চয়ন কুমার রায়ের ছোটগল্প




"এক সিনেমাপ্রেমীর স্মৃতিকথা"


চন্দ্রভূষণবাবুর মধ্যম পুত্র সৌরাশিষ বড্ড একবগ্গা। তাকে সামলাতে মা-বাবাকে জোর হিমসিম খেতে হত। লোকে বলে, মেজো ছেলেরা একটু গোঁয়ার গোবিন্দ গোছের হয় ।ছেলেকে বাগে আনতে শাসনের পাশাপাশি এই সন্তানটির প্রতি মনের গভীরে একটা বিশেষ স্নেহরসের ফল্গুধারা নিঃশব্দে বয়ে যেত। এর মধ্যে একটা মনোবিজ্ঞান নিশ্চয়ই কাজ করে। না, এখনকার কথা নয় ।সৌরাশিষ এখন সত্তর ছুঁইছুঁই। বর্তমান কালের এক বা দুই সন্তানের জনক -জননীর পক্ষে এই অনুভূতির মাধুর্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। 
সৌরাশিষের ছোট থেকেই সিনেমাপ্রীতি প্রবল। গ্রামের ছেলে। মাত্র দ‌শবছর বয়সে একটা তথ্যচিত্র দেখেই সিনেমার প্রেমে পড়ে। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই ঊনিশ পয়সা জোগাড় করে সিনেমা হলের দিকে ছুটত। অবশ্য সেকালে ছোটদের হাতে টাকা দূর অস্ত, পয়সাও তেমন কেউ একটা দিত না। সেটা শহরের কোন আত্মীয় বাড়ি গেলেই সম্ভব হত। কারণ সেখানে তো বাবার কঠোর শৃঙ্খলার আওতায় থাকতে  হত না । 
সেযুগে গ্রাম ও শহরের মধ্যে দ্রুতগতির মোটর, বাস ইত্যাদি যানবাহনের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিলনা বললে অত্যুক্তি হয় না। বড়জোর কয়েকজনের এক -আধটা বাই সাইকেল ছিল। কাজেই শহরে যেতে হলে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার হাঁটা অথবা গো-যান ছিল ভরসা। 
সৌরাশিষ আর তার বন্ধুদের কাছে এটা এমন কোন দুরূহ বাধা ছিল না। ওর বয়স তখন চৌদ্দ। অ্যানুয়্যাল পরীক্ষা শেষ। চারবন্ধু পরিকল্পনা করল, বিষ্ণুপুরে সিনেমা দেখতে যাবে। সৌরাশিষ লুকোচুরির ধার ধারতো না। সকালেই ঘোঁতঘোঁত করে বাবাকে তাদের পরিকল্পনার কথা সবিশেষ জানিয়ে দিল। চন্দ্রভূষণবাবুও এককথায় তার আবেদন, না তার আগ্রহে জল ঢেলে দিলেন। 
'কে কে যাবে? কীভাবে যাবে? '
বন্ধুদের নাম জানিয়ে বলে, 'ট্রেনে যাবো। '
বাড়ি থেকে স্টেশন ছ'কিলোমিটার দূরে। 
'শীতের রাতে থাকবে কোথায়? ',
সৌরাশিষ বিজ্ঞের মতো বলে, 'সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। '
চন্দ্রভূষণ হাসি চেপে গম্ভীর গলায় বিচারকের রায় দেবার মত বলেন, 'যাওয়া হবে না। '
'আমি যাবোই। '
'কেমন করে যাও দেখি। ' বলেই টেনে নিয়ে গিয়ে ওপরের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। অফিসে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে গেলেন, 'আমি না ফেরা পর্যন্ত কেউ দরজা খুলবে না। '
সেদিন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরলেন। স্ত্রী কে জিজ্ঞাসা করলেন, 'খেতে দিয়েছিলে? '
তাঁর স্ত্রী উদাস কণ্ঠে বলেন, 'কাকে খেতে দেব! '
'কেন, কি  হয়েছে? '
'যাও, ওপরে গিয়ে দেখে এসো। '
দ্রুত ওপরে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। দরজার হুড়কো দিয়ে জানালার একটা রড বাঁকানো। জানালার নীচে প্রতিবেশীর গোয়ালের খড়ের চাল। চন্দ্রভূষণণের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকলো না। 
চারবন্ধু সিনেমা দেখে, একটা হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে স্টেশনে এসে হাজির হলো। ডিসেম্বর মাসের রাত। হুহু করে সূচ ফোটানো হিলহিলে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। শীতের পোশাক বলতে- গায়ে একটা সোয়েটার আর বাঁকুড়ার গুলিসূতোর চাদর। সারারাত প্লাটফর্মের কুলিদের সঙ্গে আগুন পোহায় ওরা। ভোরে ট্রেন। সবার পকেট হাতড়ে দুটো হাফ টিকিটের পয়সা জোগাড় হলো। 
ট্রেনে উঠেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্পে জমে গেল সৌরাশিষ। অল্পসময়ের মধ্যে টিকিট চেকার এসে সৌরাশিষের কাছে টিকিট চাইতেই দুটো হাফ টিকিট ধরিয়ে দিল। টিকিট চেকার অবাক হয়ে বললেন, 'একি  তোমরা চারজন, অথচ দুটো হাফ টিকিট! তোমাদের হাফ টিকিটের বয়স‌ও তো পার হয়ে গেছে বাপধন। '
সৌরাশিষ স্মার্টলি বলে, 'দেখুন কাকু, আমাদের টিকিট কেনার টাকা ছিল না। রেল কম্পানিকে ফাঁকি দেবনা বলেই দুটো হাফ টিকিট কেটেছি। তা না হলে তো আমরা উইদাউট টিকিটেই যেতে পারতাম। '
'তাই নাকি! এতটুকু ছেলে, মুখে তো খ‌ই ফুটছে। রেল কম্পানিকে ফাঁকি তো তোমরা দিয়েছ‌ই। সেজন্য রেল পুলিশের হাতেই তুলে দেব। '
পাশের ভদ্রলোকটি এতক্ষণ রগড় দেখছিলেন। এবার টিটি'র কথায় বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন 'কী হচ্ছে ম‌শাই! কটা ভদ্রলোকের বাড়ির বাচ্চা ছেলে, পয়সা নেই বলে টিকিট কাটতে পারেনি। তাই বলে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন! ফাইনের টাকাটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। কত দিতে হবে বলুন? '
টিটি গজগজ করতে করতে বলে ,'তার দরকার নেই। ওদের বলুন, ভবিষ্যতে এমন কাজ করলে বিপদে পড়বে। '
ওরা চারজন ফটাফট ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রনামটা সেরে ফেললে। 
তারপর বাড়ি ফেরার পর কী ধরনের অভ্যর্থনা পেয়েছিল সেটা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। তবে কোন প্রকার শাসন‌ই সৌরাশিষকে সিনেমাপ্রীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। এই বয়সেও মাঝেমাঝে তাকে সিনেমা হলে দেখতে পাওয়া যায়।

গল্পকার চয়ন কুমার রায় 
                        টিকরহাট, পূর্ব বর্ধমান 

0 Comments