যত সব বাগাড়ম্বর...
ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৬ই মে আমার জন্মদিন । তবে যেহেতু বাংলা মতে পয়লা জৈষ্ঠ আমার ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন তাই নিয়ম মাফিক জননী প্রতি বছর ঐ দিন পরমান্ন রাঁধেন। পারিবারিক প্রথা মেনে চিরকাল এটাই হয়ে আসছে । ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভানো ,কেক কাটা এসবের চাষপাট কোনো কালেই ছিল না । ২০০০ সালে উত্তর কলকাতা ছেড়ে দমদমের ফ্ল্যাটে চলে আসার পর একবার দু'বার বন্ধুরা উদ্যোগ নিয়ে সেসবের আয়োজন করেছিল বটে তবে আমার কাছে তা খুবই বিড়ম্বনার বস্তু । মনে হয় যেনো কানাছেলের নাম পদ্মলোচন । সে যাই হোক এবার আসল কথায় আসা যাক । জ্ঞান হবার পর থেকে বহুবার শুনেছি নিজ জন্ম বৃত্তান্ত ।আমার মাতুলালয় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষগ্রামে।আগে নাম ছিল চাংড়িপোতা। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পিতা শ্রী জানকীনাথ বসু পার্শ্ববতী কোদালিয়া নামের গ্রামে এক বৃহৎ অট্টালিকাসম বাসভবন নির্মাণ করেছিলেন।সেই সূত্রে স্বাধীনতা উত্তর যুগে সমগ্র অঞ্চলের নতুন নামকরণ হয় সুভাষগ্রাম । মামারবাড়ীর মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে আমি পৃথিবীর আলো দেখি ।অবশ্য রাত সোয়া বারোটার সময় চতুর্দিক অন্ধকার ছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ।এমন কি তার আগে গোটা দিনটাও ছিল কালো আঁধারে ঘেরা । ১৯৭৪ সালের ১৫ই মে ছিল ভারত বনধ্ ।কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী পালিত হয়েছিল তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল তবে অনুমান করা যায় বাম দল গুলিরই হবে । তবে সাতের দশকের মাঝামাঝি ভয়ঙ্কর সেই রক্তঝরা দিনগুলো যাঁরা পার করে এসেছেন তাঁরা বুঝবেন কি বলতে চাইছি ।আজকের প্রভূত উন্নত ও সর্ব সুবিধাযুক্ত অতি আধুনিকতার ছোঁয়ায় রঙিন সুভাষগ্রাম সেদিন এক গণ্ডগ্রাম বৈ আর কিছু ছিল না।সাহিত্য,নাটক অথবা চলচ্চিত্র থেকে ৪৬ বছর আগের সেই থমথমে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারবে হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম। তবে আমার ক্ষেত্রে তা ঘোরতর বাস্তব । সন্ধ্যার সময় হঠাৎ করেই মা আমার গর্ভ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েন।ছোটমাসি বহু চেষ্টায় একজন সাইকেল রিক্সা চালককে রাজি করাতে সক্ষম হয় ও প্রসূতিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।কোনো প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র নার্স ও ধাইয়ের সহযোগিতায় আমি জন্মলাভ করি । পরদিন সকালে তিন বছর বয়সী আমার একমাত্র সহোদরাকে সঙ্গে নিয়ে দাদামশাই হাসপাতালে উপস্থিত হলেন । মায়ের মুখে শতসহস্রবার শুনেছি নবজাতকের মুখদর্শন করে দাদামশাইয়ের মুখে সেই সময় যে অপার্থিব,অকৃত্তিম ও উজ্জ্বল হাসি ফুটে ওঠে তা নাকি ভুবনে তুলনারহিত।এদিকে আমার পিতৃদেব ছেলের জন্মের ১৯ দিন পর তাকে প্রথম দেখতে জান ।এই নিয়ে মায়ের আমার অভিমানের অন্ত ছিল না । বহুকাল পর্যন্ত তা বজায় ছিল।বাবা কিন্তু হাজার অভিযোগ , অনুযোগের পরেও কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেননি । মৌনতা অবলম্বন করেছেন বরাবর।অনেক পরে মা , দিদি ,আমি আমাদের সকলের সামনে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয় । কলকাতার পরিস্থিতি সেই সময় অগ্নিগর্ভ । বাড়ী বাড়ী পুলিশি খানা তল্লাশি চলছে । বাবা তখন রেডবুক ও ক্যাপিটাল,মাদার্স কারেজ , হাউ দ্যা স্টিল ওয়াস টেম্পার্ড সহ তলস্তয় ,দস্তয়ভস্কি ও আরো আনুষঙ্গিক দেশী বিদেশী একাধিক লেখকের বহু প্রিয় গ্রন্থরাজী গোপনে গঙ্গায় জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হন । তার ওপর তখনি আমাদের সিকদার বাগানের বাড়ীর একান্নবর্তী পরিবারে ভাঙ্গন দেখা দেয় । স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে একাই পৃথগন্ন হবার জেদ করে বসেন আমার বাবা।বিলম্ব হওয়ার আরো একটা বড় কারণ ছিল।ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সক্রিয় কর্মী এই মানুষটি তখন ফ্যাসিবাদ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য প্রচার মূলক পথ নাটকের দল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রান্তে । খুব সতর্ক হয়ে পুলিশের নজর এড়িয়ে অভিনয় করতে হতো । কারণ তখন এই ধরনের সমস্ত জমায়েতের ওপর নিরন্তর হামলা চলেছে।সুতরাং পরিস্থিতি সহজেই অনুমান করা যায়।এক দিকে অফিস অন্য দিকে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন । আবার বাড়ীতে সদ্য তৈরি নিজের সংসার।তাই একা হাতে সব দিক সামলে ঠিক সময়ে পুত্র সন্তানের মুখ দেখতে পৌঁছতে পারেননি । কি নিদারুণ যন্ত্রণা তিনি মুখ বুজে সহ্য করেছেন তা এখন সম্যক রূপে উপলব্ধি করি । সে যাই হোক সেই সব ঝোড়ো দিন আমরা পার হয়ে এসেছি ।
আমাদের ছেলেবেলার অনেকখানি জুড়ে ছিল মামারবাড়ী । স্টেশন থেকে হরিনাভি পর্যন্ত নাক বরাবর যে রাস্তা চলে গেছে নাম তার:আর. এন. চক্রবর্তী রোড যা কিনা আমার দাদামশাইয়ের জ্যাঠামশাইয়ের নামে নামাঙ্কিত।সেই পথেই পায়ে হেঁটে আট মিনিটের দূরত্বে ডান হাতে যে তিন মহলা বাড়ী সেটাই হলো চক্রবর্তী বাড়ী। 'ঘড়িবাড়ী' নামে যেটি সমগ্র অঞ্চলের মানুষের কাছে সমধিক পরিচিত। দাদামশাইয়ের পৈতৃক ব্যবসা ছিল ঘড়ির দোকান । কলকাতার বৌবাজারের রাধাবাজার এলাকায় 'চক্রবর্তী ওয়াচ কোম্পানি' সেই সময়ের এক সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ নাম । মামার বাড়ীতে ছেলেবেলায় ওমেগা গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের গুরুগম্ভীর ঢং ঢং শব্দ শুনে বুকের ভিতরটা দুরদুর করত । সেই 'কোম্পানির' নিদর্শন স্বরূপ বসতবাড়ীর ঠিক মধ্যভাগে দরদালানের ওপর ছাদের পাঁচিলে একটি বিশাল গোলাকৃতি ঘড়ি দুপাশে ঢেউ খেলানো নক্সা সহযোগে সিমেন্ট দিয়ে জম্পেশ করে বসানো হয় । বলা ভালো এক প্রকার প্রতিষ্ঠা করা হয় । সেই থেকে লোকমুখে ভদ্রাসনটি 'ঘড়িবাড়ী' নামে চিহ্নিত হয়ে গেছে । এসব আমার মায়ের পিতামহের কীর্তি । আমার দাদামশাই তখন নিতান্ত কৈশোর ও তারুণ্যের সন্দ্ধিক্ষণে । বয়েস তখন তার মাত্র ১৫ । দাদামশাই গত হয়েছেন ২০১০ সালে ৯৩ বছর বয়সে । অর্থাৎ আজকের হিসাবে ১০৩। আর ঐ ঘড়ির আয়ু হল ৮৮ বছর। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছি নিত্য যাত্রীরা বাড়ীর সামনে সাইকেল থামিয়ে ঐ ঘড়ির সঙ্গে তাদের রিস্ট ওয়াচের কাঁটা মিলিয়ে নিচ্ছে । কারণ তাদের ট্রেন ধরে কলকাতায় আসতে হবে যে ! নির্ভুল সময়ের জন্য তারা ভরসা রেখেছে ঐ বড় ঘড়ির ওপর । প্রায় ৯০ ছুঁই ছুঁই হয়েও সে আজও এখনো বিরাম ও ক্লান্তিহীন ভাবে টিক টিক করে সময়ের জানান দিয়ে চলেছে।
এহেন মামার বাড়ীতে 'ভারি মজা কিল চড় নাই' এমন কথা জোর গলায় বলতে পারি কি ? ক্ষেত্র বিশেষে কপালে তাও জুটেছে বৈকি ! ডানপিটে শিরোমণি বলতে যা বোঝায় আমি মোটেও তাই ছিলাম না । বরং ঠিক উল্টোটাই।যথেষ্ট ক্ষীণজীবি ও দুর্বল ছিলাম । কারণটা একটু পরেই স্পষ্ট হবে । তবে ছোট খাটো বদমাইশি কোন বাচ্ছাটাই বা না করে ? আমিও করেছি আর হাতেনাতে নগদানগদি ফলও পেয়েছি । অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল এই আমি যে বেঁচে থাকবো সেটাই সকলের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল সদ্যজাতকে দেখে ! অবাক হবার মতোই কথা বটে । আসল ব্যাপারটা হলো জন্মের অব্যবহিত পরে আমি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হই ।সেটা আমি মায়ের কাছ থেকেই উপহার হিসাবে পাই।আসন্ন প্রসবা অবস্থায় মা পেয়েছিল কলকাতায় আমার এক জ্যাঠতুতো দাদার কাছ থেকে। সে তার কাকীমাকে আদর করে জড়িয়ে ধরেছিল। ব্যাস আর যায় কোথায় ? শুনেছি আমার ছোট্ট দেহে রোগের প্রকোপ দেখা দেয় প্রবল রূপে । স্খলিত গলিত স্ফোটক গুলি থেকে দুর্গন্ধ যুক্ত পুঁজ রক্ত নিঃসরিত হত অনর্গল । ভয়ে আতঙ্কে সচরাচর আঁতুড় ঘরে কেউ ঢুকতে সাহস পেতো না । বলা বাহুল্য আমি এক অচেতন নির্জীব জড় পদার্থের মতন পড়ে থাকতাম । প্রাণের স্পন্দন টুকুও অনুভব করা কঠিন হতো । এতোটাই দুর্বল সেই শিশু যার মাতৃস্তন্যসুধা পানের ক্ষমতাটুকুও ছিল না। তাছাড়া পক্সের রুগী মা আমার বুকের দুধ খাওয়াবেনই বা কোন উপায়ে ? দিদিমার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে নবজন্ম লাভ করি। মুখে রক্ত তোলা খাটুনি বলতে যা বোঝায় দিদিমা আক্ষরিক অর্থে ঠিক তাই করেছিলেন।সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত আট দশ রকমের লোশন ও মলম মাখিয়ে রাখতে হতো ঐ নামানুষী প্রাণীটাকে । তুলোর সলতে ভিজিয়ে খাওয়াতে হতো ডজন খানেক তরল পথ্য । এই অবস্থার মধ্যেই ছ'মাসের মাথায় অন্নপ্রশন হয় । সেদিন নাকি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল বলে শুনেছি । সে সময় আমি ছিলাম অল মোস্ট রিকেটি শিশুর মতো । চরম সংকটকাল অতিক্রান্ত হলে শুরু হয় অলিভ অয়েল ও কডলিভার অয়েল ম্যাসাজ ।দিদিমার হাতে নিরন্তর তেল মালিশের ফল স্বরূপ এক সময় আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হই । আমার হেঁটে চলে বেড়াতে ও মুখের বোল ফুটতে সময় লাগে বছর দুয়েকেরও বেশী ।পরবর্তী কালে যৎসামান্য হলেও স্কুল টিমে ক্রিকেট ,ফুটবল খেলেছি । খোখো কিম্বা কবাডিতে স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করেছি । সাঁতার কেটে হেদুয়ার সুইমিং পুল এপার ওপার হয়েছি । মাল্টি জিমে গিয়ে পাওয়ার এক্সারসাইজ তাও করেছি । মামারবাড়ীতেই আমার সাইকেল চালানোর হাতেখড়ি।একাধিক বার মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে ছোটমাসি অথবা ছোটপিসির বাড়ী গিয়ে হাজির হয়েছি ।আর যখনই একান্তে এই সব কথা ভেবেছি তখনই বিস্ময়ের চরমসীমা অতিক্রম করে গেছে । মনে মনে বলেছি হে মাতামহী এই প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা জীবন এতো তোমারই দান।
এই মাতুলালয়েই আমরা কুচোকাঁচারা অর্থাৎ মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাই বোনেরা মিলে এবং গাঁয়ের সমবয়সী বাচ্ছাদের সঙ্গে জুটিয়ে নিয়ে দুশো পাঁচশো হাজার রকমের দুষ্টুমি হৈ হুল্লোড় মজা আর আনন্দ করেছি সে সব বলে শেষ করার নয় । কি ছিল না তাইতে ? চু কিত কিত,এক্কা দোক্কা খেলা থেকে শুরু করে আম জাম কাঁঠাল জামরুল পেয়ারার গাছে চড়া, পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জল তোলপাড় করে কাদা ঘোলা করে তোলা ,সেই জলে ভেসে ওঠা চুনোচানা মাছগুলো গামছা দিয়ে ছেঁকে তোলা আর তারপর বাড়ী ফিরে অবধারিত ভাবে বকাবকুনির সন্মুখীন হওয়া।
"এই অবেলায় তোরা এককাঁড়ি মাছ এনে জড়ো করলি ? কুটবে বাছবে কে ? আঁশ ছাড়াবে কে শুনি ? তোদের জ্বালায় আর পারিনা বাপু ! সবক'টা হয়েছে সমান । লেজ কাটা হনুমানের দল ।" ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে আমরা নিশ্চিত জানতাম সামনে যতই রাগ দেখাক না কেনো মা মাসী মামীমা এরা সবাই মিলে সস্নেহে সেগুলি রান্না করে দেবেই দেবে । হতোও ঠিক তাই। আমরা পরম তৃপ্তি ভরে সেই ঝালঝাল চুনোমাছের বাটিচচ্চড়ি দিয়ে ভাত মেখে মুখে পুরতাম।আহা অপূর্ব ! নিজেদের ধরা মাছ বলে কথা!তার স্বাদ স্বর্গীয় হবে বৈ কি ! আবার যেমন গাছের ডালে দোলনা বেঁধে দোল খাওয়া এবং কে আগে দুলবে , কে বেশিক্ষণ দোল খাচ্ছে সেই নিয়ে তুমুল ঝগড়া করা , বাগানে বন ভোজনের আয়জন করা, শীত কালে চুটিয়ে ব্যাটমিন্টন খেলা,গাছ থেকে বাতাবি লেবু পেড়ে তাই দিয়ে ফুটবল খেলা কোনটা বাদ গেছে ? ঢিল মেরে গাছ থেকে পাকা কতবেল অথবা পাকা তেঁতুল পাড়া,তারপর অতি সংগোপনে রান্নাঘর থেকে সরষের তেল নুন চিনি কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি জোগাড় করা। বাগানে একটি ছায়া সুনিবিড় শীতল জায়গা বেছে বসা হত। পরিত্যক্ত শুকনো নারকেল মালায় সেটি জম্পেশ করে মাখা হত।এবার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার পালা । বাড়ীর ভিতর থেকে হাঁক পড়তো
"এ্যাই তোরা সব কি করছিস রে ?
কিছু না ।
কিছু না তো বাগানে কেনো ?
এমনি । "
এই কিছু না মানে যে অনেক কিছু সেটা বড়রা বিলক্ষণ বুঝতে পারতো । অর্থাৎ আমরা এমন কিছু করছি যা আমাদের করা অনুচিৎ বা মানা করা হয়েছে।কিন্তু নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের মজাই আলাদা । বলে কোয়ে অনুমতি নিয়ে করলে কি আর সে আনন্দ বজায় থাকে !
সিন্নি খেতে কোনো কালেই আমার ভালো লাগতো না, আজও লাগে না।কিন্তু প্রতি পূর্ণিমায় মামার বাড়ীতে যে সত্য নারায়ণের সিন্নির আয়োজন হতো সেটা এক জমজমাট ব্যাপার ছিল । সেই ফলমুলাদি মিষ্টান্ন ও দীপ ধুপ ধুনোর গন্ধে ভরা পুজোর পরিবেশ সেদিনও যেমন প্রিয় ছিল আজও তেমনটাই আছে । সব চাইতে বড় পাওনা ছিল কাঁসর বাজানো। আরতির সময় দিদিমা বাজাতেন শাঁখ,দাদা মশাইয়ের ডান হাতে থাকতো পঞ্চপ্রদীপ আর বাম হাতে ঘন্টা । আমি কাঁই নানা কাঁই নানা বোল তুলে মনের আনন্দে কাঁসর বাজাতাম । কেউ যদি ভুল করেও সে বস্তুটি আমার হাত থেকে নিতে চাইতো তাহলে আর রক্ষে নেই । বাড়ী মাথায় করে তুলতাম একেবারে । দোল পূর্ণিমার আগের দিন ন্যাড়া পোড়াকে কেন্দ্র করে আমাদের সে কি উৎসাহ ! কাঠ কুটো শুকনো নারকেল পাতা ইত্যাদি জড়ো করে একটা বড়সড় স্তূপ তৈরী করা হতো,তার পর সন্ধ্যায় তাইতে অগ্নি সংযোগ হতো । সেই লেলিহান শিখাকে বৃত্তাকারে ঘিরে নাচতে নাচতে হাততালি দিয়ে আমরা ছড়া কাটতাম "আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া,কাল আমাদের দোল।পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে গৌর হরি বোল ।" পরের দিন সারা বেলা রং মেখে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ানো । সময় অতিক্রান্ত হলেও এঁড়ে গরুর মতন ঘরে ফিরতে না চাওয়ার জেদ ধরে বসে থাকা । ফলে কপালে জুটতো কানমোলা ও চপেটাঘাত । এর পর বলপূর্বক টিউব ওয়েলের তলায় বসিয়ে পাম্প করতে থাকা ও সাবান ঘষে ঘষে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার অপচেষ্টা চলতে থাকতো। অবশেষে খেতে বসে যখন পাতের ভাত মাখতাম তখন মনে হতো যেনো লাল নটে শাক দিয়ে মাখছি।আবার দীপান্বিতায় গোটা বাড়ী সাজাতাম প্রদীপের আলোয় আর কালীপুজোর রাত ছিল আতস বাজীর রোশনাইতে ভরা । মনের সাধ মিটিয়ে হরেক কিসিমের বাজী ফাটাতাম আমরা । তবে আমাদের কাছে সেই সময় সব চাইতে বড় আনন্দযজ্ঞ ছিল ২৫শে বৈশাখে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করা । সেই গোল ঘড়ি যুক্ত দরদালানই সেদিন আমাদের মঞ্চ হয়ে উঠত । পর্দা টাঙিয়ে আলো জ্বালিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড বাঁধিয়ে ছাড়তাম আমার । সাত দিন আগে থেকে ঢেঁড়া পেটানোর ফলে গ্রামের সমস্ত লোকজন সন্ধ্যায় জড়ো হতো বাড়ীর সামনের উঠোনে । ছড়া কবিতা গান নাচ এসব তো ছিলই তবে মুখ্য আকর্ষণ ছিল হস্যকৌতুক বই থেকে শারাড্ বা হেঁয়ালি নাট্যের অভিনয় ।আর এই সব কিছুর মধ্যমণি ছিলেন স্বয়ং আমার পিতৃদেব। অনুষ্ঠানের দু'আড়াই মাস আগে থেকে নিয়ম করে প্রতি শনি-রবিবার কলকাতা থেকে সুভাষগ্রামে গিয়ে মহড়া দেওয়াতেন । মেক-আপ আর্টিস্টদের কাছ থেকে পরচুলা , বিশেষ প্রয়োজনে পোশাক পরিচ্ছদ এবং প্রপস ইত্যাদি ভাড়া করে নিয়ে যেতেন । নিজে হাতে সকলের রূপসজ্জা নির্মাণ করতেন আর আয়োজন করতেন এলাহি জলযোগের । বাচ্ছা বুড়ো সকলের জন্য থাকতো সে ব্যবস্থা । সে যে কি বর্নবহুল অনুষ্ঠান হতো তা বলে বোঝাতে পারবো না । একবার আমার দিদির পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়েছিল 'অভিসার' নৃত্যনাট্য । আমি সন্যাসী উপগুপ্তের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম । গোটা গাঁয়ের মানুষ দেখে ধন্যি ধন্যি করেছিল সেদিন । এতোটাই আপ টু দ্যা মার্ক হতো আমাদের প্রগ্রাম যে আসেপাশের বিভিন্ন ক্লাব থেকে ডাক পড়তো ।
আজ এই ভয়ঙ্কর জীবাণু আক্রান্ত ও আতিমারী অধ্যুষিত সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ৪৬ অতিক্রম করে ৪৭ এর দোরগোড়ায় পা রেখে হৃদয়ের তন্ত্রী গুলি বারংবার নস্টালজিক হয়ে পড়ে । মস্তিষ্কে অনুরণন তোলে কবির সেই অমোঘ বাণী :
"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে
মালয় সাগরে।"
ঋণের ভারে, কৃতঘ্নতায় ,অসীম শ্রদ্ধায় মাথা আনত হয়ে আসে সেই সব মহাজীবনের চরণতলে । যাঁদের দয়া, করুণা ও আশীর্বাদ ব্যতীত আমার কোনো অস্তিত্ব নেই,থাকতে পারে না । সোচ্চারে অথবা নিরুচ্চারে যেনো বারংবার বলে উঠি :
"আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পূণ্য করো এ জীবন পূণ্য করো এ জীবন পূণ্য করো দহন দানে ।"
0 Comments