ঋভু চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি আখ্যান




         "নিষিদ্ধ টুকটাক"

সিনেমা বিশেষ করে নিষিদ্ধ সিনেমার প্রতি মানুষের আগ্রহ অপরিসীম।এই সিনেমা দেখার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার উপর ছোট ছোট কিছু অণু আলেখ্য লেখা হল।অনেকেই এর মধ্যে নিজেদেরও অভিজ্ঞতা খুঁজে পাবেন।বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ সবগুলিই শোনা কথার, ‘আমি’ একটা প্রকাশের মাধ্যম মাত্র ভিত্তিতে লেখা।

অণু আলেখ্য ১  

আমাদের স্কুল ছিল ঠিক টাউনশিপের মাঝখানে।স্টেশন ও বাজার দুটোর দূরত্বই প্রায় সমান।তবে বয়েস স্কুলের উঁচুক্লাসের ছেলেদের আড্ডা মারবার জায়গা ছিল শহরের প্রাণ কেন্দ্র সিটিসেন্টার।তখন ঘরে ঘরে এতটা কেবল টিভি বা স্মার্ট ফোন বা ওটিটি মাধ্যমের উৎপাত ছিল না।শহরটাতে এতো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলও গজিয়ে ওঠেনি। ভালো ছেলে মেয়েরা অনেকেই বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করত। স্কুলে স্যার বা ম্যাডামরা দোষ করলে ছাত্র ছাত্রীদের রীতিমত লাঠিপেটা করতেন।স্বাভাবিক ভাবেই আমরাও খুব ভয় পেতাম।সিটিসেন্টারে দুটি সিনেমা হল ছিল।একটির নাম আলো, আরেকটির ছায়া।আলো সিনেমা হলটিতে পারিবারিক সিনেমা দেখানো হলেও ছায়া সিনেমা হলটিতে যে যে সিনেমা দেখানো হত তাদের পোস্টারে একটি ‘এ’ ছাপ থাকত। আর এই ছাপটিই আমাদের স্কুলের ছাত্রদের এক্কেবারে টেনে নিয়ে যেত।হেডস্যার প্রতিদিন নিয়ম করে প্রার্থনার সময় সবাইকে সতর্ক করলেও উঁচু ক্লাসের ছেলেরা কোন কান করত না।এমনকি সিনেমা হলের কোন এক কর্মীর সাথে  হেডস্যারের গোপন বোঝাপড়াও কোন কিছুতেই রাশ টানতে পারে নি।আমরা যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন ক্লাস টুয়েলভে তিনজন দাদা পড়ত যাদের অত্যাচারে স্কুলের সব স্যাররাই প্রায়ই অতিষ্ঠ থাকতেন।টুয়েলভে পড়লেও প্রায় ঐ তিনজন দাদাকে স্কুলের প্রার্থনার মাঠে কান ধরে হয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম অথবা কোন স্যারের হাতে মার খেতে দেখতাম।স্কুলে তিন জন স্যার ছিলেন, একজন ডি.ডি, একজন  জি.কে, আরেকজন পি.পি।এই তিনজন স্যারকে দেখতাম পালা করে ঐ তিন দাদাকে পেটাচ্ছেন।একদিন পূজার ছুটির আগে টিফিনের পর দেখলাম তিনজন স্যার ঐ তিন দাদাকে প্রার্থনার মাঠে দাঁড় করিয়ে খুব মারছেন।শুনলাম তিনজনের গার্ডিয়ান কল হয়েছে।সেদিন স্কুল খুব থমথমে ছিল।আমরা ক্লাসের মধ্যে ভয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারছিলাম না।কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারিনি।পরে শুনলাম তিনজন দাদা ঐ  ‘ছায়া’ সিনেমা হলে নিষিদ্ধ সিনেমা দেখতে গেছিল।হাফ টাইমে দেখে সামনে সিটে আমাদের স্কুলের ডিডি, পিপি ও জিকে তিনজন স্যারও বসে আছেন।এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। সিনেমা হল থেকে বেরোবার সময় একটা দাদা কোন এক স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,‘স্যার ভালো আছেন?’ বাকিটা ইতিহাস।

অণু আলেখ্য ২ 

সেই উনিশশো ছিয়াশি সাতাশি সাল।পাড়ায় পাড়ায় তখন ভিডিওর খুব রমরমা। হিন্দি বা বাংলা সিনেমা হল ছাড়াও ক্যাসেডের মাধ্যমে পাড়ায় পাড়ায় সিনেমা দেখানো হত।সেখানে দুপুরের দিকে এমনি নতুন হিন্দি বা বাংলা সিনেমা দেখানো হলেও রাতের দিকে সেই নিষিদ্ধ সিনেমা দেখানো হত কোন কোন দিন আবার দিনের বেলাতেও ঐ সব সিনেমা দেখাত।তখন গ্রামে থাকি, ক্লাস টু’তে।পাড়ায় একটি ভিডিও হল ছিল, আমরা সবাই বলতাম চঞ্চলদার ভিডিও হল। যদিও চঞ্চলদা সম্পর্কে আমার কাকা হতেন।প্রায় দিন শুনতাম চঞ্চলদার ভিডিও হলে পুলিশ এসেছে। বুঝতাম না ভিডিও হলে পুলিশ কেন আসবে? শীতকালের এক রবিবারে দুপুরের দিকে আমাদের খামার বাড়িতে বন্ধুদের সাথে খেলছি এমন সময় দেখি একটা কাকার বয়সি লোক খামারের পাঁচিল ডিঙিয়ে খামারের ভিতর ঢুকে পড়লেন।প্রথমে আমরাও একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম। কিছু সময় পরেই ভদ্রলোক নিজেই জানালেন, ‘ভয়ের কিছু নেই।পুলিশের তাড়া খেয়ে এখানে ঢুকে পড়েছি।’
–পুলিশের তাড়া! চোর নাকি?
আমাদের মধ্যে একটু যারা বয়সে বড় ছিল তারা জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক বললেন,‘না না আমি এই গ্রামের চাষা পাড়ার জামাই।’
কাদের জামাই সেটাও বললেন। কিন্তু তখন যেহেতু সবার কাছে ফোন ছিল না, তাই কোন কথাই যাচাই করা যায় নি।পরে শুনলাম এই জামাই বাবাজি নাকি  চঞ্চলের ভিডিও হলে আরো অনেকের সাথে নিষিদ্ধ সিনেমা দেখতে ঢুকেছিলেন।কেউ পুলিশকে খবর দিয়ে দিলে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু সেরকম কিছু না চেনার জন্য আচমকা আমাদের খামারের মধ্যে চলে আসেন।ও বলতে ভুলে গেছি,‘আমরা যাতে এই সব ঘটনা কাউকে না বলি তার ঘুষ হিসাবে ভদ্রলোক সেদিন আমাদের সবাইকে পাশের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাইয়েছিলেন।’ 

অণু আলেখ্য ৩

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। নিজেদেরর গ্রাম ছেড়ে এক বছর আগে থেকে বাবার চাকরি সূত্রে টাউনশিপে থাকতে শুরু করেছি।নিজেদের বাড়িতে দুর্গা ও কালি পূজা। প্রতি বছর পুজার অন্তত সাত দিন আগে থেকে বাড়িতে থাকতে হত।আমাদের নিজেদের একটা ঘর থাকলেও একটা কাকার ঘরেই উঠতাম,ও খাবার খেতাম। কাকার এক ছেলে ছিল।আমি ক্লাস সেভেন আর কাকার ছেলে ক্লাস এলেভেনে পড়ত। কিন্তু কোন কারণে আমাদের মধ্যে সেই অর্থে কোন বন্ধুত্ব ছিল না।সেই রকম বাড়ি গেছি, ঘটনা চক্রে সেইদিন কাকার শ্বশুর বাড়ি থেকেও কারা যেন এসেছিল। বাধ্য হয়ে সেদিন দাদার ঘরে শুতে হয়েছিল। দাদা কিন্তু ব্যাপারটাতে খুব একটা খুশি ছিল না। বার বার বিভিন্ন রকমের বাহানা করে আমি যাতে না শুই তার আপ্রাণ ব্যবস্থা করবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু প্রতিবার কাকিমার কাছে বকানি খাচ্ছিল।শেষ কালে দাদা কিছু না পেয়ে বলে উঠল,‘ঠিক আছে শুবি কিন্তু একটা কথা বলি রাতে আমি ভূতের সিনেমা দেখি, ভয় পেলে কিছু বলবি না।’
-ভয় পাবো কেন আমি তো সিনেমা দেখবোই না। আমি উত্তর দিলাম। রাতে ভূতের ভয়ে আগে আগেই শুয়ে ঘুমিয়ে গেলাম ।
হঠাৎ মাঝ রাতে কাকিমার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি আমি যে বিছানাতে শুয়ে ছিলাম তার চারদিকে বড় বড় চাদর ঝোলানো রয়েছে।আমার ঘুম ভেঙে যাওয়া দেখে কাকিমা মাঝ রাতেই বলে,‘তুই আমার কাছেই শুবি চল।’ আমি কিছু না বুঝে গুটি গুটি পায়ে কাকিমার কাছেই চলে যাই। কয়েকবছর পরে আমার সাথে দাদার বন্ধুত্ব হলে সেই রাতের ঘটনা জানতে পারি। দাদা আমার বিছানার চারদিকে বড় চাদর টাঙিয়ে নিষিদ্ধ সিনেমা দেখছিল। হঠাৎ মাঝ রাতে বড় বাইরে পেয়ে যায়। টিভিটা কোন রকমে বন্ধ করেই বাথরুমে চলে যায়। ইতিমধ্যে কোন কারণে কাকিমারও ঘুম ভেঙে যায়। দাদার ঘরে ঢুকে ওরকম ভাবে বিছানার চারদিকে চাদর ঝোলানো দেখে চমকে ওঠে। কিছু একটা  বুঝে সোজা টিভি চালায়।তারপর বাকিটা এক্কেবারে ভূগোল হয়ে যায়। সে যাত্রায় আমি শুধু মাত্র ঘুমিয়ে থাকবার জন্যেই একটা বড় কলঙ্ক থেকে বেঁচে যাই।

        গল্পকার ঋভু চট্টোপাধ্যায় 
                              দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান 


0 Comments