অঞ্জনা গোড়িয়ার গল্প



শাস্তি 

ভাঙা সাইকেলটা নিয়ে রানা খোঁড়াতে খোঁড়াতে  চলল।
সাইকেল টা তার খুব প্রিয়। নতুন সাইকেল। সবে মাত্র বাবা কিনে দিয়েছে। তার এমন  দশা দেখে চোখে জল এসে যাচ্ছে।। নিজের পা কেটে রক্ত বের হচ্ছে।সে দিকে ভুক্ষেপ নেই।একটা সাইকেল দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। 
"কাকু কাকু,আমার এই সাইকেল টা সারিয়ে দেবে গো?
মুখের দিকে না তাকিয়েই  জানালো,এমন হাল কি করে হল? এভাবে কেউ সাইকেল চালায়? ওদের বুঝি  আঘাত লাগে না? 
অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,সাইকেলের আবার আঘাত?এরা তো জড়। এদের আবার আঘাত লাগে নাকি? 
প্রচন্ড রেগে সাইকেল সারানো কাকুটা বলল, ও আঘাত বুঝি শুধু মানুষের লাগে?এরাও মানুষ। বুঝলে? যে অন্যায় করেছ,তার শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। কান ধরে ৩০টা উঠবোস করো।তবে ই সারাবো সাইকেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল, আমার পায়ে লেগেছে। রক্ত বের হচ্ছে।পারব না কাকু।
কি বললে পারবে না? তাহলে  আরও  কঠিন শাস্তি পেতে হবে।এটা তোমাদের গ্রাম নয়। তুমি আছো এখন আমার শহরে।এখানে অন্যায় করলে। ভুল কাজ করলে।শাস্তি পেতে হয়। 
তোমাদের শহর  মানে?আমি এখন কোথায়?তুমি অন্যায় করেছ।তাই আমাদের শহরের পুলিশ তোমাকে তুলে এনেছে শাস্তি দিতে। 
রানা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,তোমাদের শহরের নাম কি? 
এ শহরের নাম "ন্যায় শহর"।
এটা আমাদের নতুন গ্রহ।যেখানে কোনো অন্যায় হয় না।এখানে যে ভুল কাজ করে। অন্যকে আঘাত দেয়। তার শাস্তি পেতে হবে।
রানা ভয়ে,বলে ফেলল,আমি বাড়ি যাবো।মায়ের কাছে। আমাকে ছেড়ে দাও।
এখন যে খুব মা মা করছ। যখন তোমার  মা তোমাকে বকে। শাসন করে। অন্যায় করার জন্য। কি করো তখন? মায়ের মুখের ওপর  যা খুশি  বলে  দাও। একটা কথাও শোনো না।আগে ৩০ বার উঠবোস করো।তবেই সাইকেল দেব। বাধ্য হয়েই খোঁড়া পায়ে ই শুরু করল উঠবোস।
"খুব যন্ত্রনা হচ্ছে পায়ে। এবার ছেড়ে দাও না গো কাকু।"
বেশ।সাইকেল টা সারিয়ে রাখছি। তুমি এখন যাও আমাদের স্কুলে।দেখো কত বন্ধু  আছে তোমার মতো। 
রানা খোঁড়াতে খোঁড়াতে স্কুলে  চলল। সেখানে গিয়ে,  দেখে তো অবাক।ওর মতো কত ছেলে মেয়ে নানা কাজে ব্যস্ত।কেউ বেঞ্চ পরিস্কার করছে।কেউ জুতোর ফিতে পরাচ্ছ।কেউ আবার বই খাতা সেলাই করছে। এটা আবার কেমন স্কুল?
সব ছেলে মেয়েদের ই করতে হচ্ছে?

রানাকে দেখেই এখানকার স্যার বলল,তোমার জন্যই  অপেক্ষা করছিলাম।এত দেরী হল কেন?জানো তো  স্কুলে আসতে দেরি হলে শাস্তি পেতে হয়। 
"হ্যাঁ জানি তো। আমার স্কুলে এক পিরিয়ড ক্লাসে ঢুকতেই  দেয় না। ডাইরিতে লিখে দেয় নোটিশ। "
এখানে তোমাকে স্কুলের বারান্দা পরিষ্কার করতে হবে। 
"পায়ে ব্যথা স্যার। তাই আসতে দেরি হয়ে গেল।"
 কোনো অজুহাত নয়। যাও ঝাড়ু নিয়ে বারান্দাটা পরিষ্কার করে এসো।
বাড়িতে ভীষণ নোংরা ফেলো চারিদিকে।তারজন্য  এই শাস্তি পেতে হবে।
রানার খুব কান্না পাচ্ছে।
তবু মুখে সাড়া নেই।ঝাড়ু নিয়ে পরিস্কার করল বারান্দা।
স্কুলের স্যার, প্রত্যেকের নখ দাঁত জামা নিখুঁত ভাবে দেখছেন। রানার কাছে এসে বলল,"
যাও ভালো করে দাঁত মেজে এসো।"
একদম দাঁতের যত্ন নাও না।
তারপর নখ কাটবে। 
এত বড়ো বড়ো নখ?  নখ কাটবে নিজে।
আরও আছে কাজ।
রানার খুব কষ্ট হচ্ছে।মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে।  
আবার স্যার বললেন,একি রানা,জামার বোতাম  খোলা কেন? নিশ্চয় ছিঁড়ে ফেলেছ? 
  
তোমাকেই জামার বোতাম লাগাতে হবে। জুতোর ফিতে পরাতে হবে। তবেই মিড ডে মিল খেতে পাবে। 
রানা কোনো দিন যা করেনি। আজ করতে হচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তার ও উপায় নেই।কোথাও মা নেই। কে করে দেবে এসব কাজ? মায়ের কথায় মন টা ডুকরে উঠলো।  
অপটু হাতে সুঁচ সুতোয় জামার বোতাম লাগালো। হাতে সুঁচ ফুটে গেল। ব্যথা করছে। তবু কাজ শেষ  করতেই হবে।  
তবেই ছুটি পাবে। ঘরে যেতে পারবে।
 রানা জুতোর ফিতে পরালো। 
সেই কখন সকালে বের হয়েছে বাড়ি থেকে।খিদেয়  পেট হা হা করছে। তবু খেতে দিচ্ছে না । 
স্যার,ভালো করে পরীক্ষা করে চলেছে। ঠিকঠাক  কাজ করেছে কিনা? তবেই খাবার পাবে। 
স্যার বলল,জুতোর ফিতেটা ঠিকঠাক লাগাও।কিচ্ছু হয় নি। তারপর বই টা সেলাই করবে।মলাট করবে।  তবেই ছুটি হবে। 
বই ছিঁড়েছো?খাতার পাতা ছিঁড়ে উড়োজাহাজ বানিয়েছ।এদের ও আঘাত লাগে বুঝেছ। 
রানা পরপর সব করে ই চলেছে। 
কিছু পেনের ঢাকা,পেন্সিল কাগজ, দিয়ে গেল। এই নাও তোমার খাবার। এসব ই খাও তো তুমি?
মুখ দিয়ে নখ কাটো।কাগজ চিবিয়ে খাও।আর কি কি খিদে ইচ্ছে করে তোমার? 
হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।আর হবে না স্যার।
সত্যি বলছি। বড্ড খিদে পেয়েছে। 
স্যার,মাথায় হাত রেখে বলল,মনে রেখো সু- অভ্যাসে জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে।যাও খেতে বসো। মিড ডে মিল দেওয়া শুরু হয়েছে।যে রানাকে খাওয়াতে মাকে হিমসিম খেতে হয়। আজ নিজ হাতে পেট ভরে খেলো। 
ছুটির ঘন্টা বাজল। স্যার জানিয়ে দিল,এবার থেকে  যদি সাবধানে না গাড়ি চালাও। আর ফিরে যেতে দেব না।এখানেই আটকে রাখব।সব কাজ নিজে হাতে করতে হবে। কাউকে আঘাত দেওয়া চলবে না। "
মনে থাকে যেন। এটা আমাদের নতুন পৃথিবী। 
রানা মাথা নেড়ে সাইকেল টা নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে রওনা হলো। 
    
ঘরের হাল্কা আলোয় দেখতে পেল মাথার সামনে বসে আছে মা।বাবা ও খুব চিন্তিত মনে পায়চারি করছে।
বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে,ছেলে টার কি হল?    একটু যদি মায়ের কথা শুনে চলত।এ দিন টা দেখতে হত না আর। এসব কি শুনতে পাচ্ছে রানা? কি হয়েছে তার? মায়ের চোখে জল কেন?  
আমি কি বিছানায় শুয়ে? কি হয়েছে আমার? 
অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,"মা"।  
"মা" ডাকে মায়ের মুখে ফুটে উঠল হাসি। এই তো  সোনা আমার। চোখ খুলে তাকিয়েছে। তোমার মা আমি।
ধীরে ধীরে  মনে পড়ে গেল সব ঘটনা ।
   
সবে মাত্র নতুন সাইকেল চালানো শিখেছে। তাতে ই  বায়না। দাও না বাবা একটা সাইকেল।সবার নতুন সাইকেল আছে।আমার ও চাই। 
মাসের শেষ। তবু রানা একমাত্র ছেলে।ওর আবদার কিছুতেই ফেলতে পারে না বাবা।
বন্ধুদের কাছ থেকে  টাকা ধার করে নতুন সাইকেল এনে দিল। রানার আনন্দ আর ধরে না।সকাল হতেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরল বড় রাস্তায়।বারবার করে সাবধান করে ছিল।নতুন শিখেছ।বেশি দূর যেও না। 
সাইকেলে চেপে জোর গতিতে এগিয়ে গেল বড় রাস্তার দিকে।
সামনের ফুটবল  মাঠে খেলছিল একদল ছেলে।চোখ চলে যায় বলের দিকে। 
রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল বুড়ি ঠাকুমা। অন্যমনষ্ক রানার সাইকেল টা একবারে সামনে এসে পড়ে বুড়িমার। বুড়ি ঠাকুমাকে বাঁচাতে গিয়ে সাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে রানা।সাইকেল টা ঠিকরে যায় ফুটপাতে।রানা মাটিতে পড়ে যায়।
আর কিছু মনে পড়ছে না। জ্ঞান ফিরে চেয়ে দেখে বাড়িতে ।বিছানায়। তবে কি এতক্ষন যা কিছু  ঘটলো,সব মনের ভুল? না স্বপ্ন?
পরের দিন অনেক খানি সুস্থ  রানা।
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল। কিছু বলতে হলো  না। নিজেই ব্রাস করল।পরিস্কার করল মুখ হাত। তারপর  ব্রেকফাস্ট খেয়ে পড়তে বসল।
নিজেই নিজের বই খাতা যত্ন করে গুছিয়ে রাখল। পেনের ঢাকা টা শক্ত করে  লাগিয়ে দিল। 
স্নান করে রানা ধীর গতিতে সাইকেল নিয়ে স্কুলে গেল। পরিপাটি করে জামা জুতো পরে স্কুলে গেল।  স্কুলের স্যার রানার এমন পরিবর্তন দেখে অবাক।
আর বোতাম ছেঁড়ে না।খাতা ছেঁড়ে না।জুতোর ফিতে  একাই পরায়।মা বাবা অবাক। রানার হলো টা কি?  তবে বেশ নিশ্চিত। 
যাক বাবা,রানাটার এবার চেতনা  ফিরেছে। একটু মানুষ হয়েছে।  

গল্পকার অঞ্জনা গোড়িয়া
ভগবানপুর, ফলতা, পশ্চিমবঙ্গ
































0 Comments