ভুলের চারাগাছ
স্মিথদের বাগানের চিপমংক আর জোন্সদের ব্যাকইয়ার্ডের কাঠবিড়ালী।
চিপমংক দেখতে কেমন জানো কি তোমরা?
কাঠবিড়ালীর মতোই দেখতে। একই জাতের জাতভাই কিনা। তবে অনেক ছোটখাটো। তিন থেকে চার ইঞ্চি লম্বা। গায়ে বাদামীর ওপর সাদাকালো লম্বালম্বি ডোরা। লেজটি ছোট।ছোট্ট শরীরটি নিয়ে ফুড়ুৎ করে নিমেষে উধাও হয়ে যায়।এই আছে তো এই নেই।
কাঠবিড়ালীর লেজ তো জানো,কেমন লি-কার(৯) হয়ে থাকে? ফুরফুরে লোমে ভর্তি।লেজ ফুলিয়ে কাঠবিড়ালী যখন বসে থাকে,হাওয়ায় সেই ঘন লোমে কাঁপন লাগে। সে এক দেখবার মত দৃশ্য বটে।
কাঠবিড়ালী গাছে গাছেই ঘোরে। এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে বেড়ায়,ওক গাছের মগডালে দুলে দুলে ওক গাছের ফল একর্ন খায়। আর খায় পাখির খাবার। জোন্স-বাড়ীর ছেলে জোনাথন বার্ড ফিডার ঝুলিয়ে তার মধ্যে পাখির খাবারের দানা রেখে স্কুলে যায়। স্কুল থেকে ফিরে দেখে সে খাবার সব শেষ! কে সাবাড় করেছে বুঝতে বাকী থাকে না! খেয়ে খেয়ে কাঠবিড়ালী এমন মোটা হয়েছে যে সে আর বলার নয়।জোনাথন ওকে দু'চক্ষে দেখতে পারে না। নাম দিয়েছে - 'গোদা'।
চিপমংক কিন্তু মাটিতেই থাকে। গর্ত খোঁড়ে। যে দুটো একটা দানা বার্ড ফিডার থেকে মাটিতে পড়ল, তাই নিয়েই সে খুশি। জোনাথন চিপমংককে পছন্দই করে। যদিও তার মা প্যাটির ধারণা তার চেরি টমেটো গাছের সব টমেটো চিপমংকের পেটে যায়।
তখন গ্রীষ্ম শেষ হয়েছে। পর্ণমোচী ওক-মেপলের পাতায় লাল-হলুদ-খয়েরী রং ধরেছে। অটাম কালার। হাওয়ায় শিরশিরানি ঠান্ডা। সেরকম এক আশ্বিনের দিনে দেখা হলো দুজনায়। কাঠবিড়ালী আর চিপমংক। দুজনেই খাবার জোগাড় করতে ব্যস্ত। হন্তদন্ত হয়ে দু'জন দু'দিকে যাচ্ছিল। সামনে শীত আসছে। লম্বা শীতকালের জন্যে খাবার তো জমাতে হবে? রকমারী বাদাম, ফুলের বীজ, ছোট ছোট বেরি, ওক গাছের ফল একর্ন - কোনো কিছুই বাদ নেই। যেখানে যা পাওয়া যায়।
গোদা-ই প্রথম দেখল।
"কী রে চিপু,চললি কোথায়? মুখে কী?লুকোচ্ছিস কেন? আমি কী কেড়ে নেবো নাকি?
"তোমার পায়ে পড়ি বিলুদাদা, শীতের জন্যে নিজে তো অনেক একর্ন আর নাট্স জমিয়েছো, আমার এই ছোট্ট কাঠবাদামের দিকে আর তাকিয়ো না।"
"মারবো টেনে এক থাপ্পড়, কেবল আমার নাটসের দিকে নজর! কত কষ্টে জোগাড় করতে হয়,লুকিয়ে রাখতে হয় - তা জানিস? "
"সে আর জানিনে? শীতের খাবারের ধান্দায় ওক গাছেই তো সারাক্ষণ লাফিয়ে বেড়াচ্ছ। বলি, এতো একর্ন আর নাট্স রাখছো কোথায়? আমার মতো মাটির তলায় গর্তও তো খুঁড়তে দেখি না।"
"হুঁ হুঁ বাবা, লুকোনোর জায়গা আছে। বলবো কেন তোকে?"
"বোলো না, আমার ভারি বয়ে গেছে। আমি চললুম। জোন্সদের বাগান থেকে সূর্যমুখীর বীজ খেয়ে আসি। থালার মতো এক একটা সূর্যমুখী। ফুলের ওপর দুলতে দুলতে সানফ্লাওয়ার সীড খাওয়ার কী যে মজা!"
"তাই নাকি রে? তাহলে আম্মো যাই।"
"যাবে? তা চলো। তবে খেয়ে খেয়ে তোমার যা ওজন, তাতে অমন বিরাট সূর্যমুখীও ঘাড় মটকে পড়বে।"
"এই, নজর দিবি না বলছি। নেহাত এদের ব্যাকইয়ার্ডে মেলা ওক গাছ, তাই খিদে পেলে দুটি চারটি একর্ন খাই।"
"শুধু একর্ন? জোনাথনের বার্ড ফিডারের সব দানা তো তুমিই খাও দেখি। পাখিরা আর ক'টা দানা পায়? রোজ জোনাথন তোমায় গাল দেয়। শুনতে তো পাই সবই।"
"না রে চিপু। এখন পাখির খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সব আমার পেটেই যায় কিনা। তাই বার্ড ফিডার ফাঁকা।"
"দুঃখ করো না বিলুদাদা। সূর্যমুখীর টাটকা বীজ খেয়ে দেখো, কোথায় লাগে তোমার স্টোর থেকে কেনা বাসি বার্ড ফুড!"
দুজনে মিলে মনের আনন্দে সূর্যমুখীর ঘাড় মটকায়।
পড়ার টেবিল থেকে জোনাথন দেখতে পেয়ে চেঁচায়, “মা, তোমার সূর্যমুখীর দফা-রফা হলো।“
রৈ-রৈ করে তেড়ে আসে জোনাথনের মা প্যাটি। দুজনে সঙ্গে সঙ্গে উধাও।
এই করে করেই একদিন শীত আসে, বরফে ঢাকে মাটি। কাঠবিড়ালী চিন্তিত মুখে হনহনিয়ে বরফের ওপর দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করে। কিসের যে এতো তাড়া কে জানে?
জোনাথন ভাবে, গোদা যায় কোথায়? এখন আর কোন গাছের বাদাম পাবে ও?
আসলে কিন্তু গোদা খুঁজে বেড়ায় লুকিয়ে রাখা খাবারগুলো। গ্রীষ্মের আদ্ধেক সময় ও কাটিয়েছে নাট্স পুঁতে। আর পরমুহূর্তেই ভুলে গেছে কোথায় সেগুলো পুঁতেছে। তাই খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর।
চিপমংক সে সময় মাটির তলায় নিজের গর্তের মধ্যে ঘুমুচ্ছে। শীতঘুম। অল্পস্বল্প খাবারেই ওর চলে যায়। ওই গর্তের মধ্যে যা খুদকুঁড়ো আছে তাতেই যথেষ্ট।
কষ্টের শীতকাল কেটে অবশেষে বসন্ত আসে। বরফ গলেছে। চেরিগাছে থোকাথোকা ফুল দোলে। ওক, উইলো আর মেপলে কচি কচি পাতা। আহা,কী রং সে কিশলয়ের।
বসন্তে দুই মক্কেল আবার মুখোমুখি। খিদেয় গোদা-র পেট জ্বলছে। গালে হাত।
"একর্নগুলো কোথায় লুকিয়েছিলুম বল দেখি?"
"তুমি কি আমায় বলেছিলে নাকি? দ্যাখো, কোথায় কোন টবে, গাছের গোড়ায় পুঁতে রেখেছো।"
"না রে, তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাচ্ছি না।"
"ও তো তোমার ফি বছরের গপ্পো। দুনিয়ার যত গাছ হাঁটকে নাট্স আর একর্ন জমাও। তারপর কোথায় যে লুকিয়ে রাখো, নিজেই খুঁজে পাও না। যাগ্গে,মন খারাপ করো না। গতবছরের শুঁটকো একর্ন খেয়ে আর কী করবে? তার চে' বরং এস আমার সঙ্গে।"
"কোথায় রে চিপু?"
"ওই দ্যাখো, স্মিথ আর জোন্সদের বাগানে টিউলিপরা মাথা তুলছে। তার মানে মাটির নিচে বাল্ব আছে। ডগাগুলোও মন্দ খেতে নয়।চলো,সাবাড় করি দুজনে।"
পরদিন সকাল। জোনাথন রোজ ভোরে ইশকুলের বাস ধরতে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। সেদিন বাড়ির বাইরে গিয়েই শুনলো পাশের বাড়ির স্মিথ আঙ্কলের হাহাকার।
"কালকেই টিউলিপগুলো বসিয়েছিলুম। সব বাল্বগুলো খুঁড়ে বার করে খেয়ে গেছে!"
জোনাথনকেই শুধোন, "কে এরকম ক’রে উজাড় করলো বলো তো?”
জোনাথন চমকে পিছনে তাকায়। তার মায়ের লাগানো টিউলিপেরও একই অবস্থা!
“ওই দ্যাখো, বদমাইশ দুটো ওই যে গাছে বসে আছে। যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। ওদেরই কীর্তি!”
স্মিথ আঙ্কলের বিলাপ আর থামতে চায় না। ততক্ষণে জোনাথনের মা প্যাটিও বাইরে এসেছে। দুজনে মিলে গোদা আর চিপমংককে শাপশাপান্ত করে।
গাছের ওপরে দুলতে দুলতে একজন আর নীচের ডালে বসে আরেকজন ভাবলেশহীন চেয়ে থাকে।
একরাশ দুঃখ নিয়ে বাসস্টপের দিকে এগোতে এগোতে জোনাথন প্রতিজ্ঞা করে,বার্ড ফিডারটা এবার এমন জায়গায় লাগাবে যে গোদার সাধ্য হবে না পাখিদের খাবার খায়।
স্কুলে আজ প্রথমেই এনভায়রনমেন্ট ক্লাস। মিসেস কে স্লাইড দেখাচ্ছেন কী করে গাছের বংশবৃদ্ধি হয়।
হিকরি, ওক, বাটারনাট, ওয়ালনাটের ফল মাটিতে পড়ে পচে যায়। তাদের থেকে নতুন চারা গজানোর সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে এসব গাছের জঙ্গল গজিয়ে ওঠে কী করে?
নিজেই প্রশ্নটার উত্তর দিলেন মিসেস কে।
"ওয়েল,কাঠবিড়ালী গাছ লাগায়।"
সমস্বরে বিস্ময় ভেসে আসে, "কাঠবিড়ালী?"
মিসেস কে হাসেন,"কাঠবিড়ালীর ভুলো মন। সারাবছর ধরে মাটির তলায় নাটস লুকিয়ে রাখে সব্বার চোখের আড়ালে। তারপর নিজেই ভুলে যায় সেগুলো কোথায় রেখেছে। সেই সব ভুলে যাওয়া বীজ থেকেই হয় চারা। আর তার থেকেই মহীরুহ।"
শুনতে শুনতে জোনাথনের মনটা ভিজে আসে। তাদের বাগানের গোদা,যে সবসময় পাখির খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্যে ওৎ পেতে থাকে, সে কিনা গাছ পুঁতে যায়? নিজেরই অজান্তে?
মিসেস কে হোমওয়ার্ক দেন, "নিজের নিজের ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে ওক, বাটারনাট, হিকরি আর ওয়ালনাটের চারাগাছ গুনবে। ক্লাসে এসে বলবে কে কতগুলো চারা দেখতে পেয়েছো।"
ক্লাসের ছেলেমেয়েরা খুব রাজী। তাদের আর তর সয় না। কখন ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে চারা গুনবে।
মিসেস কে বলেন,"শুধু গোনাই নয়,আজ থেকে ওদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব তোমাদের। জীবনে এমন করেই ভালো কাজের বীজ ছড়িয়ে দিও।দেখবে তারা একদিন বিরাট গাছ হয়ে সবুজ পাতায় তোমায় ভরে দেবে।
Do good and forget, it'll grow some day."
0 Comments