস্বচ্ছলতা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব। সব রকম দুর্গমতাকে জয় করে  আর সমালোচকের মুখে ছাই দিয়ে অবিনাশ গ্ৰামের একজন মান্যগণ্য শিক্ষিত ছেলে হয়ে উঠলেন।

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি, মফঃস্বলের স্কুলে সেকেন্ড মাস্টারের চাকরি পেয়ে গেলেন অবিনাশ। পড়াতে পড়াতে স্কুলই ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠল অবিনাশের। মফঃস্বলের স্কুল মাধ্যমিক থেকে ক্রমে উচ্চ মাধ্যমিক এ উত্তীর্ণ হল। মফঃস্বল ও ক্রমে স্ফিত হয়ে শহরের আকার ধরল। স্কুল-এ ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তা এখন বিশালাকায় মহীরুহ হয়ে উঠেছে। অবিনাশ এখন এলাকায় মাস্টারমশাই নামে পরিচিত।  বিজ্ঞানের ছাত্র অবিনাশ স্কুলে শুধু পড়ান না, কোন বিল্ডিং কোথায় হবে, নতুন কোন সাবজেক্ট খুললে ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা হবে এসব নিয়েই তাঁর দিন কেটে যায়। স্কুলের অর্থকড়ির ব্যাপারে কোন দিনই চোখ কান দেওয়ার মানুষ যে তিনি নন তা কারও অজানা নয়। হেডমাস্টার একটু রগচটা মানুষ হলেও অবিনাশ বাবুকে তিনি শ্রদ্ধা করেই চলেন। স্কুলের ল্যাব তৈরি থেকে নতুন বিষয় শুরু এসব ব্যাপারে সমবয়সী অবিনাশ বাবুর পরামর্শ নেবেনই। স্কুলের প্রত্যেকটি গাছেই যেন অবিনাশবাবুর হাতের ছোঁয়া আছে। আমলকি, জামরুল, আম কিম্বা কৃষ্ণচূড়া অথবা রঙ্গন যখন রঙের বাহার নিয়ে মাথা তোলে তখন অবিনাশের মুখে অদ্ভুত এক খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ে যেন। সহকর্মীরাও তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদে ভরিয়ে দেন তাঁকে।

কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ছেলে মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্ৰহ যেন কমে যাচ্ছে, মনে হয় মাস্টার মশাইয়ের। নেট সর্বস্ব জীবন যাপন আর বড়দের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা নতুন প্রজন্মকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে ভাবেন তিনি। মনে পড়ে তাঁর ছাত্রাবস্থার কথা। পড়া না পারলে গোরু পেটান পেটাতেন শিক্ষকরা। মাথা তুলে কথা বলার উপায় ছিল না। হাই বেঞ্চের নিচে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে পিঠে কিল মারতেন। কান্নার উপায় ছিল না। বাড়িতে জানতে পারলে দ্বিগুন মার জুটত কপালে। সে এক শিক্ষার দিন ছিল। তার অর্থ এই নয় যে স্কুলে দৈহিক শাস্তিদানকে তিনি সমর্থন করেন; কিন্তু তবুও....

এখন মার তো দূরের কথা ছাত্র- ছাত্রীদের বকা ঝকাও নিষেধ। যার সুযোগ নিয়ে কতিপয় ছেলে মেয়ে মাঝে মাঝেই স্কুলে অশান্তির সৃষ্টি করে। পুরানো ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হলে এই সব ভাবনা কোথায় উদাও হয়ে যায় অবিনাশের। হাসতে হাসতে বলেন, 

--সে এক সময় ছিল। ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল দেখার মত, এখন সেসব কোথায় পাবে!

গত বছর স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালিত হয়েছে ঘটা করেই। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র- ছাত্রী, প্রাক্তনী, অভিভাবক দের নিয়ে তিন দিন  অনুষ্ঠান ,খাওয়া - দাওয়া, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বরণ থেকে ছাত্র- ছাত্রীদের পুরস্কার বিতরণী কি ছিল না তাতে। দেশ বিদেশে  সরকারি ,বেসরকারি উচ্চ পদে থাকা স্কুলের উজ্জ্বল  জ্যোতিষ্করা অনুষ্ঠান কে আলোকিত করেছে। প্রায় প্রত্যেকেই পুরানো শিক্ষকদের সঙ্গে অবিনাশ বাবুর পদধূলি নিয়ে আশীর্বাদ চেয়ে নিয়েছে। যদিও অন্যদের চেয়ে অবিনাশবাবুর সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনেক গভীর। অবিনাশবাবুও যেন ভাবতে পারেন নি এত প্রতিভার পরিপূর্ণতায় তার হাতের ছোঁয়া আছে। এত কৃতী গড়ার তিনিও একজন কারিগর, এ অবিশ্বাস্য মনে হয় তাঁর! পুরানো ছাত্র - ছাত্রীদের দেখে তাঁর মনে হয় সত্যি তার ও বয়েস বেড়েছে। সময় হলে মহীরুহও জীর্ণ হয় তাহলে, ভাবেন অবিনাশ । 

মাঝে মাঝে তিনি ভাবেন, কবে থেকে এবং কি ভাবে অবিনাশবাবু থেকে তিনি মাস্টার মশাই হলেন? ঠিক মনে করতে পারেন না। স্কুলে জয়েন করার পর থেকেই শুধু গ্ৰামের নয়,পার্শ্ববর্তী গ্ৰামের ছেলেরাও তাঁর কাছে  চাকরির অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে পড়াশোনা বিষয় আশয় নিয়ে আসতে শুরু করে। তিনি ও খুশি মনে যাকে যতটা সম্ভব সাহায্য করেন ও পরামর্শ দেন। এভাবেই কখন যে তাঁর নামের জায়গায় মাস্টারমশাই বসে গেছে সে খোঁজ নিজেও রাখেন নি। এখন যারা দেখা করতে আসে তারা বেশির ভাগই জীবনে সফল হওয়া প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী। তাদের সফলতায় আপ্লুত হয়ে যান মাস্টার মশাই। 

দেশে করোনার প্রকোপে লকডাউন। সংক্রমনের আশংকায় স্কুল,কলেজ সহ সব রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় তিন-চার মাস বন্ধ। কিন্তু পড়াশোনা থেমে থাকলে চলবে কেন। তাই স্কুলে স্কুলে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস। ভিডিও কলের মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষিকারা ছাত্র ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন। অনেক শিক্ষকের মতই এই অনলাইন ক্লাস নিয়ে মতান্তরে পড়েছেন মাস্টার মশাই। দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে বহু জ্ঞানী গুণী ছাত্র ছাত্রী তৈরী করেছেন তিনি। তাঁর ক্লাস নিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে নিজেও গর্ববোধ করেন আজও। বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থা তাঁর পছন্দ তো নয়ই তিনি এ নিয়ে মাথাও ঘামান না। কিন্তু  প্রায় সব স্কুলেই এইভাবেই পড়াশোনা চলছে, তাঁর স্কুল ও পিছিয়ে নেই। প্রধান শিক্ষক বিশ্বনাথ বাবু ফোন করে মাস্টার  মশাইয়ের আনলাইন ক্লাসের দিন ও সময় বলে দিলেন। 

মাস্টারমশাই অনেক চেষ্টা চরিত্র করে,জুনিয়ার সহকর্মীদের ফোন করে মোটামুটি ক্লাস নেওয়ার জন্য রেডি হলেন। কারও বাড়িতে গিয়ে শিখে আসবেন,বা কাউকে বাড়িতে ডেকে নেবেন করোনার কালে সে যে অসম্ভব। ব্যাঙ্গালোরে থাকা মেয়েকে ফোন করেও শেখার ত্রুটি রাখলেন না। যথারীতি ক্লাসের দিন এসে গেল। একটু নার্ভাস, যেন মনে হল নিজেরই। মোবাইল কানেক্ট করে ক্লাস শুরু করলেন। কিন্ত গলাটা যেন কেঁপে গেল। পাশে রাখা জলের গ্লাস থেকে জল খেলেন ঢক ঢক করে। ছাত্র ছাত্রীরা বোধ হয় শিক্ষকের পালস্ ভালো বুঝতে পারে। দু- একজন বেয়াড়া ছাত্র হেসে উঠল। মাস্টার মশাই পড়াতে শুরু করলেন। আটান্ন বছর বয়সের ভার তার সঙ্গে যান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনভ্যস্ত মাস্টারমশাই। হাতে লেগে মোবাইলটা ছিটকে গেল। তিনি আবার কানেক্ট করলেন। আর তখনই অশ্লীল কয়েকটা শব্দ বিষাক্ত তীরের মত তাঁর এত দিনের বিশ্বাস, শিক্ষা, স্নেহকে ফালা ফালা করে দিল। অপর প্রান্ত থেকে তখন চলেছে ভেংচি, ব্যঙ্গ আর গালিগালাজ। মাস্টারমশাই চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। দুহাতের তালুতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন।পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন তাঁর স্ত্রী।

মাসখানেক পরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্কুল খোলার বিজ্ঞপ্তি জারি হল। ৫ সেপ্টেম্বর, দীর্ঘ কয়েকমাস পর ছাত্র ছাত্রী ,শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষক- শিক্ষিকারা স্কুলে এলেন। এতদিন পর স্কুলে আসায় সকলের মনেই অদ্ভূত একটা আনন্দ, যেন তারা যুদ্ধ জয় করতে পেরেছে এমন মনোভাব। প্রেয়ার লাইনে দাঁড়াল ছাত্র ছাত্রীরা। বাকিরা তাদের সামনে। প্রধান শিক্ষক আজ কি বার্তা দেন তা শোনার জন্য সকলে উৎসুক। প্রধান শিক্ষক সকলের সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়ালেন‌। পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ সামনে মেলে ধরে ইংরেজিতে লেখা ছোট একটি চিঠি  পড়লেন। সকলের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জানালেন ,

--মাস্টার মশাই চাকরিতে রিজাইন্ দিয়েছেন।


গল্পকার চন্দন কুমার কুণ্ডু
তেঁতুলমুড়ি, বাঁকুড়া 













0 Comments