
অবশেষে গল্পটা..
"মনা, ওঠ রে….. সুবলকাকা এসেছে.."
মায়ের আদরমাখা কণ্ঠে চোখ মেলে মনোজ।
ঘুমের আবেশে একটা লম্বা হাই তুলে বলে ওঠে, "সুবলকাকা...? বসতে বলো...।"
বাবা চলে যাওয়ার পর সুবলকাকাই ওর লোকাল গার্জেন। ক্লাস থ্রিতে পড়তে মনোজের বাবা হঠাৎ ব্লাড ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে কোনো প্রয়োজনে এক ডাকে ওদের বাড়িতে চলে আসে সুবলকাকা।
আদ্রা শহরের পাশে জিয়ারা গ্রাম। এখন জিয়ারাতেই মাকে নিয়ে একটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে থাকে মনোজ। সঙ্গে বছর দেড়েকের ছোট্ট কুকুর 'লালু'।
বাবা চলে যাওয়ার পর আদ্রা শহরে মামার বাড়িতেই থাকতো মনোজ।সারাটা দিন শহরের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সাইকেল নিয়ে পাক খেত সে।
বাবা'ই ওকে হাত ধরে হঠাৎ একদিন আদ্রা থানা পেরিয়ে শিব মন্দিরের কাছে লালডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো।ছোট থেকেই দুষ্টুমিতে কারোর থেকেই কম যেত না মনোজ।ওর ঠাকুমা বলতেন,'নাতির আমার হাতে,পায়ে সমানে বয়।' শুনে সবাই হাসতো।
প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর আশ্রম স্কুল থেকে কষ্ট করে মাধ্যমিকটা যাহোক করে পাস করেছিলো মনোজ।
তারপর সবার অমতে একপ্ৰকার জোর করেই ভর্তি হয়েছিলো ইলেভেনে।
"কি রে মনা..? তোর সুবলকাকা কখন থেকে বসে আছে....!"
মায়ের ডাকে নিজের জগতে ফেরে মনোজ। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওর এই আদ্রা শহরে। জন্ম থেকে বাইশটা বছর।ভাবা যায়..!
"যাই মা... " চোখে ঘুম নিয়ে জোর করেই উঠে পড়ে মনোজ।কাল অনেকরাত পর্যন্ত ঘুম হয় নি ওর।জোনাকীদের সঙ্গে কাল সারা রাতই প্রায় জেগে কেটেছে ওর।মহালয়া আসলেই নয়নের কথা মনে পড়ে খুব। ওর চুলে জড়িয়ে থাকা লাল ফিতেটা নাকের কাছে নিয়ে মাঝে মধ্যেই গন্ধ নেয় ও। নয়নের চুলের তেলচিটে গন্ধটা এখনো যেন লেগে আছে ফিতেটায়।
"শোন মনা, এবার কিন্তু 'না' করবি না তুই।করোনার চোটে এবার কলকাতা যাওয়া বন্ধ।পূজোয় এবার আদ্রায় কাজ।" সুবলকাকার কণ্ঠে সংবিত ফেরে মনোজের। বুঝতে পারছে,আজ বারবার আনমনা হয়ে পড়ছে ও।
"আদ্রা আমায় যেতে বলো না কাকা। গোটা শহর জুড়ে অনেক স্মৃতি..!আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না আমি...!খুব কষ্ট হয় গো।"
"শোন,এই পূজো তোদের পাড়া থেকে অনেক দূরে..। আদ্রা কি আর একটুখানি শহর রে খ্যাপা...!" সুবলকাকা হাতটা ধরে ফেলে মনোজের।
"আমি যাব না কাকা..."
মাথা নীচু করে 'না' তে অনড় থাকে মনোজ। চোখের কোনে বেদনার বিন্দুজল জমা হয়।
"যা না মানিক...তোর কাকা এত করে বলছে..." মনোজের মা ছেলের পিঠে স্নেহভরা হাত বুলিয়ে বলে ওঠে।
"যেতে পারি...কিন্তু একটা শর্তে...!"
হঠাৎ কান্নাভেজা চোখদুটো মেলে বলে মনোজ।
"আচ্ছা,ঠিক আছে...তোর সব শর্ত না শুনেই মঞ্জুর করলাম। তুই যাবি বলেছিস,এতেই আমি খুশী..।"
"কিন্তু দাদা,শর্তটা শুনবে না...?" মনোজের মা জিজ্ঞাসা করে সুবলকাকাকে।
মায়ের কথায় চোখের জল মোছে মনোজ।
বিদ্যুতের মতো এক ঝিলিক হাসি খেলে যায় ওর মুখে।
"দুদিন আগে চলে যাবো আদ্রা..।মানে চতুর্থীর দিন...."
"ঠিক আছে যাবি.. কিন্তু ওখানে থাকবি কোথায়?"
"মলয়ের বাড়ি..। আমি জানি ও না করবে না। বরং আনন্দ পাবে কাকা।"
মনোজের কথা শুনে সুবল স্বস্তি পায় ঠিকই,কিন্তু একটা অজানা চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ওর।
হাতদুটো মুঠি করে খুশিতে উঠে পড়ে মনোজ।
"দাঁড়া..। এবার তুই মনে হয় রিকশাওয়ালা সাজবি।চাপ নেই।সারাক্ষন বসে থাকা।তবে দৃষ্টি স্থির,আর ক্লান্তিটা যেন চোখে মুখে ফুটে ওঠে....। মনে থাকবে?"
"মনে থাকবে কাকা..।" হাসিমুখে চোখ বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে যায় মনোজ।
দেখতে দেখতে চতুর্থীর সকালটা চলে আসে। শিউলি ফুলের তীব্র গন্ধে ঘুমটা ভেঙে যায় মনোজের। মনোজের আদ্রা যাওয়ার দিন আজ।জানালা দিয়ে দূরে চোখ চলে যায় ওর। আকাশ জুড়ে 'মেঘের নৌকাগুলো' পাড়ি দিচ্ছে যেন অজানা কোন পথে। কাশ ফুলের দল হাওয়ার ছন্দে এক অজানা আনন্দে মেতে উঠেছে এই সময়।
চাপা আনন্দে কাল সারা রাত ঘুম হয় নি মনোজের।ভিতরে একটা আনন্দধারা বইছে।আবার আদ্রা...! একসময় স্বপ্নের মতো মনে হওয়া সেই রেলওয়ে কলোনি, পলাশ বন,খোসলা বাঁধ- সব যেন হাতের তালুর মতো মুখস্থ ছিল ওর। মা একটা ছোট্ট চায়ের দোকান চালিয়ে কোনোরকমে মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতো।
কিন্তু রঙিন পৃথিবীর রং এত তাড়াতাড়ি ফিকে হয়ে যাবে,বুঝতে পারে নি মনোজ। ক্লাস টুয়েলভ পড়ার সময় মায়ের হঠাৎ শরীর খারাপ হলো একদিন। মনোজ সেদিনই বুঝেছিল এবার তাকে কোমর বেঁধে সংসারের হাল ধরতে হবে। কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিকটা পাস করে ঢুকে পড়েছিলো সুভাষদার গ্যারেজে।
বেশ নির্বিঘ্নেই চলছিলো মা-বেটার জীবন।হঠাৎ ধূমকেতুর মতো হাজির হলো নয়ন। খুব মনে আছে,আলাপ হয়েছিলো ওদের অকাল শ্রাবনের এক বৃষ্টিস্নাত দিনে।
আধ ভেজা নয়ন আশ্রয় নিয়েছিলো ওদের গ্যারেজে। নয়নের মিষ্টি ঠোঁটের ছোট্ট কথাটা আজও মনে পড়ে মনোজের।
"হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা কিছুতেই ছাড়ছে না..." নয়ন বলতেই নিজের ছাতাটা ওকে এগিয়ে দিয়েছিলো মনোজ। সেই শুরু..! তারপর ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণতি পেতে বেশী সময় লাগেনি ওদের। সপ্তাহে একটা দিন রবিবার ছুটি পেতো মনোজ। সুভাষদার স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তো ওরা। কোনোদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে শিমুল-পলাশের তলায়,কোনোদিন আবার শহরের বাইরে মেঠো পথ ধরে অনাবিল আনন্দে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতো ওরা।ওদের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো রূপকথা হয়ে ধরা পড়তো রবিবারে। মনোজের মা'ও মেনে নিয়েছিলো নয়নকে।
কিন্তু দুর্ভাগাদের ললাটে সুখের লিখন মনে হয় বেশিদিন স্থায়ী হয় না।মনোজেরও হলো তাই। মলয়দের বাড়িতে সত্যনারায়ন পূজোর প্রসাদ খেয়ে ভাঙা স্কুটিটা দ্রুত গতিতে চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলো ও টিভিতে 'চাঁদের পাহাড়' সিনেমাটা দেখবে বলে।
এক চিলতে ঘরে ঢুকেই মায়ের গম্ভীর অবসন্ন মুখটা দেখে ও চমকে উঠেছিলো অজানা আশঙ্কায়।
গাড়িটা যাহোক করে দাঁড় করিয়ে মা'কে মন খারাপের কারণটা জিজ্ঞাসা করতেই অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলো মনোজের মা।
"নয়নকে ধোবি তালাওতে অত্যাচার করে ফেলে দিয়ে গেছে শয়তানেরা...!"
মায়ের কথা শুনে সেদিন বোবা হয়ে গেছিলো মনোজ।
পরের দিন সকালে এক ছুটে হাসপাতাল।নয়নের ঘোলাটে চোখ দুটোর দিকে তাকাতে পারে নি বেশীক্ষন ও। নিষ্ঠুর অত্যাচারের ছাপ সারা শরীর জুড়ে। ঠোঁটে জমাট বাঁধা রক্ততে বসা মাছিটাকেও তাড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না নয়নের।
ঘটনার পর মাস তিনেক ঘুমাতে পারে নি মনোজ। বিছানায় ছটফট করে কাটিয়ে দিয়েছে একটার পর একটা বিনিদ্র রাত।
ছেলের ধারাবাহিক যন্ত্রনায় চুপ করে থাকা মুখটা দেখে সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হয়েছিল মনোজের মা।সুবলকাকার উদ্যোগেই মা মনোজকে নিয়ে চলে এসেছিল এই জিয়ারা গ্রামে।গ্রামেই শিল্পী সংঘে একটা কাজও পেয়ে গেছিলো ও।প্রথম প্রথম বড় অসুবিধা হতো মনোজের।তিন চার ঘণ্টা স্ট্যাচু হয়ে থাকা।এখন অবশ্য খুব নাম করেছে এই কাজে। স্মৃতিগুলো আজ বড্ড ভিড় করছে মনোজের মনের আকাশে।
"খেয়ে যাস..আমি রান্না চাপিয়েছি.." মায়ের কথায় স্নান করতে যায় মনোজ।
দেখতে দেখতে চতুর্থী ,পঞ্চমী পেরিয়ে আজ ষষ্ঠীর সকালটাও চলে এলো। এই দুদিন সারা শহর ঘুরে বেরিয়েছে মনোজ।ওর হারানো দিনের গল্পগুলো কষ্টের আড়ালে স্মৃতির ছোঁয়ায় ফিরে এসেছে দুদিন ধরে অবিরত। যাপনচিত্র তো স্মৃতির পাতায় এভাবেই নিভৃতে বাঁচে।
মণ্ডপে যাওয়ার আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে অবাক হয় মনোজ।যন্ত্রণাগুলোকে কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় কিভাবে নিখুঁত এঁকেছে মুখ জুড়ে সুবলকাকা...!আনন্দকে নিয়ে এভাবেই তো আছে মনোজ নয়ন চলে যাবার পর থেকে।
"মনা চলে আয়, সময় হয়ে গেছে...."
সুবলকাকার কথায় নিজের জগতে ফেরে মনোজ।
"চলো কাকা,আমি রেডি.."
নদীর স্থির জলের মতো স্থবির হয়ে বসে পড়ে মনোজ মূর্তি হয়ে।
"চোখের পলক পড়ছে না দেখ..."
একটি বাচ্ছার কথা কানে যায় মনোজের। আমল দেয় না ও। অস্থির,এলোমেলো পরিবেশে নিজেকে কিভাবে নির্বাক মোমের মূর্তির মতো থাকতে হয়,সুবলকাকার কাছেই নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনে শিখেছে মনোজ।
গোধূলির মুহুর্ত থেকে 'মনোজের চুপকথা' ঘন্টার চৌকাঠ পেরিয়ে যায় ধীরে ধীরে।সন্ধ্যার ভিড় ক্রমশঃ পাতলা হতে থাকে।
হঠাৎ দূরে দৃষ্টি চলে যায় ওর। বড় চেনা মুখ..! পরনে শতচ্ছিন্ন শাড়ি।ধুলো বালির নকশা সারা শরীর জুড়ে। ছেঁড়া আঁচলটাকে মাঝে মাঝে টেনে মজা নিচ্ছে কচি-কাঁচার দল।আলো থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া,আঁধারে ডুবে থাকা নির্বাক একটা মুখ।
"নয়ন না...?" যন্ত্রণাগুলো পোকার মতো কিলবিল করতে থাকে মনোজের।বুকের বামদিকে একটা অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করে ও।
কিন্তু নয়ন তো বেঁচে নেই..! সুবলকাকার মুখে নয়নের মৃত্যুর খবরটা এখনো কানে বাজে ওর.."তোর নয়ন চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে রে মনা.."
খবরটা যে "ডাহা মিথ্যা" সেটা এখন বিলক্ষণ বুঝছে মনোজ।
আরো কাছে এসে পড়েছে নয়ন।
"মনোজ,আমাকে বাঁচাও..! ওরা মেরে ফেলবে আমাকে..!বাঁচাও আমাকে ...!" একটা অস্ফুট আওয়াজ শুনতে পায় মনোজ।
ধীরে ধীরে দৃষ্টির বাইরে ঝাপসা হতে থাকে নয়নের মুখ। বুঝতে পেরেও মনোজ যন্ত্রণাটাকে ধূপকাঠির মতো পোড়াতে থাকে বুকের মধ্যে।
ইতিমধ্যে ম্রিয়মাণ মণ্ডপে মানুষের আনাগোনা কমতে শুরু করে।আলোপোকারা মনোজের স্থির চোখদুটোতে আছড়ে পড়তে থাকে ঢেউয়ের মতো...!
"খেতে চল মনা..." মনোজের পিঠে সুবলকাকা হাতের টোকা মারতেই ওর নিষ্প্রাণ দেহটা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে...!
2 Comments
শব্দের খেলা স্পর্শ করে যায় মন।
উত্তরমুছুনখুব ভালো। ভালো থাকবেন।
লেখাটা অবশ্যই ভালো,শেষে অনেক গল্পের মৃত্যু থাকে প্রয়োজনে। এখানে মৃত্যু কিছুটা আরোপিত মনে হল।
উত্তরমুছুন