
দন্তরুচিকৌমুদী
ভোরের আলো সবে ফুটেছে কি ফোটে নি, ঘুম ভেঙে গেল তুমুল ঝগড়ার শব্দে।একটাই কথা বারবার শোনা যাচ্ছে, "তুমি আমার দিকে ওর’ম করে চেয়ে হাসবে না। "
এই এক জ্বালা হয়েছে। সল্টলেকের এই পাড়াটা দিব্যি নিরিবিলি।দু'পা এগোলেই সিটি সেন্টার,হবু মেট্রো স্টেশন ।সবচেয়ে বড়ো কথা সেক্টর ফাইভের অফিসটা খুব কাছে। দুটো অটো চড়ে আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়।
আগরতলার সুমি পড়াশুনো করেছে দিল্লীতে, চাকরি পেয়েছে ব্যাঙ্গালোরে আর দুবছর বাদে ট্রান্সফার হয়ে হাজির হয়েছে কলকাতায়।
কলকাতা তার খুব একটা চেনা শহর নয়। তাই অফিস থেকেই যখন কাছাকাছি কয়েকটা পেয়িং গেস্ট থাকার জায়গার ঠিকানা দিয়ে দিলো, মনে স্বস্তি পেয়েছিলো।
রায়মাসিমার বাড়িটাই সবচেয়ে বেশি মনে ধরলো| সুন্দর দোতলা বাড়ী, ছবির মতো বাগান। দুই বুড়ো-বুড়ীর আস্তানা। ছেলেমেয়েরা কবেই মানুষ হয়ে বাড়ি থেকে বিদায় হয়ে গেছে।
বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখার কারণ অনেকটাই একাকীত্ব ঘোচানো। সল্টলেকের ঘরে ঘরে এখন এই ছবি। গোটা শহরটাই যেন বড়োসড়ো একটা বৃদ্ধাশ্রম।
সুমির তাতে আপত্তি ছিল না।ভেবেছিলো শনি-রবিবারে ভালোই সময় কাটবে গল্প-গাছা করে।
ভুল ভাঙলো কিছুদিনের মধ্যে।
নতুন পেয়িং গেস্টের কথা ভেবে কত্তা-গিন্নী প্রথম প্রথম একটু সামলে-সুমলে ছিলেন।সুমি একটু পুরোনো হতেই বাঁধ ভেঙে গেলো।
রায়মেসোমশাই যখন সকালে তাঁর বাঁধানো দাঁতের পাটি পরেন, ঠিক সেইসময় রায়মাসীমা ঠাকুরকে ধূপ দেখান। তাঁর ঠোঁটে নাকি তখন বিদ্রূপের হাসি লেগে থাকে। মাসীমার এই বয়েসেও সুন্দর ঝকঝকে দাঁত| হাসলে তাঁকে দেখায় ভালো।
আর তাঁর সে হাসির জ্বালায় রায়মেসোমশাই জ্বলে পুড়ে যান। বাঁধানো দাঁতে কিড়মিড় করে গাল দেন গিন্নিকে। কুরুক্ষেত্র বাধে রোজ।
রোজ রোজ কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! ধুত্তেরি বলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সুমি।
ছেলেমেয়েরা দূরে থাকে।টেলিফোন কিছু কিছু আঁচ পায়। বোঝানোর চেষ্টাও করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
তবে একটা বড়ো গুণ এঁদের - নিজেদের ঝগড়ায় কাউকেই সালিশী মানেন না। আজপর্যন্ত কক্ষণো সুমিকে ডেকে মধ্যস্থ মানেন নি।সুমি তাতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। রক্ষে করো! সারাদিন খাটাখাটনির পর ঝগড়া মেটাতে হলে সে এই বাড়ি ছেড়ে পালাতো।
আজ সকালের ঝগড়ার পর্ব শেষ হতে না হতেই গুমগুম করে রায়মেসোমশাই নেমে এলেন নিচে।
"সুমি, আমায় একবার দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।তোমার চেনা কে এক ডেন্টিস্ট আছে বলেছিলে না?"
সুমি একটু অবাক হয়। বাঁধানো দাঁতে আবার ডেন্টিস্টের কী দরকার রে বাবা!
মুখে বললো, "সে তো আছেই, কলেজের বন্ধুর দিদি। এই তো কাছেই নারকোলডাঙায় তার চেম্বার।"
রায়মেসোমশাই রায় দেন,"কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো।"
ওপর থেকে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। রায়মাসিমার পদধ্বনি।ব্রেকফাস্ট নিয়ে নামছেন। ভদ্রমহিলা রন্ধনে দ্রৌপদী।
রায়মেসোমশাই সুট করে কেটে পড়েন।বেরোতে গিয়ে ঘরের দরজায় দুজনে মুখোমুখি। বিষমেশানো দৃষ্টিতে দুজনেই দুজনকে একবার মেপে নেন।
দিনকয়েক গেল। সুমি ভুলে গেলেও মেসোমশাই ডেন্টিস্টের কথা ভোলেন নি। আবার মনে করালেন।
সুমি এবার একটু লজ্জাই পেল। তারই গাফিলতি।
আহারে, বুড়ো মানুষ, বাঁধানো দাঁত নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়ই। হয়তো নতুন দাঁত করাতে হবে।
বন্ধুর দিদিকে ফোন লাগালো।
রবিবার সকাল নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
রবিবারে সকাল সকাল তৈরী হয়ে ওপরে গিয়ে দেখে মেসোমশাই রেডি।
রায়মাসিমা একটু থতিয়ে গেছেন। একটু যেন অবাকও। দাঁতের ডাক্তার?
সুমি বলে, "মেসোমশাই আপনাকে কিছু বলেন নি মাসীমা?"
রায়মাসিমা ঠোঁট ওল্টান, "নাহ, আর আমার জেনেও কাজ নেই। "
উবার নিয়ে দশমিনিটেই নারকোলডাঙ্গা।
ডাক্তার শমিতা ব্যানার্জীর চেম্বারে বেশ ভিড়।
সুনীতা আর সুমি একসঙ্গে দিল্লীতে থেকেছে, কলেজ করেছে| শমিতা সুনীতারই দিদি।
সুমিকে দেখে ডাক্তারের মুখে চেনা হাসি,"কী রে, কেমন চলছে?"
সুমিও হাসে, "ভালো| কত্তদিন বাদে দেখা। "
মেসোমশায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় সুমি।
ডাক্তার শমিতা ব্যানার্জী স্টেথো বাগিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "বলুন, কি সমস্যা?"
মেসোমশাই জিজ্ঞেস করেন, "এক গ্লাস জল পাওয়া যাবে?"
"নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই" ডাক্তার শমিতা ব্যানার্জী ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। জল আসে।
ধীরেসুস্থে নিজের দুপাটি দাঁত খুলে জলের গেলাসে রাখেন রায় মেসোমশাই।
"ডাক্তার আমি দাঁত ইমপ্ল্যান্ট করতে চাই। একটা দুটো নয়, সবকটা দাঁত। "
শমিতা একটু অবাক হয়েছেন, "কেন বলুন তো? বাঁধানো দাঁতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি?"
রায়মেসোমশাই উত্তেজিত,"ভীষণ অসুবিধে, বাঁধানো দাঁতের লিমিটেশনটা এবার আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি। "
শমিতা আরো অবাক, "খেতে, চিবোতে কোনো সমস্যা হচ্ছে? আপনার দুপাটি বাঁধানো দাঁত তো মনে হচ্ছে অনেকদিনের। এতদিনে তো অভ্যেস হয়ে যাওয়া উচিত!"
রায়মেসোমশাই নড়েচড়ে বসলেন। "না না, অতো সহজ নয়| আসলে ব্যাপারটা হলো কি, গিন্নীর সঙ্গে তো মাঝেমাঝেই মারকাটারি ঝগড়া বেধে যায়।আর যখনি ঝগড়া হয়, তখনি তার মুড়িঘণ্ট,কাঁটা চচ্চড়ি, ডাঁটাপোস্ত রান্না করার ইচ্ছে হয়। মাঝে মাঝে আবার পাঁঠার মাংস!"
শমিতা শুনছেন। "সে তো ভালো কথা| তাহলে যত ঘনঘন ঝগড়া হয় ততই তো ভালো!"
রায়মেসোমশাই উত্তেজিত,"কিন্তু মুড়িঘণ্টের মুড়ো? ডাঁটাপোস্তর ডাঁটা? পাঁঠার হাড়? আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে গিন্নী কড়কড়ায়তে, মড়মড়ায়তে করে যায়। সে কি জানে না, এগুলো খেতে আমি কত ভালোবাসি? কিন্তু খেতে গেলেই যে বাঁধানো দাঁতের পাটি খুলে আসে...."
মেসোমশায়ের চোখে জল চিকচিক করে আসে|
শমিতার হাত ধরে বলেন, " এই দেঁতো হাসি আর আমি সহ্য করতে পারছি না। দাঁতের জোর দেখাচ্ছে আমায়? অ্যাঁ? যত পয়সা লাগে লাগুক, আমার শক্তসমর্থ দুপাটি দাঁত চাই। বাজারে খাসা আখ উঠেছে দেখেছি। ওই আখ কিনে এনে আমি চিবিয়ে চিবিয়ে খাবো ওর সামনে, তবে শান্তি। ”
শমিতা অবাক, "কিন্তু এতো খাবার থাকতে আখই বা কেন?"
বাঁধানো দাঁতে কুটিল হাসি, "গিন্নির হাই ব্লাডসুগার যে..."
0 Comments