দেশপ্রেমিক
"আরে এই বলে কি হইলো রে বাপ্পা,কস্ না ক্যান? এইডা কি তয় ডট্ বল হইলো !ভাইষ্যকার চুপ ক্যান্....আরে ক তাড়াতাড়ি ভাই আমার ...টেনশনে লুঙ্গি র গিট্টু খুইল্লা যাইত্যাসে..."
কথাগুলি শুনে,হাসি পাচ্ছে খুব ,কিন্তু হাসতে পারছি না। হাজার হোক অন্যের বাড়িতে এসেছি ....আর টিভিতে খেলা দেখছি ....গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচ--ভারত আর অষ্ট্রেলিয়ার মধ্যে।শুধু ঐ কথার জন্য যে হাসি পাচ্ছে তা নয়...এই মূহুর্তে যেখানে আছি সেখানকার পরিবেশ সম্বন্ধে আগে আপনাদের আগে একটু পরিচয় করিয়ে দিই, তারপর ....বাকি কথা পরে হবে...।
আগেই বলে নি,শান্তিপুরের রাস উৎসব দেখার ইচ্ছে বহুদিন থেকেই। কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠেনা....সুযোগ ও সেরকম ভাবে আসেনি এর আগে। জিপিদা র শ্বশুরবাড়ি শান্তিপুর।প্রতি বারই সপরিবারে আসেন। আমাকেও এবার সঙ্গে নেবেন সে প্রস্তাব আসায়...এক কথায় হ্যাঁ...কোন ভণিতা করি নি।
ছুটি নিয়ে,রাসের দুদিন আগেই জিপিদা র পরিবারের সাথে বাই ট্রেন এখানে এসে পৌঁছেছি ।দারুণ জায়গা।ঐতিহাসিক ও আধুনিকতার মিশেলে তৈড়ি সম্ভ্রান্ত এক মফস্বল শহর---যদিও একটু এগিয়ে থাকা গ্ৰাম বললেও ভুল বলা হবে না।কিছু পুরোনো আমলের বাড়িও দেখতে পাচ্ছি।
আপনারা তো জানেনই যে জিপিদা র পরিবার বলতে জিপিদা ছাড়া আর দুজন--বৌদি(মানে জিপিদার স্ত্রী) আর বাপ্পা (ছেলে)।আর তার সাথে আমি এক ফাউ যুক্ত হয়েছি।
গতকাল ই এসেছি। কাল থেকে এ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা বেশ ভালো ই।খাওয়া দাওয়া,আতিথেয়তা নিয়ে কিছু বলার নেই --অনুকরণযোগ্য। এ বাড়িতে লোক বলতে তো পাঁচজন---জিপিদার শ্বশুর,শাশুড়ি, জিপিদার শ্যালকরা তিনজন ।জিপিদার শ্বশুর মশাই রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরে।রিটায়ার্ড হলে কি হবে মনের দিক দিয়ে বেশ ফুর্তি বাজ আর অন্য সকল বাঙালিদের মত উনিও একজন ক্রিকেট প্রেমী।একটু আধটু মাতব্বরি ভাব থাকলেও,লোক ভালো।
আজ সকালেই একটা অটো ভাড়া করে শান্তিপুর থেকে কিছুটা দূরে হবিবপুর ইসকনের মন্দিরে গিয়েছিলাম ।খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা মন্দিরেই।খুব ভালো কেটেছে দিনটা...।অবশ্য একটু আগে আগেই ফিরে এসেছি সবাই...বিকেলের পর থেকেই ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে হবে....মেসোমশাই এর আদেশ ছিল, খেলা আরম্ভ হওয়ার আগেই বাড়ি ঢুকতে হবে।
ভিতর ভিতর রাগ হচ্ছিলো...মেসোমশাই ও মাসিমা তো বাড়িতে ই আছেন...তা ওঁর খেলা দেখতে অসুবিধে কোথায়!
তখন বুঝতেই পারি নি যে ওঁর খেলা দেখার সাথে আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার সম্পর্ক কি...।
যাই হোক,বাড়ি ফিরে এসে ,একটু ফ্রেস হয়ে নিয়ে টিভির ঘরে গিয়ে বসলাম।খেলা তখনও আরম্ভ হয় নি। ইএসপিএন এর ভাষ্যকার হর্ষ ভোগলে আর সুনীল গাভাস্কারের কথপোকথন চলছে...মেসোমশাই মন দিয়ে খাটে বসে শুনছেন।সোফায় বসে আছে---বাপ্পা (জিপিদার ছেলে) আর রন্টু( জিপিদার শ্যালক তমাল দার ছেলে,ক্লাস টেনে পড়ে )। টিভির ঘরের পাশেই তমালদার ঘর।কখনও এসে দাঁড়াচ্ছেন,টিভির দিকে তাকিয়ে দু একটা বিশেষজ্ঞর মতামত ছেড়ে ই, আবার ঘরে ...। জিপিদা এই মূহুর্তে ঘরে নেই ,বোধহয় বাজারের দিকে গেছেন...।আমিও টিভির দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে ওদের সাথে আলোচনায় সামিল হলাম।
খেলা আরম্ভ হল।অষ্ট্রেলিয়া ব্যাট করছে।মেসোমশাই খাটের ওপর বসা।ওদের ব্যাটসম্যানরা যদি এক রান, দুই রান নেয় তাহলে ওঁর কোন প্রতিক্রিয়া থাকে না,কিন্তু চার বা ছয় মারলেই তিরিং করে খাট থেকে নেমে মশারি স্ট্যান্ড ধরে টিভির দিকে চোখ যদিও মুখটা বেশ রাগরাগ ভাব...
'বুঝলি রন্টু,এ ব্যাডা গো দিয়া কিছু হইব না! হালায় মাইরাই যাইত্যাছে। আমার মতে এই বোর্ডের উচিৎ একটা নিয়ম বাইর করা...চাইর -ছয় খাইলেই নোট কইরা রাখ ,পরে একটা রেট ফিক্স কইরা রেমুনারেশন্ থিকা বাদ দিয়া দাও"।
'আঃ দাদু একটু ধৈর্য্য ধর,ওরাও তো খেলতে এসেছে না কি!'রন্টুর একটা চেষ্টা তো থাকবেই।
ওদিকে তমালদা একবার বেডরুমের ভেতরে চলে যাচ্ছেন,পরক্ষণেই দরজায় দাঁড়িয়ে স্কোর জানার চেষ্টা...
আমি খেলা দেখবো কি...গোগ্ৰাসে গিলছি ওঁদের কান্ডকারখানা...।
এরপর যজুবেন্দ্র চহালের বলে এক ওভারে তিনটি ছয় ও দুটো চার মারল অষ্ট্রেলিয়ার স্টীভ স্মিথ।
ব্যাস্ ,মেসোমশাই দেখি রেগে আগুন।।খাটের থেকে নেমে পায়চারি করছেন...
এরপর,তমালদা কে উদ্দেশ্য করে বলছেন..." ওই তুই একখানে কোথাও একটা বইস্যা থাক...তোর দোষে এতগুলা রান হইলো...তুই ঐ ঘরে ই থাক,রন্টু তরে সব ইনফরমেশন দিবখন।"
তমালদা দেখলাম কোন প্রতিবাদ না করে ঘরের ভেতর চলে গেল....
রন্টু আর বাপ্পার কাজ বাড়লো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম...এরপর স্মিথ যদি আরও মারে তবে তো...
'এরপর মনে হয় আমার পালা....খেলা টা দেখতে পারবো তো !'
যাইহোক একটু পড়েই ওদের ব্যাটিং শেষ হল। চা -টিফিন পর্ব চলল।রন্টু আর বাপ্পার সাথে মিশে আমিও বাচ্চাদের মত আদর আপ্যায়ন পেলাম। খেলা নিয়েই কথা চলছিল।জিপিদা,তমালদা ও এসে হাজির।যাইহোক,ক্রিকেট খেলাটা এমনিতেই ভালোবাসি আর তার উপর এমন ক্রিকেট পাগল বাড়িতে এসে পড়েছি...
সময় যে কীভাবে কেটে যাচ্ছে ...বুঝতেই পারছি না...
ভারতের ব্যাটিং শুরু হয়েছে। শুরুতে তো আর বসা নিয়ে কোন ঝামেলা থাকে না ।খেলা গড়িয়ে ভারত চাপে পড়লেই যত গন্ডগোল...
খেলা দেখছিলাম মন দিয়ে ।এক ওভারে পরপর দু বলে দুটো আউট ।তারমধ্যে একজন আবার বিরাট কোহলি। জিপিদা বুদ্ধিমান,আর আগে থেকেই হয়ত অভিজ্ঞ,তাই কাজ আছে বলে ঘর কেটে পড়লেন।নাহলে হয়ত শ্বশুর মশাইয়ের নির্দেশে সারাক্ষণ টিভির উল্টোদিকে মুখ করে কাটিয়ে দিতে হত...।'দেশের জয়ের জন্যে নাকি এইটুকু স্যাক্রিফাইস করাই যায়!
ওঠার সময় ,কানে কানে জিপি দা বলে গেল ,'দেশকে জেতানোর জন্য হাজার এক সংস্কার এখন দেখতে থাক...আজ দেশ জিতলে তোর এ বাড়িতে প্রতি বছর আসা পার্মানেন্ট । কুসংস্কারে টপার সেটা ঠিকই তবে দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রথমসারির!
শ্লগ ওভার চলছে....ছয় বলে বারো রান চাই ,জিততে হলে।হাতে দুই উইকেট। প্রথম বল হ ওয়ার পরেই দেখি রন্টু সোফা থেকে উঠে গিয়ে মেসোমশাই কে বিবরন দিচ্ছেন কি হল এই বলে।আর বাপ্পা খবর দিতে গেছে তমালদা র ঘরে...
কৌতুহল নিবারণ করতে পারলাম না...
ঘাড় ঘুরিয়ে মেসোমশাই এর দিকে তাকাতে দেখি টিভির উল্টোদিকে মুখ করে ধ্যানে বসেছেন ...আর প্রতি বলের শেষে রন্টুকে রানিং কমেন্ট্রি দিতে হচ্ছে...
খেলা দেখব কি...ডট বল হলেই ঘাড় ঘোড়াচ্ছি ... দেখি শোনা যায় নাকি নির্দেশ....
"ও বাপ্পা,তর ঐ কাকুডারে ক এট্টু ঐঘরে গিয়া বইতে...দ্যাশরে জিতানোর জইন্য এটুকু আত্মত্যাগ করতে ক ও...!
এত কিছু ভাবতে ভাবতে ওদের প্রাণখোলা চিৎকার শুনে বুঝ লাম....ভারত জিতেছে!
যাক্ বাবা! অপয়া নই তাহলে !
0 Comments