তপতী বাসুর গল্প


বিয়ে বাড়ীর ভূত

ছোট পিসির বিয়ে।তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি।বিয়ে হবে সাঁওতাল পরগণার জামতাড়ায়।কারণ পাত্রের বাড়ী ওখানে,আর আমার কাকা জামতাড়ার ষ্টেশন মাষ্টার, কোয়ার্টারে বাস।
সবাই মিলে প্রায় জনা তিরিশেক আমরা।তাই কাছে একটা প্রায় এক বিঘা জমির ওপর পাঁচিলে ঘেরা বাড়ী দশদিনের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে। 

সেই সময় মধুপুর,শিমূল তলার মতো জামতাড়াতেও অনেক বাঙালির এমন বাড়ী ছিল।এটাও বিশাল বাড়ী,বড়ো বড়ো ঘরে,তিনদিকে মোটা থাম দেওয়া প্রশস্ত বারান্দা।বাকি জায়গায় কিছুটা ফাঁকা, কিছুটা বড়ো গাছ, ঝোপঝাড়। জলের জন্য পিছনে বড়ো এবং গভীর পাতকূয়া।

দোতলায় কোণের দিকে দুটো ঘর নিয়ে এক ভদ্রলোক থাকেন, ভূপেন মজুমদার। মোটামুটি তিনি বাড়ীটা দেখভাল করেন।
বিয়ে বাড়ীর জমজমাট।একসাথে সবাই কতো আমোদ আল্হাদ।বাড়ীটার কেয়ারটেকার এক স্থানীয় সাঁওতাল।অদ্ভুত দেখতে---তালঢেঙা লম্বা,ড্যাবড্যাবে চোখ,কুচকুচে কালো,সামনের দাঁত গুলো বড়ো কিন্তু ধবধবে সাদা।লোকটা সকালে ব্যবহারের জন্য যখন কূয়ো থেকে জল তুলছিল তখন বোঝা গেলো লোকটা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে।
           
ছোটোরা একজায়গায় হলে নানা দুষ্টুমি,ফন্দিফিকির চলে।তার ওপর এতো জায়গা,দৌড়াদৌড়ি,হুটোপুটি চলছিলো ই।কাকু প্রথমেই বারণ করে দিয়েছিল পিছনের ঝোপঝাড় আর কূয়োতলায় যাওয়া চলবেনা।
মাঘ মাস বেলা চারটে বাজতে না বাজতেই অন্ধকার নামতে শুরু করে। দুপুরে ঢাকা বারান্দায় সবাই খেতে বসেছি, হঠাৎ দেখি সেই লোকটা একটা শাল পাতার থালা নিয়ে হাজির।মুখে একগাল হাসি।দেখে আমাদের মনে হলো লোকটা নিশ্চয়ই ছোট বেলায় শোনা গল্পের 'একানড়ে' হবে।আর একানড়ে মানেই ভূতের নিকট আত্মীয়।
ওকে খেতে দেয়া হলো। আমাদের থেকে একটু দূরে উবু হয়ে বসে খেতে লাগল আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হাসতে লাগলো।আমরা ভয়েই হোক বা কৌতুহলে হোক ধীরে ধীরে খেতে থাকলাম, দেখছিলাম কি প্রচুর পরিমানে ভাত খাচ্ছিল। সন্দেহ  রৈলো না একানড়ে নিশ্চিত।
                     
খাওয়া শেষে আমরা পরামর্শ করলাম, একরাতে বড়োরা শুয়ে পড়লেই আমরা চুপিচুপি বাইরে বারহবো, চাক্ষুষ দেখবো ভূত। কিন্তু আমাদের প্ল্যান ভেস্তে গেল।দাদা,বড়ো পিসির ছেলে,রাতে উঠে বাথরুমে যাচ্ছিল---হঠাৎ ' ওরে বাবা ভূ---ত বলে এক চিৎকার,সবাই লাঠি, টর্চ ইত্যাদি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে বারান্দার সিঁড়ির নীচে দাদা অচেতন পড়ে আছে।
           
ভিতরে তুলে এনে, চোখেমুখে জল দিয়ে তার চেতনা ফেরাবার পরতার কাছেই শোনা গেল---'আমি ঘর থেকে বেরিয়ে কূয়োতলার পিছনে বাথরুমে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বারান্দার আবছা আলোয় দেখি পিছনে যে বড়ো গাছ, ঝোপঝাড় জটলা করে আছে,সেখানে সাদাটে একটা কিছু নড়াচড়া করে গাছের আড়ালে মিলিয়ে গেল'।
বড়ো রা সবাই ও কিছুনা,ঘুম চোখে কি দেখেছিস।ভয়ের কিছু নেই বলে শুতে চলে গেল।
আমাদের কৌতুহল ,ভয়, উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল। পরদিন ঠিক করলাম আজ রাতে একসাথে সবাই বার হবো।একানড়েই যে ভূত তাতে আর সন্দেহ নেই।

দুপুর বেলা আগের দিনের মতো লোকটা খেতে এলো। সেদিন একটু কাছাকাছি বসে আমাদের সাথে নীচু গলায় কথা বলতে লাগলো।তার মধ্যে একটা কথা আমরা কান খাড়া করে শুনলাম---ভূপেন বাবুর স্ত্রী ও ঘরেই ছয়,সাত বছর আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।এখনো তার আত্মা এ বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়।ব্যস, আমাদের একটা কাজ বেড়ে গেল।
সেই রাতে আমরা ক'জন ঘরের বাইরে বের হয়ে বারান্দার এক একটা থামের আড়ালে দাঁড়ালাম এক জাঠতুতো বোন সুনু খুব ভীতু ছিল বলে ওকে দলে রাখতে চাইছিলাম না, কিন্তু নাকে কান্না কেঁদে ঠিক আমাদের সাথে এল।
                     
চারদিক নীরব, নিশুতি,একটা গা ছমছমে ভাব। আমরা দাঁড়িয়ে আছি।মশা কামড়াচ্ছে ,মারতে পারছিনা শব্দ হবার ভয়ে। হঠাৎ দেখি বাঁধানো কূয়োর পাঁচিলে র ধার থেকে কিছু একটা জন্তুর হামা দেবার মতো সামনে পিছনে দুলছে।আরো মনে হলো যেই হোক না কেন সে কূয়োর ভিতর থেকে উঠে এসেছে।।ব্যস,সুনুর হাউমাউ কান্না। আগের দিনের মতো সবাই দৌড়ে এলো। ঠিক সেই মুহূর্তে কূয়োর পাশের রাস্তা ধরে একানড়েও হাজির।রাতে ভালো দেখতে পায়না বলে হাতে একটা তেড়াবাকা লাঠি। আমাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হলো।আমরা বড়োদের কিছু বলতে চাইনি,সুনুটা ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করে সবকিছু বলে দিল।একটু আধটু বকাঝকা করে যে যার জায়গায় শুতে গেলাম।
             
পরদিন বিয়ে। সকাল থেকেই সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। আমাদের সেখানে কোনো কাজ না থাকলে ও...গঙ্গা জলের শিশিটা আন, আমের পল্লবটা দে,খাবার সময় জল দে,নুন দে ইত্যাদি জবরদস্ত কাজে ব্যস্ত থাকলাম। সন্ধ্যার সময় বর এলো,বরযাত্রী নিয়ে।বিয়ে আরম্ভ হলো। সবাই মোটামুটি ভুলেই গিয়েছিলাম ভূত অধ্যায়। কিন্তু হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে একানড়ে কেখাটো ধুতি,একটু পরিস্কার জামা,আর মাথায় কবেকার একটা পাগড়ী পরা দেখে ভূত ব্যাপারটা আবার মাথার মধ্যে নড়েচড়ে উঠলো।একটু সুযোগেই আবার ঠিক করলাম সবাই মিলে,রাতে সবাই ক্লান্ত থাকবে,সেই সুযোগে ভূপেন কাকার ঘরে যাবো।তার ঘর খালি থাকবে কারণ তিনি তো আমাদের বাড়ীর সবাইয়ের সাথে ব্যস্ত।
       
বিয়ে হয়ে গেছে, বরযাত্রী, নিমন্ত্রিত অতিথিরা চলে গেছে।মায়েরা বাসর ঘরে হাসি তামাশায় মগ্ন।এই সুযোগ,আমরা পা টিপে টিপে দোতলায় উঠলাম।
বিয়েবাড়ির বেশির ভাগ আলোক সজ্জা নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।আবছা আলো আঁধারে আমরা ভূপেন কাকার ঘরে।পুরোনো বাড়ি অল্প বাতাসে দরজা জানলায় ক্যাচকোচ শব্দ। হঠাৎ দেয়ালের গায়ে একটা ছায়া ছায়া হাত। পাঁচ টা আঙ্গুল পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে।একটা সাদা ছায়া দরজার কাছে দুলে উঠলো। দেয়ালের হাতটা নড়েচড়ে উঠলো মনে হলো ইশারা করছে।ভয়ে সবাইয়ের গলা শুকিয়ে গেছে।ঠিক সেই মুহূর্তে একটা তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ যেন ছাদের ওপরে।ভয়ে সবাই হুড়মুড়িয়ে নামতে গিয়ে এ ওর ঘাড়ে পড়ে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।তারমধ্যে সুনুর কান্না।সবাই দৌড়ে হাজির,এমন কি নতুন পিশেমশাই পর্যন্ত।
         
তারপর এইমারে,সেই মারে ব্যাপার।এরপর থেকে কলকাতার ট্রেনে ওঠার অবধি সবাই একরকম নজরবন্দি হয়ে থাকলাম।
কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাস ঐ একানড়েই ভূত।

সাহিত্যিক তপতী বাসু
সিভিডি বেলাপুর, নভি মুম্বাই, ভারত
















0 Comments