দীপক বেরার ছোটগল্প


সোমনাথ ও স্বাধীনতা

কয়েকদিন বাদেই "স্বাধীনতা দিবস"। পাড়ায় চায়ের দোকানে বসে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের দলীয় কর্মসূচির কিছু পোস্টারে চোখ চলে যায় সোমনাথের। আচ্ছা, স্বাধীনতা মানে কি? শুধু কি ব্রিটিশ কে দেশ থেকে তাড়ানো? স্বাধীনতা মানে কি, ক্ষমতায়নের হস্তান্তর, শাসক অর্থাৎ, শোষকের হাতবদল? দিনের বেলায় ভালমানুষের মুখোশ পরে অভিনয় করা, আর রাতের বেলায় পিশাচের দাঁত নখ বার করে রক্ত শোষণ করা? নিবারণদা'র চায়ের দোকানে বসে এইসব নানারকমের কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল সোমনাথের। ক'দিন ধরেই সোমনাথের মন মেজাজ ভাল নেই। কেমন যেন একটু চুপচাপ মনমরা হয়ে আছে। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, আর বোন। বাবা কলেজে পড়ার সময় হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা যান। বিধবা মায়ের পেনশনের টাকায় কোনরকম চলে যায়। মায়েরও বয়স হয়েছে, মা আর ক'দিন? বোনটার বিয়ে দিতে হবে, নিজে বেকার, চাকরি নেই। ভাইবোন মিলে কয়েকটা টিউশনি করে। এমনিতেই এইসব নানান চিন্তা সোমনাথ কে কুরে কুরে খায়। তারপর, ক'দিন আগে হঠাৎ নাড়ুদা তাকে রাস্তায় ডেকে তাদের ভাঙা বাড়ি সহ জমি টা বিক্রি করার কথা বলেছিল। নাড়ুদা তার জায়গাটা তে প্রমোটিং করতে চায়। সোমনাথ রাজি হয় নি। পূর্বপুরুষ এর স্মৃতি সে কিছুতেই হারাতে চায় না। নাড়ুদা তাকে অপমান করে এবং শাসায়। বলে, "শালা পূব্বপুরুষের সিঁতি মারাচ্ছিস? শালা কান খুলে শুনে রাখ, যদি ভালোয় ভালোয় রাজি না হোস তো, একটা পয়সা তো পাবিই না, উল্টে জমিটাও দখল হয়ে যাবে। আর কী ভাবে সেটা করতে হয় তা আমার ভালো করেই জানা আছে।" সেদিন সোমনাথ চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে এসেছিল। সেই থেকে সোমনাথ ভীষণ চিন্তায় রয়েছে। 


নাড়ুদা ওরফে নাড়ু হালদার। এলাকার দাদা নাড়ু মাস্তান। স্থানীয় এম এল এ শৈলজা সেন এর ডান হাত। এলাকার সবাই সমীহ করে চলে। শৈলজা বাবু যে গুন্ডার দল পোষে, নাড়ু তার লিডার। শাসক দলের ছত্রছায়ায় থেকে এলাকায় উপদ্রব করে চলেছে দিনের পর দিন নির্বিবাদে। পাড়ার মেয়েদের রাস্তায় বেরনো দায় হয়ে পড়েছে, এমনকি বৌদেরও বাদ দেয় না। তবুও পাড়ার সবাই নির্বিকার! 
আসলে, সবার তো প্রাণের দায় আছে? প্রাণ যে সবার কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ! কেউ বিরুদ্ধে গেলেই বা কিছু ঝামেলা করলেই তার গলার নলি কেটে গুম করে দেওয়া নাড়ু হালদারের বাঁ হাতের খেল। 
নাড়ু হালদারের সিন্ডিকেট ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। জলের দরে দুর্বলের কাছ থেকে জমি জায়গা লিখিয়ে নেওয়া আকছার চলে। কেউ রাজি না হলে তার যুবতী মেয়েকে ধর্ষণ, কিংবা 
তাকে খুনের হুমকি দিয়ে কাজ হাসিল করা এই এলাকার নিত্য ঘটনা। সবাই চোখ কান বন্ধ করে থাকে। এটাই এখানকার নিয়ম বা ভবিতব্য বলে সবাই মেনে নিয়েছে।
সোমনাথও খুবই সাদাসিধে গোবেচারা ছেলে। সাতেপাঁচে থাকে না। গ্র্যাজুয়েশন করে চাকরির সন্ধানে আছে, আর টিউশনি তো রয়েছেই।
অনেকবার নাড়ুদা তাকে চাকরির টোপ দিয়েছে, বিনিময়ে জায়গাটা চেয়েছে। কিন্তু, সোমনাথ কিছুতেই রাজি হয়নি।

ইদানিং করোনা আবহে সবারই ব্যবসাপত্র লাটে উঠেছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। তার প্রভাব সমাজের সর্বত্র। নাড়ু হালদারও যে এসময় একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। এখন লকডাউন ওঠার পর নাড়ু গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। 
 
আজ ১৪ই আগস্ট সকাল সকাল এক সাগরেদ কে দিয়ে সোমনাথ কে তার ডেরায় ডেকে পাঠায়। সোমনাথের পুরোনো ভয়টা চাগাড় দিয়ে ওঠে।
সোমনাথ বেলা দশটা নাগাদ নাড়ুর ডেরাতে যায়। ডেরা মানে ওর গুন্ডাবাহিনীর মদের ঠেক। পাড়ার সবাই জানে। সোমনাথ যেতেই নাড়ুদা এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, "কিরে সোমু কী সিদ্ধান্ত নিলি?" সোমনাথ বলে, "নাড়ুদা আমি তো আগেই বলেছি, ওটা আমার বাপ ঠাকুর্দার স্মৃতি, ওটা আমি বিক্রি করতে পারবো না।" নাড়ুদা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, "এটাই তোর শেষ কথা?" সোমনাথ বলে, আমি এই কাজটা কিছুতেই পারবো না, নাড়ুদা। আমাকে তুমি ক্ষমা করো।" 
"ঠিক আছে শালা! তুই বাড়ি যা। সোজা আঙুলে ঘি টা উঠলোনা তো? এবারে আঙুল টা বেঁকাতে হবে, তখন টের পাবি", নাড়ু হালদার বলে।
ফিরতি পথে নিবারণদা'র চায়ের দোকানে অনেকক্ষণ বসেছিল সোমনাথ। স্বাধীনতা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন ওর মনে উঁকি দিচ্ছিল। মনে মনে এখনও ভেবে চলে, "এই আমাদের স্বাধীন ভারতবর্ষ!"
সোমনাথ অনেক বেলায় বাড়ি ফেরে। মা বোন খুব চিন্তায় ছিল। বোন বলে," কি রে দাদা, এত দেরি হলো? কী বলল নাড়ুদা?" সোমনাথ চুপচাপ থাকে, মা বোন কে এড়িয়ে যায় কথাটা। সোমনাথের যেন সময় কাটতে চায় না।
আজ রাতে ঘুম আসে না সোমনাথের। নাড়ুদার কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঘড়িতে চোখ রাখে সোমনাথ। রাত দেড়টা বাজে। কিছুতেই ঘুম আসে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ হচ্ছে। হঠাৎ, দরজায় দুমদাম ধাক্কা! বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে ওঠে সোমনাথের! "এ্যায় শালা সোমু দরজা খোল, না হলে ভেঙে ফেলবো দরজা।" নাড়ুদার গলা, সোমনাথ বুঝতে পারে। তবুও সোমনাথ দরজা খোলেনা। মা বোন ইতিমধ্যেই উঠে পড়েছে। সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে! ওদিকে দরজায় ধাক্কাধাক্কি বেড়েই চলছে, তার সাথে গালাগাল। "শালা শুয়োরের বাচ্চা, দরজা খুলবিনা তো? দেখাচ্ছি মজা!" বলতে বলতেই ওরা চারপাঁচ জন দরজা ভেঙেই ঢুকে পড়ে। সবার হাতেই মদের বোতল। সবাই মদে চুর, আর মুখে অকথ্য গালাগাল! সোমনাথ কে দু'জনে জাপটে ধরে। নাড়ুদা সোমনাথের বোনের দিকে এগিয়ে যায়। ওর মা বাধা দিতে গেলে ওনাকে সপাটে এক লাথি মারে। চিৎকার করে বৃদ্ধা মা দূরে ছিটকে পড়ে যায়। কোমরে চোট পেয়ে ওঠার ক্ষমতা হারান। হাঁউমাউ করে চিৎকার করে চলেছেন। "ছেড়ে দাও ওকে, তোমরা আমার মেয়েটার সর্বনাশ কোরো না, বাবা।" মুহূর্তের মধ্যে সোমনাথের বোনের ওপর নাড়ু ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখ চেপে ধরে ওকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। সোমনাথের দু'চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সোমনাথের সমস্ত সহ্যের বাঁধ যেন ভেঙে যায়। হঠাৎ একটা মদের বোতল হাতে তুলে নেয়। দেওয়ালে ঠুকে বোতল টা ভেঙে ফেলে। সোমনাথের শরীরে যেন আজ অসুরের শক্তি! নাড়ুর দুটো সাগরেদ সোমনাথকে ধরতে এগিয়ে আসে। এক ঝটকায় দুটো কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক লাফে নাড়ুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাথায় সজোরে বসিয়ে দেয় ভাঙা বোতল! মুহূর্তে নাড়ু গোঙাতে গোঙাতে নিথর হয়ে যায়। গোটা ঘর রক্তে ভেসে যায়। ঘটনার এই আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে সাগরেদগুলো যে যেদিকে পারে দৌড়ে পালায়।

ভোরের আলো ফোটে। পাড়ায় জানাজানি হয়ে যায়। পাড়াশুদ্ধু লোকেদের ভিড় জমে যায়। সোমনাথ ঘরের এক কোণে বসেছিলো। সবাই লক্ষ্য করে সোমনাথের চোখে মুখে কোনও রকম চিন্তার লেশমাত্র নেই, বরং এক উজ্জ্বল দীপ্তি!
আজকের এই ঘটনার জন্য সোমনাথের হয় তো ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। কিন্তু তাতে সে এতটুকুও বিচলিত নয়। 

নাড়ু হালদার এর মতো সমাজবিরোধীদের অভাব নেই আজকের এই সমাজে। শুধুমাত্র প্রতিবাদহীন এই সমাজ ব্যবস্থায় ওরা বংশবিস্তার করে যায় নির্বিবাদে। সোমনাথের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখে যদি সমাজে একটাও বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা হতে পারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ মুখর জনগোষ্ঠী তৈরি হতে পারে, তবে সমাজের বুক থেকে নাড়ু 
হালদার এর মতো আগাছা সমূলে উৎপাটিত হবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 

আজ ১৫ই আগস্ট, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস। পাড়ার কচিকাঁচাদের সঙ্গে বড়োরাও সামিল হয়েছেন পতাকা উত্তোলন করতে। দূর থেকে ভেসে আসছে জাতীয় সঙ্গীত,বন্দেমাতরম ধ্বনি। 

আজ,পাড়ার লোকেরা আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীন। পাড়ায় আজ পালিত হবে সত্যিকারের "স্বাধীনতা দিবস"। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও ভারতবাসীরা এই সমাজে সত্যিকারের সর্বার্থে স্বাধীন হতে পারেনি। সোমনাথকেও বলা যায় আমাদের এই দুর্বৃত্তায়নের সমাজে মেরুদণ্ড সোজা করে জিরাফের মাথা উঁচু করা এক পরাক্রমশালী যোদ্ধা, সত্যিকারের এক বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী!

গল্পকার দীপক বেরা
হরিদেবপুর, টালিগঞ্জ, কলকাতা 

























0 Comments