শৌভিক চট্টোপাধ্যায়ের গল্প
প্রভাকরকাকু
গল্পটা ঠিক গল্প গল্প নয়।গাল গল্প তো একেবারেই নয়।আবার সবটা সত্যিও নয়।অন্যদিকে মিথ্যে হওয়ার প্রশ্নও নেই।তাই গল্পটা অনেকটা জীবনের মত বলা চলে।
তখন ফাল্গুন মাস।রাঢ় বাংলার এদিকটায় সচরাচর পলাশ টলাশ দ্যাখা যায় না।যেটুকু যা পলাশ ফুল বিছিয়ে থাকে তা মানুষের মনে মনে।তবে গুলঞ্চ গুলমোহর কৃষ্ণচূড়া ঢেলে দেয় সারা দেহের সবটুকু নির্যাস।দিয়াদের সারাবাড়ি ফুলের মধুকরী গন্ধে একেবারে ম ম করছে।খুশিতে ঝলঝল করছে এবাড়ির ঘরদোর উঠান বারান্দা।ছোট্ট একটা সাজানো গোছানো বেশ পরিপাটি বাড়ি ওদের।দিয়ার বাড়িতে সাকুল্যে চারটি ঘর।প্রত্যেকটিতেই উপচে আসা পরিপাট্য।
এখন দিয়াদের বাড়িতে ব্যস্ততা তুঙ্গে।দিয়ার বাবা রামতনু বন্দ্যোপাধ্যায় সজ্জন মানুষ বলেই এলাকায় পরিচিত। রামতনুবাবুর নিশ্বাস নেওয়ার ফুরসত নেই।মায়েরও ঘর গেরস্থালীর কাজে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। দিয়ার মনে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।পাত্রটিকে তার বেজায় পছন্দ।বেশ লাগে মানুষটিকে।দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে। খুব যে মতের মিল রয়েছে এমনও নয় আবার মতের পুরোপুরি অমিল হচ্ছে এমনটাও নয়।বেশ ব্যলান্সড্ একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে ওদের মধ্যে।ওর হবু শ্বশুরবাড়িও বেশ সুপরিচিত। তারা একেবারেই ধনকুবের নন তবে চলে যায় একপ্রকার। সাম্য দিয়ার হবু বরের একটি কোচিং ক্লাস রয়েছে। কখনসখন টার্ণওভার কত জিজ্ঞেস করলে সাম্য বলে,'ধুর!আমার আবার টার্ণওভার। আই অ্যাম নেক্সট্ টু বিশুদ্ধ ভিখারি!'তবে দিয়ার বাবা রামতনুবাবু নিজের পরিচিতি এবং অল্পবিস্তর প্রভাব খাটিয়ে নিঃশব্দে প্রাক বৈবাহিক রেইকিটা ঠিকই করিয়ে নিয়েছেন।এবং এই সামাজিক গোয়েন্দাগিরি টুকু অনেক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাই করিয়ে নেন।এটা স্বাভাবিক। রামতনুবাবু যা খোঁজখবর নিয়েছেন তাতে তাঁর মেয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকবে।এই নিশ্চয়তাটুকুই বাবামায়েরা প্রার্থনা করেন।এটুকুই আনন্দ দেয় ওদের।সেই আনন্দ থেকে অজস্র আনন্দদানা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে নেমে আসে দিয়ার ওপর।আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই এই বিবাহে যারপরনাই খুশি এবং উন্মুখ হয়ে আছে কবে সেই বিবাহের দিন!
সেদিন আকাশ কিছুটা মেঘলা।শীতের শেষ আর বসন্তের শুরুতে এমন একটুআধটু বৃষ্টি হতেই পারে।হঠাত বাড়িতে হাজির বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু প্রভাকরকাকু।ধোপদুরস্ত চেহারা।সর্বদা গুঁজে প্যান্ট শার্ট পড়ে থাকেন।দেখলেই মনে হবে এইমাত্র মঞ্চ থেকে অভিনয় সেরে নামলেন।শেয়ার বাজারের এজেন্ট।নিজে কিছু উপার্জন করেছেন আর কিছু শ্বশুরালয় সূত্রে ম্যানেজ করেছেন।লোকটা বকে বেশি তবে খুব একটা ক্ষতিকারক নন মোটেই।
'দিয়া মা কোথায় গেলি রে!আয় মা আয়! আসব আসব করে আসাই হচ্ছিল না।বৌদি একটু চা করুন...!''কথা গুলো একনিশ্বাসে বলে নিলেন।
'আয় প্রভাকর আয়।শুনেছিস তো সব। বস অনেক কথা জমে আছে।দিয়া নিচে আয় মা!দ্যাখ কাকু এসেছেন।'
দিয়া এসে দাঁড়ায়।একটু স্বলজ্জ যেন।
'আয় মা বস!'
দিয়া সোফায় বসে।
'তোর বিয়ে এ যে কত বড় আনন্দের দিন!কী বলব।তা তুই নিজে পাত্রকে দেখেছিস তো!'
'হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়।ওদের আলাপ হয়েছে সম্প্রতি!'রামতনুবাবুই দিয়ার হয়ে উত্তর দেন।
'শুনেছি ছেলেটিতো বিশেষখারাপ নয়।তা ছেলের ইনকামটিনকাম!শুনেছি তো কোচিং না কী যেন!'
'হ্যাঁ ওর কোচিং ক্লাস আছে আর হ্যান্ডসাম... '
'হ্যান্ডসাম কি দেখতে খারাপ সে কথা বলছি না মা!আমি বলছিলাম ইনকাম আসলে সারাজীবনের ব্যাপার তো!'
'আমিও ইনকামই বলছি কাকু।হ্যান্ডসাম আরনিং!'
'চাকরিবাকরি তো করে না তাই চিন্তা... '
'কার চিন্তা? আপনার?'
'নাহ্!আমার কেন তোর বাবারও চিন্তা হবে.. '
'বাবার তেমন কোনও চিন্তা নেই চিন্তাটা আপনার।'
'নাহ্!মানে আমিও তো তোর বাবার মতই!'
'ভাগ্যিস বাবা নন!'
'আজকের দিনে চাকরি করাটা জরুরি ছিল রে মা।সরকারি হলেই ভালো হয়!'
'আপনিও চাকরি করেননা কাকু! কাকিমা যদি আপনাকে এই বয়সে ছেড়ে দেয় কী হবে কাকু!',
দিয়া মেরুদন্ড সোজা করে সোফা ছেড়ে উঠে আসে নিজের ঘরে।প্রভাকরকাকুর কথা গুলো শুনে এই কথা গুলোই শুনিয়ে দিতে চেয়েছিল ও কিন্তু পারেনি।রাগে হিলহিল করছিল সারা শরীর।ঘরে এসেই ফোন করে সাম্যকে।এই সমস্ত অপমান বন্যার জলের মত নেমে এসেছিল সাম্যর কাছে।সাম্য বড় শান্ত স্বভাবের মানুষ।ধৈর্য তার অসীম।সে বলেছিল 'শান্ত হও!ক্ষমা করতে শেখো!'
২
বছর পাঁচেক পরের কথা।ওরা দুজন এখন ঘোর সংসারী। তখন বিকেল।সাম্য নিজের ক্লাসে ব্যস্ত।দিয়া রান্নাঘরে পরিচারিকাদের কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল।ওর ফোনটা বাজছে। বেজেই চলেছে।খুব বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা তোলে।
'হ্যালো..'
'দিয়া বলছিস?'
'বলছি।আপনি?'
'আমি প্রভাকরকাকু!'
'ক্যা কাকু?'
'প্রভাকরকাকু।রামতনুর বন্ধু ভুলে গেলি মা!'
'আচ্ছা বুঝেছি।না না আপনাকে ভুলি কী করে বলুন!'সেইদিনকার সমস্ত কথা হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল আবার।মাথার ভিতর একটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি পুনরায় জেগে উঠতে পারে।
'বলছি খুব টানাটানি যাচ্ছে রে।বলতেও খারাপ লাগছে সাম্যকে বলনা কিছু টাকা আমার মাধ্যমে শেয়ারে ইনভেস্ট করতে।ও অন্যদের মাধ্যমে ইনভেস্ট করেই আমার মাধ্যমে করলে আমার দুটো পয়সা হত!'
দিয়ার মনে পড়ে সাম্য বলেছিল ধৈর্য রাখতে।
0 Comments