শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ: একটি ধারাবাহিক অনুশীলন
একটা শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন তাকে একটা শারীরিক কাঠামো ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। তারপর ধীরে ধীরে একটা ধারাবাহিক অনুশীলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে সামাজিক জীব পরিণত হয় যাকে আমরা সামাজিকীকরণ বলে থাকি। বলা যেতে পারে যে একজন শিশু জন্মসূত্রে সামাজিক জীব হিসেবে পৃথিবীতে আসেনা, আবার সেই সময় তাকে পশু জগত থেকেও আলাদা করে ভাবা যায় না, কিন্ত ক্রমে ক্রমে সামাজিক পরিবেশে সে সামাজিক জীবে পরিণত হয়, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়, তখন পশু জগত থেকে সে স্বতন্ত্র দাবি করে, ধারাবাহিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়ে সে সমাজে পা রাখার ছাড়পত্র লাভ করে।
একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরবর্তী সময়ে সমাজ সম্পর্কে প্রায় পুরোপুরি অজ্ঞাত থাকে, সমাজ তার কাছে কি আচরণ আশা করে সে সম্পর্কে সে পুরোপুরি অজ্ঞ, অর্থাৎ সমাজের নিয়ম কানুন, মূল্যবোধ সম্পর্কে তার কোন ধারণা থাকেনা। এরপর বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে, বিশেষ করে মায়ের সহচার্যে সমাজের বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে জানতে পারে বা বুঝতে পারে, ফলে সমাজে তার অংশিদারী নিশ্চিত হয়। তার পরবর্তী কালে পিতা মাতা, সঙ্গী সাথী ,আত্মীয়-স্বজন ,পাড়া-প্রতিবেশী ,বিদ্যালয় প্রভৃতির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়। এটি একটি ধারাবাহিক অনুশীলন, এই অনুশীলন প্রক্রিয়াকে সমাজবিজ্ঞানী কিম্বাল ইয়ং মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করে বলেন, সামাজিকীকরণ সেই প্রক্রিয়া যার দ্বারা একটা শিশু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করে, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্য হয়, তাছাড়া সমাজের বিভিন্ন আদর্শ,রীতিনীতি,মূল্যবোধ স্বীকার করার প্রেরনা পায়।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সামাজিকীকরণ একটি দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলন প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন শিশুর ধীরে ধীরে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে এবং এটা শুরু হয় শৈশব থেকেই। এই সময় পর্বে শিশুর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যেগুলি সামাজিকীকরণের অনুকূলে বা প্রতিকূলে চালিত হয়। এসব বৈশিষ্ট্য গুলি হল অভিব্যক্তি, সহজাত প্রবৃত্তি, জেদ এবং ধারণক্ষমতা। মানুষের মনে কোন প্রকার মানবিক উত্তেজক তথ্য প্রতিফলিত হলে তাকে বলা হয় অভিব্যক্তি, মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে পর্যালোচনা করে তার আচার-আচরণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। মনোবৈজ্ঞানিক ফ্রয়েড এই ধারণার অন্যতম প্রবর্তক, তবে অনেকেই এই ধারণা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন, তাদের মতে শিশুর মধ্যে থাকে সহজাত প্রবৃত্তি সমূহের কতগুলি উপাদান মাত্র তাই এর উপর ভিত্তি করে আচার-আচরণ নির্ধারণ করলে তা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে, মানবীয় আচার-আচরণ একটি পরিবর্তনশীল উপাদান হিসেবে কাজ করে, আর জেদ একটি শিশুর আচরণগত বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কার্যকরী হয়। বলা যেতে পারে যে, প্রত্যেক শিশু কিছু ধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় যা পরবর্তীকালে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়।
একটা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে বেশ কিছু উপাদান কাজ করে যা সামাজিকীকরণ অনুশীলনের মাধ্যমে সংঘটিত হয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিপালন, সাধারণত পিতা-মাতারা প্রচলিত সমাজের ভাবী সদস্য হিসেবে তাদের শিশুকে প্রতিপালন করে থাকে, যার ফলে একদিন শিশু সুনাগরিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। পিতা-মাতারা তাকে নিরাপত্তা বিধান করে সহানুভূতির মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব বিকাশে চেষ্টা করেন, এরপর একজন শিশু সমাজের ভালো-মন্দ জিনিস চিনতে শেখো। সামাজিকীকরণের আরেকটি অন্যতম প্রধান মাধ্যম যা একজন শিশুর ব্যক্তিত্বকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে তা হল অনুকরণ, এক্ষেত্রে শিশু তার পরিবারের বাবা-মা, কাকা কাকি, দাদা দিদি, ইত্যাদির আচরণ অনুকরণ করতে শেখে, যা একজন শিশুর আদর্শ এবং ব্যক্তিত্ব গঠনের অন্যতম উপাদান হিসেবে কার্যকরী হয়। যেহেতু গৃহ হল একজন শিশু অন্যতম পাঠশালা, তাই বড়দের আচার-আচরণ তার ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলা, শালীনতাবোধ, আনুগত্য প্রভৃতি ঞ্জান সে পরিবারের মধ্যেই আয়ত্ত করে। এরপর একজন শিশু যখন আরও বড় হয তখন সে বন্ধুবান্ধব গোষ্ঠীতে প্রবেশ করে, সেখানে সে আধুনিক রীতিনীতি, সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা প্রভৃতি গুন অনুশীলন করে, এছাড়া অপরের মাধ্যমে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি গুলি সংশোধন করে। বিদ্যালয় একজন শিশু নিয়ম-শৃঙ্খলা, আচার-আচরণ প্রভৃতি ঞ্জান আহরণ করে, বিভিন্ন নীতি শিক্ষা অর্জন করে। শিক্ষাবিজ্ঞানের এক অন্যতম লেখক ইভান ইলিচ এই প্রসঙ্গে স্কুল বিহীন সমাজের কথাও উল্লেখ করেছেন, যেখানে একজন শিশু ঘোষিত পাঠক্রমের বাইরে অনেক কিছু গোপন পাঠক্রম রপ্ত করে, যাএকজন শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ কার্যকরী হয়। একজন শিশুর সামাজিকীকরণে বা ব্যক্তিত্ব গঠনে শিক্ষা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম বলেন শিক্ষা হলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে সামাজিকীকরণের অন্যতম মাধ্যম।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা ভালো যে সামাজিকীকরণ যদি সঠিক পথে হয় তাহলে একটা শিশু ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে, আর সামাজিকীকরণ যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় সে ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিত্বের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে,তবে একথাও ঠিক, পুনঃ সামাজিকীকরণ এর মাধ্যমে তার সংশোধন ও হতে পারে,যার ফলে শ্রদ্ধা, ভক্তি,নিষ্ঠা ,মূল্যবোধ প্রভৃতি অসংখ্য সুকুমারবৃত্তি জাগরিত হতে পারে।
সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবেশ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাধীনভাবে দেখা যায় যে সব সমাজে সামাজিক পরিবেশ অস্থির প্রকৃতির, যেমন চুরি ডাকাতি ,ছিনতাই , খুন জখম, রাহাজানি ইত্যাদি বেশি সেই সমাজে শিশুদের ব্যক্তিত্ব ঠিকমতো বিকশিত হয় না, তারা ছোটবেলা থেকেই চোখের সামনে এসব জিনিস গুলো দেখতে পায়, ফলে তাদের ব্যক্তিত্বে একটা বিশাল প্রভাব পড়ে, তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে,কখনো কখনো নিরাপত্তাহীনতার জন্য ব্যক্তিত্ব ঠিকমতো বিকশিত হতে পারে না। তবে একথা সত্য যে একটা পচা আলু যেমন বস্তার সমস্ত ভালো আলু কে নষ্ট করে দিতে পারে তেমনি নীতিহীন সমাজ বা ব্যক্তি মানব প্রকৃতির ভালো গুণগুলো ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে। এই প্রসঙ্গে সর্বকালের সেরা ফরাসি দার্শনিক রুশো তার বিখ্যাত 'এমিল' গ্রন্থে জোরালো সওয়াল করে বলেন একজন শিশুর জঙ্গলের পরিবেশে মানুষ হওয়া উচিত, যাতে সমাজ তার ভালো গুণগুলো নষ্ট করে না দিতে পারে। সত্যি করে বলতে কি বর্তমান সমাজে যেভাবে মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে তাতে একজন শিশুর সামাজিকীকরণ বিঘ্নিত হওয়ায় স্বাভাবিক, কারণ সেখানে একজন আদর্শ শিশু তৈরি হতে পারে না, যা হতে পারে তা নীতিহীন, বিবেকহীন, মূল্যবোধহীন ছাড়া আর কিছু নয়। তবে একথাও ঠিক সামাজিক পরিবেশের তারতম্যের কারণে একজন শিশুর ব্যক্তিত্বের তারতম্য ঘটে, কারণ শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে সামাজিক পরিবেশ সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।তবে একথাও আবার ঠিক একই পরিবেশে শিশুর ব্যক্তিত্বের তারতম্য ঘটে এমন প্রমাণ অনেক আছে।
যাই হোক একজন শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিষয়টি একাধিক মনোবৈজ্ঞানিক তাত্ত্বিক পেক্ষাপটে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন,এই প্রসঙ্গে আমরা কুলি,মিড, পিয়াঁজ, ফ্রয়েড প্রমুখ ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করতে পারি। কুলি মনে করেন অহং (self) অন্যের সংস্পর্শ ছাড়া জাগ্রত হয়না,অর্থাৎ নীতি ,আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রভৃতি অন্যের মাধ্যমে জাগ্রত হয়, যা একজন শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। কুলির সাথে একমত হয়ে মিড বলেন, অহং সামাজিক এবং আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে তা জাগ্রত হয়। তিনি আরো বলেন মানব বিকাশের প্রাথমিক স্তরে একজন শিশু তার চারপাশে জগতের আচার-আচরণ মূল্যবোধ প্রভৃতি আয়ত্ত করে ফলে তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়। সমাজস্বীকৃত প্রচলিত রীতি নীতির শৃঙ্খলায়িত অনুশীলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড এর পিঁয়াজের দর্শনেও আমরা অনুরূপ ব্যাখ্যা পাই।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি,সামাজিক পরিবেশে একটা দীর্ঘমেয়াদী সামাজিকীকরণ অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজস্বীকৃত রীতিনীতি, আদর্শ, নৈতিকতা, বিশ্বাস,মূল্যবোধ সমূহ রপ্ত করে একজন শিশু মানব শিশুতে পরিণত হয়। আবার মানব শিশু তিলে তিলে দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়ে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে ওঠে,সমাজের ভাবী সদস্য হিসেবে,ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
0 Comments