গল্প:
📚 প্রনব রুদ্র🔹মালদা🔹
📖 প্রচন্ড ঠান্ডা। ডিসেম্বর মাস। জাঁকিয়ে নেমেছে শীত। শরীরে ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙ্গে মিনার। পোদ্দারবাবুর বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে সে। বয়স বড়ো জোওওর দশ এগারো হবে। কাল মধ্যরাত পার করে কাজ করতে হয়েছে তাকে। পোদ্দারবাবুর মেয়ের জন্মদিনের জমকালো পার্টি। প্রঅঅচুর লোক। সীমাহীন আনন্দ। বাবুর একমাত্র মেয়ে বলে কথা! নয়ে পা রাখলো সে। মিনার এই সাজানো বর্ণাঢ্য জন্মদিন ভালোই লেগেছে। কিন্তু উপভোগ করা হয়নি আনন্দ। নানান কাজের ফাঁকে অবসর মেলেনি তার। কাজশেষে তড়িঘড়ি উচ্ছিষ্ট দানাপানিতে পেটের আগুন নিভিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতেই গুটিসুটি শুয়ে পড়েছিলো। শুতেই আরামেএএর ঘুম অলস স্বপ্ন ছূঁয়ে দেয় চোখের পাতা। কেক কেটে তারও জন্মদিন পালন হয় স্বপ্নে! পাঁচ ভাইবোন মিলে সাতজনের সংসার তাদের। সে-ই বড়ো। নুন আনতে পান্তা খতম হাড়ির হাল। অভাবের সাথে দারুণ ভাব। চরম বন্ধুত্ব। বাবা মা দিন মুজুরি শ্রমিক। আদতে কোনদিনই, জন্মদিন কবে তাই জানেনি সে। পালন তো বহুদূরের বাজনা!
সকালে ঘুম থেকে উঠেই কাজের স্রোতে ভেসে যায় - চা ক'রে ঘরে পৌঁছে দেওয়া, ঘর মোছা, গোছগাছ করা, জামাকাপড় কাচাসহ নানান কাজ।তাই শরীরের ব্যথার দিকে না তাকিয়ে কাজে এগোতে থাকে দিন।
"এই শুনছিইইস, বলি তিথির টিফিনটা রেডি করলি? তাড়াতাড়ি দিয়ে যা"- মালকিনের ডাকে টিফিনবাক্সের প্যাঁচ আটকাতে আটকাতে দৌড়ে যায়। বাবুর মেয়ে স্কুলে যাবে তার টিফিন সাজিয়ে দেওয়াটাও মিনার প্রতিদিনেরই কাজ। বাবু মেয়েকে নিয়ে দামী গাড়ি চড়ে একেবারে অফিসের জন্য বের হন। একটুপরে প্রায় প্রতিদিনের মতো মালকিনও বের হন সমাজসেবার কি সব কাজে। বাড়ি ফাঁকা হলেও তার কাজের শেষ থাকে না। মালকিনের বলে যাওয়া নির্দেশে চলতেই থাকে কাজ। ছোট শরীরের পক্ষে নিতান্তই বেমানান সে সব অনেক কাজই। প্রতিদিনই এমন চলে রুটিনমাফিক টানা।
আজ রবিবার। বাবুর বন্ধুরা বাড়ীতে এসেছেন। জম্পেস হাসি ঠাট্টা খানাপিনা চলছে। একটা উগ্র গন্ধযুক্ত গ্লাস এগিয়ে দেওয়ার সময় মিনা শুনতে পায় বাবুর এক বন্ধু বলছিলো " শিশুশ্রম নাকি সরকার আইন করে বন্ধ করেছে! চৌদ্দ বছরের নীচে কোন শিশুকে দিয়ে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করানো যাবে না। " বরফ টুকরোর বাটিটি এগিয়ে দিতে দিতে আরো শুনতে পায় ওই ভদ্রলোকটিই বলছে " কিরে বাসু তোর এই পুচকেটার বয়স কত? দেখে তো মনে হচ্ছে শিশু শ্রমিক।" বাবু হেসে বলেন "রাখ্ তোর আইন! কত দেখলাম ও সব। ওরা কাজ করলে খাবে কি? কে দেবে খেতে? আর ও যদি শিশু শ্রমিকও হয় তাতেই বা আমার কী? এই সব জাতহীন শ্রেণীর খবর কেইবা রাখে বল্? ছাড়্ তো সব ফালতু ট্রপিক। এনজয় দ্য টাইম। চিয়ার্স!" তারপর কুকুরের চিৎকারের মতো ঘরময় হাসির হিল্লোল ওঠে।
রাতে শুয়ে শুয়ে মিনা শোনা কথার প্রেক্ষিতে ভাবতে থাকে। সত্যিই তো কাজ না করলে কে তাকে খেতে দেবে? বাবা মা ভাই বোন নিয়ে ওদের অভাবে সংসারে খাবার জোটে না ঠিকমতো। কি করে বাচঁবে সে? কি করে বাঁচবে তার পরিজন? রাত বাড়তে থাকে। মিনার ভাবনারা গাঢ় হয়। এক সময় চোখে ঘুম নামে। ঘুম এক আশ্চর্য ওষুধ। বাস্তবে যা কিছু মেলে না ঘুম স্বপ্নে সব পুষিয়ে দেয়। কিন্তু এমনভাবে ভাবনার স্থায়ী সমাধান কি কিছু পায় মিনা?
আজ কোন কিছু উপলক্ষ্যে বোধ হয় ছুটি ছিলো তাই বাবুদের বন্ধু বান্ধবীরা এসেছেন বাড়িতে। ছুটির কারণ মিনা জানে না। তার প্রয়োজনও হয় না। তার তো কোন ছুটি তেমনভাবে নেই। কবে যে সে একটু ছুটি পাবে! এতো অতিথি আসাতে বেশ কাজের চাপ। উনারা নিচুস্বরে নিজেদের মধ্যে কোন একটা কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন। খাবার দাবারের প্লেট রাখতে গিয়ে ও শুনতে পায় কেউ একজন বলছেন "কিডনি লাগবে"।
খাওয়া দাওয়া চলে । শলা পরামর্শও চলে। শেষে একজন মিনাকে ডাকে। ব্যাগ থেকে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বের করে বলে "মিনা চুপ করে বসো এখানে। আর ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকো।" মিনা হাত বাড়িয়ে বসে। আরো একজন ওর মুখের সামনে এসে হাতটা ধরে দাঁড়ায়। মিনা কিছু দেখতে পায় না। কিন্তু বুঝতে পারে ওর হাতের কনুয়ের উল্টোদিকে একটা পিঁপড়ের কামড়ের মতো লাগে। তারপরে সামনে দাঁড়ানো মহিলাটি মিনার কনুই ভাঁজ করে দেয় আর বলে "যাও এবার। একটু পরে ভাঁজটা আলগা করে দিও।" মিনা উঠে চলে যায়। দরজার আড়াল থেকে দেখতে পায় দু'তিনটে ছোট কাঁচের টুকরোর উপর সিরিঞ্জ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ফেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেন দেখছেন প্রথমে ডাকা ওই মোটা মতন ভদ্রলোকটি। এরপর মুচকি হেসে বললেন "ঠিক আছে। চলবে। কাল নিয়ে আয়। আরো কিছু কাজ আছে। কালই ওগুলো সব করে নেব। বাসুর কোন চিন্তা নেই।" মিনা এসবের বিন্দু বির্সগ কিছুই বুঝতে পারে না। তার বোঝার কথাও নয়।
মিনা এখন বেডে সংজ্ঞাহীন। তার বাড়িতে কোন খবর দেওয়া হয়নি। যদি সে মারাই যায় তবে তার লাশটা পাঠানো হবে। বাবু বলেছেন "কোন কাজ নেই শুধু শুধু গ্রামের মুর্খদের এনে।" তারপর হয়তো বাবু একটু দুঃখু দুঃখু করে বলবেন " মিনা খুব ভালো মেয়ে ছিলো। অসুখে মারা গেলো।" কি অসুখ, কি হয়েছিলো অতো বিস্তারিত কিছুর দরকার নেই। বেশ কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই হলো। ব্যস্। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ! সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতন। ওর বাড়ির কেউ বা বাইরের কেউ জানবেই না বাসুর মেয়ের জন্য কিডনি নেওয়া হয়েছে মিনার ছোট্ট শিশু শরীর থেকে। কে দেখবে এই সব? কে নেবে তার খোঁজ?
সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই বোধ করি মিনা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুল পাখিদের সাথে। এখন তার ছুটি মিলেছে। হয়তো এই ছুটি অনন্তকালের জন্য। পরজন্ম যদি থাকে হতে পারে সেই পর্যন্তও সে খেলবে, ঘুরবে। কোন কাজ থাকবে না। থাকবে না এক ফোঁটা খিদে। মিনা খেলছে। শুধু একটা ব্যথা বুকের অনেকটা গভীরে বিঁধে থাকে। বাজে। কিসের ব্যথা সংজ্ঞাহীন নিষ্পাপ মুখে তা দেখা যায় না। ব্যথা কুঠারাঘাত করতে চায়। কে জানে মিনারা এই কাজে কতটা সফল হয়। দিন চলে যায়। দিন ফিরে আসে। দীন হাঁপায়। ব্যথা থাকে। আসলে ব্যথাটা এখানেই ছিলো। এখানেই থাকে। ব্যথা লেগে থাকে ঘড়ির কাঁটায় টিক্ টিক্... টিক্ টিক্...
0 Comments