সিনেম্যাটিক ম্যাজিকের বালিকা



"সিনেম্যাটিক ম্যাজিকের বালিকা"

আরে ওই, ওই কথাটা'ই বলছিলাম আর কী! ওই ধরুন গিয়ে বাড়ি'তে প্রথম টিভি, সে নয় নয় ক'রে মাধ্যমিকের আগে কোনো গপ্পো'ই নেই। পাশেই ছোটদাদু'র বাড়ি, মানে ঠাকুর্দা'র ভাই, তার বাড়িতে কালার টিভি! ওখানেই রামায়ণ, মহাভারতের হাতে-খড়ি, টিভি-সিরিয়াল আর কী ! 
শনিবার বিকালে বাংলা আর রোববার হিন্দি ফিল্ম। আর বুধবার সন্ধ্যেয় হতো চিত্রহার, হিন্দি ফিল্মে'র গান। পড়তে বসে সেকী কষ্ট মাইরি! তখন কিন্তু ফিল্ম রিলিজ করলো আর ধাঁ করে দিয়ে দিলো টিভি'তে, অমনি হতো না। স্টেশন বাজারে ভিডিও হল ছিলো একখানা, কি পোস্টার বাওয়া, দরমা'র দরজা হ'লে কী হয়!পোস্টারে'র চোটে পয়সা উঠে যেত মালিকে'র। 
তা যা বলছিলাম, আমাদের মানে ছোটোদের এসব দেখা'র কোন পারমিশন ছিল না, রামায়ণ মহাভারত বড়জোর টিপু সুলতান, ব্যস, কোটা শেষ, তাই ফিল্মের ওপর এক অদম্য টান অনুভব করতাম। ভিডিও হলে সিনেমা দেখা'র ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না, পড়া ছেড়ে উঠে দুদিন একটু চিত্রহারে'র দিকে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম বলে বাবা উঠোনের একধারে জড়ো করে রাখা বাখড়া দিয়ে বেদম পিটিয়েছিল। তবু,দখিনা বাতাস তো বয়েছে, মনও উচাটন, যত রঙিন ছবি, খবরে'র কাগজ থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে জড়ো করেছি জীবনবিজ্ঞান বইয়ের ভাঁজে। আজ ভাবি ওই ব্যাঙে'র পৌষ্টিকতন্ত্র, আর মেন্ডেলের পর্যায়-সারনী'র থেকে আরও জ্যান্ত অনুভূতি অপেক্ষা করেছিল জীবনভর, সেদিন বুঝিনি। 'ম্যায়নে পেয়ার কিয়া' রিলিজ করেছে কিছুদিন আগেই, সলমন খান আর ভাগ্যশ্রী'র নিষ্পাপ এ্যাডোলেসেন্ট প্রেম, আন-এ্যাডাল্টারেটেড ফর্মে। পাড়া'র বিয়েবাড়ি, ছাদ্দ বাড়ি, ঘেঁটুপুজো মায় গুড়-পরবে অবধি বাজতে লাগলো "কবুতর যা যা যা..."  মনে'র কবুতর ততদিনে ডানা মেলেছে,এদিক-ওদিক, নেহাত বাড়িতে মার খাওয়ার ভয়ে, ভিডিওহলে'র দিকে করুণ চোখে তাকালে'ও, সাহস ক'রে যেতে পারিনি। সলমন খানের সেই বিখ্যাত গীটার হাতে ছবি দেখলেই, আহাহাহাহাহা...ভাগ্যশ্রী মনে হচ্ছে নিজেকে, যদিও তখনও বয়কাট, ঠাকুর'দার কড়া হুকুম চুল ছোট রাখতে হবে, অন্তত মাধ্যমিক অবধি। মানে চুলে সময় দেয়া যাবে না আর কী ! নারকেল তেল মেখে স্নান ক'রে বাঁদিকে সিঁথি কাটা মেয়েও তখন শ্যাম্পু করে করে চোখ লাল ক'রে ফেলেছে, ভাগ্যশ্রী এফেক্ট। সে'বার  সরস্বতীপুজোয় একখানা হলুদ শাড়ি পরে,ব্লাউজে অজস্র খাটো করা'র সেলাই, যত্রতত্র সেফটিপিন, সেই মাারকাটারি "...দিল দিবানা, বিন সজনা'সে মানে না ',কিন্তু মানাতে হচ্ছে জোর করে, ভালোলাগে !? 
কারণে-অকারণে তখন খোলা জানলা, বিকেল-বেলা'র ছাদ যেন রূপকথা, আর আমি সেই ভাগ্যশ্রী, অকাতরে প্রেমে পড়ে যাচ্ছি তখন, খোলা ছাদ, নীল আকাশ, চাঁদে'র রাত, নাম-না-জানা কোনো জংলীফুল, এমনকি কোনোদিন দেখা না হওয়া যুবকের সাথেও। বুকে'র মাঝে কেউ যেন হ্যান্ড-শাওয়ারে জল ছেটাচ্ছে, এমন শিরশিরানি। সবচেয়ে বেখেয়াল আমি'র ও সেকি পাগল-পাগল অবস্থা।তবু ফিল্ম'টা পুরো দেখিনি তখন, সেরকম এক রোববার, কালীপূজো'র দিন, বিকালে জমজমাট টিভি শো। কালীপূজো'য় এমনিতেই নিয়ম কিছু'টা শিথিল, অত কড়াকড়ি নেই, আমি সেই যে হাঁ ক'রে গিলতে আরম্ভ করলাম, এ্যড পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে গেলো। শেষ হওয়ার পরও ঘোর রয়ে গেলো। রাতে খেতে ব'সে খাওয়া'য় মন নেই, ফুরফুর করছে সারা শরীর, হাল্কা, পালকে'র মত! এ্যানুয়েলে'র রেসাল্টে এসে পর্যন্ত ধাক্কা দিলো সল্লু, শালা চাঁট মারা'র মত এফেক্ট হলো! সংস্কৃত'য় প্রায় টপকে গেছিলাম আর কী, কোনোরকমে পাশ, উদোম ঝাড় খেলাম বাড়িতে। ততদিনে বইয়ের ফাঁক থেকে উদ্ধার হয়েছে সব এ্যাফ্রোডিসিয়াক ছবিটবি, বাজেয়াপ্ত হয়েছে সাধের রেডিওখানা, আর টিভি তো প্রায় নিষিদ্ধ বস্তু'র আওতায়। 

এই পরিনত বয়েসে এসে ভাবি, আজ আর কেউ আটকায় না, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে অনেক ভালো ভালো সিনেমা দেখেছি। কিন্তু সেই অপরিনত কিশোরী মন যে আস্বাদ পেয়েছিল,একটি অগভীর, বানিজ্যিক, প্রেমের ছবি'তে, সেই স্বাদ সেই উন্মাদনা সে আর কোনো ছবি'তে পায় নি। সেই দেখাটুকু তার জীবনে ভালোলাগা ছেয়ে আশ্রয় দিয়েছে আরও অনেক টুকরো টুকরো ভালোলাগার, অবিশ্রান্ত নষ্ট্যালজিয়ার ঘূর্ণনে তার মনোজগৎ নবীকৃত হয় আজও, মূল্যহীন ছেলেমানুষী'র স্মৃতিকাতরতা আজও তার চুলপাকা বয়েসে'র সব গাম্ভীর্য উড়িয়ে বলে —মনে পড়ে?  মনে পড়ে কন্যে? 
এই পরিনত মনস্কতা আদতে কি ঠেলে দিলো বোধহীন পরিনতির দিকে অথবা ছদ্ম-অবিচলতায় মোড়া নিশ্চিত বাচালতা'র মধ্যে? কে জানে! ওগো অপরিনামদর্শী কমলকলি বালিকা মন, তুমি চিরন্তনের থেকেও ভালো গো !

                     অন্তরা দাঁ
                কাঁটাপুকুর,পূর্ব বর্ধমান















0 Comments