বিকাশরঞ্জন হালদারের গল্প



তেষ্টায় প্রখর

কে মাঝে মাঝেই দেখতাম,আমাদের বাড়ির কাছে রাস্তার ধারে ঐ তেলেভাজা দোকানটায়।"নস্কর রেস্টুরেন্ট "। কালো লম্বা পাছা ভারী একটু স্থূল,ন্যাড়া মাথায় একগোছা টিকি,একটা ময়লা ধুতি হাঁটুর ওপর কাছা দিয়ে পরা। প্রথম দেখে বুঝতে দেরি হয়নি যে ও বিহারী।  যদিও সেকথা ও জানতোনা। বার বার দোকানে দ্যাখাদেখিতে,আমার সঙ্গে ওর যেনো একটু  মাখামাখি ভাব হয়ে গিয়েছিলো।বয়েস বড়োজোর  আঠারো - উনিশ। গোলগাল মুখটায় একজোড়া ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে,কতকগুলো অপরিষ্কার হলদেটে দাঁত সবসময় বেরিয়ে থাকতো!চোখের কোনে পিচুটি! কথা বলতে গেলেই, মুখদিয়ে থুতু ছিটকাতো!তবু ওর মুখের মধ্যে একটা ভারি সুন্দর মমতা মাখা ভাবথাকতো জড়িয়ে! দুচোখে একটা বিষণ্ণ উদাস দৃষ্টি ভেসে বেড়াতো! ওকে সবাই পাগলা পাগলা বলেই ডাকতো। আমিও ডাকতাম। ওর পেছন উঁচু করে,খালি গায়ে থপ থপ করে হাঁটাচলা,ওর কথা বলা,ওকে পাগলা  পাগলাই  লাগতো।

দোকানে গিয়ে  বসতে  না বসতেই  পাগলা কাছে এগিয়ে এসে বলতো- " কি খাবি  বেগুনি? কচুরি না মুরি? কাঁচা নোংকা দোবো? "এমন করে আস্তে আস্তে  হেসে হেসে  বলতো,আমি ওর মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতাম!আমি দেখতাম পাগলা জলের জাগটা, অন্য টেবিল থেকে আমার খাওয়ার টেবিলে এনে বসিয়ে  দিচ্ছে  হেসে হেসে! ঐ সময়  ওর  বুকের আড়াল থেকে, ওর  দুর্লভ  মনটা মুখে চোখে ফুটে উঠতো!  আর  সবার  অলক্ষ্যে ওর হাসিতে, কথাতে আমি নিষ্পাপতা লক্ষ্য করতাম! বলতো - "তুই বসে বসে খা,আমি  আলুর খোসা ছারাই,কি লাগে বলবি,আমি এসে দোবো,তোর  উঠতে হবেনে। " 

ওর কাজ ছিলো, দোকান থেকে খানিক দূরের টিউব ওয়েল থেকে,বালতি হাতে করে,কলসি ঘাড়ে করে, অনেকবার করে জল আনা,কয়লা ভাঙ্গা,ধোঁয়া আঁচে,  তালপাতার পাখা নিয়ে হাওয়া দেওয়া,আলুর খোসা ছাড়ানো, টেবিল পরিষ্কার করা,প্লেট ধোঁয়া,বাইরের দোকান থেকে ঠোঁয়া আনা,এইসব। 

ওকে দেখতাম দোকানের পরিচিত খদ্দেরদের সঙ্গে  বেশ ভাব।যেমন আমার সঙ্গে!ও কি করতো,অনেকের সঙ্গে একটু কাছে গিয়ে,দাঁড়িয়ে থেকে, দুটো কথা বলে আনন্দ পেতো!ওর চটপটে ব্যাপারটা ঠিক ছিলোনা!সব কাজে ওর যেনো একটু দেরি করে ফেলা,একটু  ধীর গতি।এই প্রকৃতিগত স্বভাবের জন্যে,দোকানদারের কাছে ওকে খুব বকুনি খেতে দেখতাম!ও মুখের কিছু  বলতো না! মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতো! মনে মনে হয়তো নিতো না! কারণ মুখ বুজে সব সহ্য করে নেওয়া  যায়না বলেই! যাই হোক ওকে মাঝে মাঝে বকুনি খেয়ে গোমড়া হয়ে যেতে দেখতাম। আমার কেমন কষ্ট হতো!পাগলার জন্যে তখন,মনে মনে  মনখারাপ করতো আমার!দু একবার সরে দাঁড়িয়ে ওকে  চোখ মুছতে দেখেছি! আবার কাউকে জানতে বুঝতে না দিয়ে, কাজ করতেও দেখেছি!দেখেছি ওর মতো কতো পাগল এরকম কতো রাস্তা ঘাটে,এখানে সেখানে ফুটে থাকে!কেউ তাদের জানেনা,বোঝেনা! তাদের দ্যাখেও না ভালোকরে!মানুষের ব্যস্ত জীবনে অন্যের জন্যে সময় নষ্ট করার সময় কোথায়!দেখলে হয়তো মানুষ অনেক শ্রী অনেক সমৃদ্ধি পেতে পারতো!

পাগলা মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে ফিস ফিস করে  বলতো- "তোর এত্তা কতা বলবো,কারোর বলবিনিতো? আমি থাকবুনি,তলে দাবো।অনেক দূলে তলে দাবো।একেনে ভালো নাগেনা। বদ্দ কত্ত  হয়! হ্যাঁ লে বদ্দ কত্ত  হয়!কতো আত্তিলে ঘুমুই। ঘুম হয় না।আবার ছকাল থেকে ছুদু খাতুনি! "

দেখতাম শেষের  দিকে মাঝে মাঝে প্রায়  সময় পাগলা আমাকে বলতো- "তলে দাবো,তলে দাবো..."বুঝতে পারতাম ওর ভেতরটা ছটফট করছে!এতো নিশ্চিন্ত  জীবন,ও একা,ওর খাওয়া থাকা,কিছু মাহিনা তো আছেই,তাহলে ওর অসুবিধেটা কোথায়! কিন্তু ওর মনের কোনের বাইরে দাঁড়িয়ে,আমারা যে যা-ই ভাবিনা কেনো,দেখিনা কেনো,ওর অসুবিধে নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে একটা যন্ত্রণার রূপ নিচ্ছিলো,যার জন্যে ও ছটফট করছিলো!পালাই পালাই করছিলো! 

একদিন দোকানে ঢোকার আগে দেখলাম, পাগলা  একহাতে বালতি আর এক হাতে কলসি নিয়ে পেছন নেড়ে নেড়ে জল আনতে যাচ্ছে,আর দোকানদার( মালিক ) এদিক থেকে  চেঁচাচ্ছে! - "আমি উঠলে কিন্তু  পুঁতে দোবো!ছোট তাড়াতাড়ি ছোট!ন্যাকামি! তিনবার করে গিলবে,আর নড়বার বেলায় নয়! বললে কানে কতা যায় না ..."

চৈত্র মাসের একটু বেলাতেই তখন রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে! পাকা রাস্তার পিচ তখনই বেশ গরম!  দেখলাম ঝট্ করে দোকান থেকে বেরিয়ে,দোকানদার বোঁ বোঁ করে দৌড়ে গিয়ে,পাগলার ঘাড়টা ধরে,রাস্তায়  ঠুকে  দিয়ে,গুমগুম করে কিল মেরে,গায়ের জ্বালা ছাড়িয়ে নিলো!গরম রাস্তা ,খালি গা! পাগলার হাতের  বালতি একদিকে ছিটকে পড়লো!মাটির কলসিটা  তবুও সে ধরে রেখেছে যত্নকরে,ভাঙ্গে নি!উঠে চোখ মুছতে মুছতে,বালতিটা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আবার  সে এগিয়ে যেতে থাকলো! 

এদিন আর দোকানে ঢুকলাম না!আমার রুচতে  কোথায় যেনো আটকালো!খেতে আর ইচ্ছে করে নি! বার বার  মনে হয়েছে,মানুষ কেনো এতো নির্মম হয়! কেনো এতো নিষ্ঠুরতা!আমরা কিসের এতো লাভের  হিসেব কষি!ভাবি আর বড়ো গুটিয়ে যাই! 

কটাদিন কাটিয়ে একদিন দোকানে গেলাম। বিশেষ করে পাগলার কথা ভেবে! গিয়ে ওর মুখে সেই  মায়া মাখা হাসি আর  একটা  স্থির  আত্মপ্রত্যয়ের আভাস পেলাম।ও তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে,কি খাবো  জানতে না চেয়ে,হাত নেড়ে কি যেনো,বোঝাতে চাইলো!আমি  কিছুতেই বুঝতে পারিনা! - "কোতো কোতো,  এত্তা কোতো দিবি। গায় কাগোত মেলে নাম  নিকে দিবি। বইছে থোবো।তাকা তাকা ...অনেক তাকা হবে!  ভ্যান ভ্যান !ভ্যান গারি  কিনবো!গারি তালাবো,তলে দাবো। আমি একেন থেকে তলে দাবো!অ- নে- ক দূলে..."

বুঝলাম ওর কথা!পাগলাও আর পাঁচটা মানুষের মতো  স্বপ্ন দেখতে  শুরু করেছে!ও দোকানে কৌট বসিয়ে  রেখে,টাকা তুলে জমাবে।গাড়ি কিনবে জীবনের  স্বাধীনতা ফিরে পাবে! চলে যাবে দৈনন্দিন যন্ত্রণা পাওয়া জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূরে! 

সেদিন পাগলার জন্যে আমার বড়ো মায়া হয়েছিলো!  মনটা মেঘলা হয়ে এসেছিলো!কিছুদিন পর থেকে ওকে আর দেখিনি!স্বপ্ন আর কল্পনার পৃথিবী ছেড়ে কোথায় কখন যে হারিয়ে গেছে কে জানে...!!

লেখক বিকাশরঞ্জন হালদার 
রঘুনাথপুর, বিরেশ্বরপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা


























0 Comments