চু কিত কিত দুপুরবেলা
কবে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কে জানে। বাপ বেটি ঘরে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে আর আমি খেটে খেটে মরছি। একটা কাজ করানো যাচ্ছে না এদের দিয়ে। মেয়েকে কখন বলেছি বোতলে জল ভরে রাখতে। সে কথা না শুনে মোবাইলে গেম খেলে চলেছে। বাবু তো টিভি থেকে মুখ তুলছে না। নয় খবর নয় সিনেমা নয়তো খেলা দেখে সময় কাটাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চায়ের ফরমান জারি করছে। রাগে গজ গজ করতে থাকে সুলতা। সে জানে এসব বলে কোনও লাভ নেই মাঝখান থেকে অশান্তি করবে বাপ
মেয়ে।
এখন আরও বেশি কাল হয়েছে এই মোবাইল। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে ফলে নিজের মোবাইল চলে গিয়েছে মেয়ের দখলে। মেয়ে কতটুকু পড়ছে আর কতটুকু গেম খেলছে সেটা পর্যন্ত দেখছে না তমাল। মেয়ের সবে বারো। এই বয়সে এত মোবাইলে গেম খেলা ভাল নয়। সে কথা তমালকে বললে সে উলটে বলবে- ‘কী করবে। কোথায় যাবে।তার থেকে যদি মোবাইলে গেম খেলে ক্ষতি কী।’
‘ও তাই। মেয়ের সামনে তোমাকে আর কী বলব। বসে বসে থেকে থেকে চেহারাটা
কী করেছে দেখেছ? বারো বছরের মেয়ে। কোথায় ছিপছিপে থাকবে তা না, শুধু
ফুলছে। আমাদের ছেলেবেলা কী এই রকম ছিল? আমরা কত খেলাধুলো করেছি। ছোটাছুটি করেছি। এই রকম ঘরে বসে থাকি নি। আর এখনকার ছেলেমেয়েদের দেখ শুধু ঘরে বসে থাকবে। বলেছিলাম নাচ শিখতে। শিখল না।’
সুলতা রান্না করতে করতে ভাবে- তাদের ছেলেবেলাগুলো কেমন ভাবে কেটেছে।
বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো, ছোটাছুটি। কতবার পড়ে গিয়েছে। কত জায়গায় কেটে
ছরে গিয়েছে। তবু হুঁশ থাকত না। আবার ছোটাছুটি।
বাবা বলত- ‘মেয়েদের শরীর হবে পাতলা। ছিপছিপে। তবে না ঘর সংসারের সব
কাজ করতে পারবে।’
সেদিন ভাড়াটে ঘরের বিপাশাকে দেখল সুলতা। রিঙ্কি আর বিপাশা একই বয়সি।
ওঁর শরীরও কেমন ডেভলপ হয়ে গিয়েছে। ওঁর মা মানে সোনালি বলছিল- ‘মেয়েগুলো
ঘরে বসে থেকে থেকে কেমন ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে। একটা কাজ করে না। দিনরাত
মোবাইল ঘাটছে। অথচ আমাদের দিনগুলো কেমন ছিল বল। কত মজা হাসি খেলা করে
কাটিয়েছি। এদের কোনও কিছুতেই গা নেই। হচ্ছে হবে এমন একটা ভাব নিয়ে থাকে।’
‘ঠিকই বলেছ। কোনও কথা শুনবে না। কোনও কাজ করবে না। কেমন যেন হয়ে
যাচ্ছে। আর মুখের ভাষা দেখেছ। কোন কথায় কী বলতে হয় সেটা পর্যন্ত জানে না।
মুখে যা আসে বলে দেয়।’
‘আবার ওদের বেশি কিছু বলাও যাবে না। কখন কী করে বসবে কে জানে।’
‘ওটাই তো ভয়। আর সেই সুযোগটাই নেয়। খবরের কাগজ খুললে যা সব ঘটনার
কথা জানতে পারি, ভাবলেও বুক কেঁপে ওঠে। একটা মোবাইল দেয় নি বলে গলায় দড়ি দিয়ে বসল। বাবা কিংবা মা হয়তো কোনও কারণে বকেছে অমনি বিষ খেয়ে নিল।’
‘শুধু কী তাই। লক্ষ্য করেছ, এখন থেকেই নাকি ওদের বয়ফ্রেন্ড আছে।
ক্লাস সিক্স সেভেনের মেয়েদের দেখি টিউশনি ব্যাচ থেকে বের হতে না হতেই
ওদের ছেলে বন্ধুরা এসে পরে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করে। বাড়ি থেকে কোনও খোঁজ খবরও রাখে না? কেমন মা বাবা এরা কে জানে।’
‘আরে বাবা, ঘরের লোক জানে টিউশনি পড়তে গিয়েছে। সেখানে কী করে বেড়াচ্ছে তা বুঝবে কেমন করে। আমাদের সময় এসব ছিল না।’
‘থাকবে কী করে? আমাদের বাবা মায়ের শাসন ছিল। তিন ভাইবোন মিলে
খেলতাম। ঝগড়া হত, মারামারি হত আবার বাবা কোনও কিছু কিনে দিলে ভাগ করে
খাওয়াও হত। মনে হিংসে ছিল না। আত্মকেন্দ্রিক ছিলাম না।’
‘সত্যি কী দিন কাল পরেছে। এখন থেকে এদেরকে চোখে চোখে না রাখলে’-
সুলতা ঠিক করেছে আজ বিকেলে রিঙ্কি আর বিপাশাকে নিয়ে ছাদে যাবে।
সেখানে ওদের ছেলেবেলার একটা খেলা শেখাবে। যদি একবার মজা পেয়ে যায় তাহলেআর মোবাইল নিয়ে সারাক্ষণ বসবে না।
‘মা,আমাদের ছাদে আনলে কেন?’
‘একটা খেলা খেলব।’
‘কী খেলা?’
‘তোরা এই ধরনের খেলা কখনও খেলিস নি। একবার খেললে দেখবি কেমন মজা।’
‘তাই!’ রিঙ্কি দেখল, মা চক দিয়ে লম্বা দাগ কেটে আবার ছোট ছোট ঘরের মতো করছে।‘তুমি চক দিয়ে কী করছ?’
‘দেখ না।’ এই বলে সুলতা দশটা ঘর কেটে বলল-‘এটা কিত কিতের ঘর।এবার দেখ কীভাবে খেলতে হয়।’সুলতা আগে থেকেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছিল।ও নিজে
চুড়িদার পরে। তাই ওড়নাটাকে ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে প্রথম দান খেলতে নিল।
‘তোরা দুজনেই ভাল করে দেখ কীভাবে খেলতে হয়।’
‘চু কিত কিত কিত কিত কিত’---করে এক পাক ঘুরে এসে দান শেষ করল।
‘এবার ঘর কিনব।’ সুলতা উলটো মুখে নীচু হয়ে বসল। তার পর হাতের ছোট্ট
গুটিটা ছুড়ে দিল আন্দাজে। দেখল তিন নম্বর ঘরে গিয়ে পড়েছে। ‘এই ঘরটা এখন
আমার।নে এবার রিঙ্কি খেল।’
খুব ধৈর্য্য সহকারে সুলতা ওদের দুই বন্ধুকে চু কিত কিত খেলা শেখাল।
রিঙ্কি বলল-‘আমি আর খেলব না।’
‘কেন রে?’
‘আমার পায়ে লাগছে।’
‘সে তো লাগবেই। হঠাৎ করে লাফঝাপ দিলে পায়ে একটু লাগে। জানিস এই খেলাতে আমার সঙ্গে কেউ পেরে উঠত না। আমি একাই চার পাঁচটা ঘর কিনে নিতাম। আর এমন এমন ঘর কিনতাম যে আমার অন্য বন্ধুরা সেই ঘরেই গুটি ফেলত আর তাতেই আউট হয়ে যেত। আজ প্রথম দিন বলে পায়ে একটু লাগছে। দুদিন খেল, দেখবি পায়ে ব্যথা কমে গিয়েছে।’
বিপাশা বলল-‘কাকিমা দেখ তো আমি ঠিক ঠিক খেলছি কিনা।’
‘হ্যাঁ,ঠিকই তো হচ্ছে। তবে দম ছাড়া যাবে না।একদমে খেলে সবকটা ঘর
ঘুরে আসতে হবে।এই তো খুব সুন্দর হয়েছে। একটা ঘর তুই কিনে নিলি।’
‘কাকিমা দশটা ঘর কেনা হয়ে গেলে কী হবে?’
‘আবার নতুন করে খেলতে হবে।’
পরদিন বিকেল হওয়ার আগেই বিপাশা ডাকতে এল- ‘এই রিঙ্কি আয় ।চু কিত কিত খেলি।’
‘ওহ, দুপুরে যে একটু ঘুমাবো তারও যো নেই দেখছি।’
‘কেন? তোমার আবার কী হল?’
‘ছাদে ধপ ধপ করে পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। এই শব্দে ঘুমানো যায়।’
‘তোমার শুধু ঘুম আর ঘুম। ঘুম ছাড়া আর কী আছে।ওরা একটু খেলছে খেলুক
না। এতদিন তো ঘুমিয়েই কাটালে।এখন ওদের খেলার নেশায় পেয়েছে। কেমন বুদ্ধি
করে বের করলাম বল?’
তমাল সুলতাকে কাছে টানতেই সুলতা সুরুত করে বিছানা ত্যাগ করে বলল-
‘বিকেল হয়ে গিয়েছে উঠে পড়। চা বানাবো।’
0 Comments