🔸গল্প:
🔰ঋভু চট্টোপাধ্যায়🔹দুর্গাপুর 🔹
( সাল দু’হাজার)
🔵টিফিন কৌটোটা সেই মাত্র ব্যাগ থেকে বের করে অপরাজিতা বেঞ্চের ওপর রাখল। অমনি ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ে হুড়মুড় করে ঢুকেই একটু থমকে দাঁড়িয়ে গেল। চারদিকটা একবার দেখে লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকা সমাপ্তিকে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা ক্লাস টুয়েলভ সায়েন্স না আটর্স ?’
–আর্টস।-অপরাজিতাকে বড়দি ডাকছেন।
সমাপ্তি লাস্ট বেঞ্চ থেকেই চেল্লাতে আরম্ভ করল,‘অপরাজিতা,শুনলি তোকে বড়দি ডাকছেন, যা দেখা করে আয়।’
-হয়ে গেল।
টিফিনের কৌটটা বেঞ্চে নামিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,‘কে বলল?’
–দেখলি না, রিমিদির বোনটা এসে বলে গেল।
বড়দি আবার ডাকছে কেনরে বাবা, কোন ম্যাডাম তো কমপ্লেন করবে না, কিছু করেও নি, তাহলে? আর খাওয়া হল না। টিফিনটা ব্যাগে ভরতে গিয়েও বের করল। কি টিফিন দিয়েছে একবার দেখতে হবে, ভালো টিফিন থাকলে ফিরে এসে আর পাওয়া যাবে না। বাকি সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে নিয়ে প্যাঁচার মত মুখ করে বলবে,‘তোর টিফিনটা খেয়ে নিয়েছি, তোর খিদে পেলে আমরা চাঁদা তুলে ঝাল মুড়ি খাওয়াতে পারি।’
এমনিতে বান্ধবীদের কিছু বলে না।পড়াশোনায় ভালো হলেও সবার সাথেই খুব ভালো ভাবেই মেশে, গল্প করে। একসাথে আসে, বাড়ি ফেরার সময় এক সাথে ফেরে।এখন আবার বান্ধবীদের কিছু অন্য বিষয়েও সাহায্য করছে। তার বিনিময়ে বান্ধবীরাও টুকটাক দিচ্ছে। ঠিক কি করা যাবে ভাবতে ভাবতেই টিফিন কৌটটা খুলে মিষ্টিটা খেয়ে নিল। আরো ভালো কিছু নেই, বাকি দুটো রুটি আর আলু ভাজা আছে।এগুলো খেয়ে নিলেও অসুবিধা হবে না। ব্যাগে টিফিন কৌটটা ঢোকানো পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু ক্লাস থেকে বেরিয়েই দুটো পা কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। হেডদি মারেন না, কিন্তু খুব বকেন, কথায় কথায় শাস্তি দেন, অথবা গার্জেন কল করেন।একবার গার্জেন কল হলে অপরাজিতাকে আর দেখতে হবে না। মেজদির ম্যাথ টিউটর গত মাসে মাকে হোম ওয়ার্ক না করবার কথা বলেছিলন।স্যার চলে যেতে না যেতেই মা মেজদিকে কি মারটাই না মেরেছিল।পিঠে ঘাড়ে দাগ বসে গেছিল।রাতে মলম লাগাতে হয়েছিল।
আসলে মায়ের দোষও নেই, বাবা আচমকা মারা যাওয়ার পর মেয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে এসে যাওয়াতে প্রথম প্রথম ঠিক সামলাতে পারে নি।ডেথ গ্রাউন্ডে বাবার চাকরিটাও নিতে হয়েছিল।সব মিলিয়ে অবস্থা এক্কেবারে সঙ্গীন। মায়ের সব রাগটাই পড়ত অপরাজিতাদের তিন বোনের ওপর।একটু বেচাল হলেই মায়ের হাত চলত, কলেজে পড়া বড়দিও রেহাই পেত না।
এই সব ভাবতে ভাবতেই হেডদির ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েও একটা লম্বা শ্বাস নিল।তারপর আস্তে আস্তে দরজাটা হাল্কা করে খুলে মাথাটা গলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি, আমায় ডেকেছিলেন?’
–বড়দি কিছু একটা কাজ করছিলেন, কথাগুলো শুনেই মাথাটা তুলে বললেন, ‘এসো।’
অপরাজিতা পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকে বড়দির উল্টোদিকের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।বড়দি একভাবে আগের মতই কাজ করে যেতে লাগলেন।কিছুক্ষণ পরেই ড্রয়ার থেকে এক গাদা কাগজ বের করে টেবিলে রেখে মাথা তুলে বললেন,‘এগুলো চিনতে পারো?’
অপরাজিতা আগের মতই দাঁড়িয়ে থাকল।গলা শুকিয়ে আসছে, হাত পা কেমন যেন কাঁপচ্ছে। ঢোঁক গিলে বলল, ‘না, দিদি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
-বেশ, তাহলে একটু সামনে এসে লেখাগুলো ভালো করে পড়।
অপরাজিতা একপা একপা করে সামনে এগিয়ে চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে কাগজের বাণ্ডিলটা হাতে তুলতেই চমকে উঠল,‘এযে সব ওর নিজের হাতের লেখা।শুধু নিচে নামগুলো আলাদা কারোর হাতের লেখা।কোনটাতে সোনালি, কোনটাতে কাবেরি, কোনটাতে মুশকান।’
– মাস দুই আগে এমনি এক টিফিনের সময় আবিরা এসে বলে, ‘এবারের ওয়াল ম্যাগাজিনে তোর কবিতাটা খুব ভাল হয়েছে, মৃদুলাদি বলছিলেন, আমি তো দিদির কাছে বাংলা টিউসন পড়তে যাই।’
–তাই! কি বলছিলেন?
-বলছিলেন, এই বয়সে এত পরিণত ছন্দবোধ খুব একটা আসে না।চর্চা করলে ভালো লেখা হবে।
আবীরা কয়েকটি কথা বলে তারপরেই আসল কথাটা বলে,‘আমার একটা কাজ করে দিবি?’
– কাজ! বল।
-সেরকম কিছু নয়, তোর বাঁ’হাতের কাজ।
-ঠিক আছে, একটু বল শুনি।
-একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।
-চিঠি?কিসের চিঠি?
–এমন কিছু নয়, বয়েস স্কুলের সেই রোহিত আছে না, চিনিস তো? আমাকে একটা চিঠি দিয়েছে, তার জবাব তো দিতে হবে।আমি কিন্তু তো লিখতে টিকতে সেরকম পারি না, তাই বলছিলাম জবাবটা যদি তুই দিয়ে দিস।
-আমি!এই প্রেম পত্র থেকে আমি হাজার মাইল দূরে থাকি, মা জানতে পারলে চামড়া গুটিয়ে দেবে।
-তুই দূরে থাকিস, আমি তো থাকি না, আর তোর মা কিভাবে জানবে, তোকে তো প্রেমও করতে হবে না। আমি করছি তুই শুধু উত্তরটা লিখে দিবি।তোর মা জানতে পারবে না, প্লিস, তোকে ঝালমুড়ি খাওয়াবো।
-সেই শুরু, তারপর থেকে কত যে চিঠি লিখেছে তার কোন হিসাব নেই। কেউ কেউ নিজের হাতে কপি করত, কেউ বা অপরাজিতার হাতের লেখাটাই দিয়ে দিত। আর অপরাজিতাকে প্রতিটা চিঠির বিনিময়ে পাঁচটাকা করে দিত।সেই পাঁচটাকাতে অপরাজিতা ফুচকা, ঝালমুড়ি খেত।টুকটাক জিনিসও কিনত।
ক্লাসের মেয়েরা ছাড়া এই ঘটনা আর কেউ জানতে পারে নি। অপরাজিতার একটা শর্তও ছিল, ‘কেউ যেন জানতে না পারে।’
এত পর্যন্ত ভালোই চলছিল, সপ্তাহে দুটো থেকে তিনটে চিঠি লিখত, টাকাও পেত।একবার বাড়িতে অল্পের জন্যে ধরা পড়ে নি।সে ঘটনাটাও বেশ মজার। সকাল বেলা বিছানা তুলে খাতার ভিতরে আরেকটা খাতা নিয়ে চিঠি লিখছে এমন সময় মা এসে খাতা টেনে বলে ওঠে, ‘কি লিখছিস দেখি।’ সে যাত্রাতে কোন রকমে বাঁচলে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এর মধ্যে জেনে গেল কিভাবে? এবার যদি মাকে বলে দেয়!
-অপরাজিতা কাগজগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।হেডদি হাতের কাজ থামিয়ে বললেন,‘হ্যাণ্ড রাইটিংটা তোমার?’
অপরাজিতার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না।কষ্ট করেও ঘাড় নাড়ল,‘হ্যাঁ।’
–তাহলে তুমি আজকাল প্রেমপত্র বিক্রি করছ?
–না, মানে ঐ। অপরাজিতা একটু থতমত খেল।
-‘না মানে’ আবার কি? তুমি এই সব চিঠির বিনিময়ে টাকা নাওনি? শুনলাম দু’টাকা থেকে পাঁচটাকা পর্যন্ত নিতে। অপরাজিতা চুপ করে দাঁড়িয়েই রইল।পা’দুটো থর থর করে কাঁপছিল।হেডদি কিছু সময় চুপ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে ধমকের সুরেই বললেন, ‘কি হল, কোন উত্তর নেই যে।’
অপরাজিতা দু’চোখ ছল ছল করে উঠল।গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরোচ্ছিল না।
– ছিঃ!সেম অন ইউ।তুমি ক্লাসের ফাস্ট গার্ল, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।তাও যদি নিজের জন্য লিখতে একটা কথা ছিল, অন্যের প্রেম পত্র তাও আবার টাকার বিনিময়ে লেখা! আমি আজই সবার গার্ডিয়ান কল করব।
অপরাজিতা এবার আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারল না, হেডদির টেবিলের আরো কাছে এসে বলে উঠল, ‘দিদি, এবারের মত ক্ষমা করে দিন, কথা দিচ্ছি আর কোন দিন হবে না, বিশ্বাস করুন, আমি কান মুলছি, আপনার পায়ে পড়ছি, মাকে বললে খুব মারবে, পড়া বন্ধ করে দেবে।’ হেডদি কিছু সময় চুপ থেকে অপরাজিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘মনে থাকে যেন।’
অপরাজিতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।চোখ দুটো মুছে অফিসের বাইরের দিকে পা’দুটো বাড়াতেই বড়দি বলে উঠলেন, ‘তবে তোমার লেখার হাত কিন্তু খুব ভালো,একটাও বানান ভুল নেই, আই অ্যাম ভেরি ইমপ্রেস্ট।’
ঐ শেষ তারপর থেকে অপরাজিতা স্কুলে আর কাউকে কোন দিন কাউকে কবিতায় প্রেম পত্র লিখে দেয় নি। তারপরেও অবশ্য অনেকেই বলেছে, কিন্তু অপারজিতা সটান সেই সব অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছে।
তবে সেদিন বড়দির অফিস থেকে চোখের জল মুছে বেরিয়ে আসার পরেও কাউকে কিছু না বললেও ক্লাসের সবাই মোটামুটি ভাবে বুঝতে পেরেছিল ঐ সব কবিতায় প্রেমপত্র লেখার সাথে একটা বড় সম্পর্ক আছে।ক্লাস করাবার মাঝেও দিদিরা ঠিক ঠেস দিয়ে কিছু না কিছু একটা বলতেনই।অপরাজিতা বুঝত, আরো অনেকেই বুঝত, কিন্তু কিছু বলত না।
আস্তে আস্তে কয়েকমাস কেটে গেল।বেশ কয়েকটা মাসও পেরিয়ে গেল।স্কুলে বেশ কিছু নতুন দিদিমণি এলেন, তাদের একজনের বয়স আবার খুব কম, ঐ দিদিমণিরও তখনও বিয়ে হয় নি। উনি অপরাজিতাদের বায়োলজি পড়াতেন।অল্পদিনের মধ্যে অপরাজিতাদের সাথে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেল, টিফিনের সময় মিস প্রায়ই অপরাজিতাদের ক্লাসের মেয়েদের ডেকে ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়াতেন, পড়াশোনার পাশে আরো অন্য বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনাও করতেন। প্রেম, ল্যাঙ, ঝারি কোন বিষয় বাদ থাকত না। দিদিমণি নিজের টাকাতেই মেয়েদের কমন রুমে একটা প্যাড ব্যাঙ্কের ব্যবস্থা করেছিলেন।তখন ভেন্ডিং মেসিনের চল হয় নি।অপরাজিতা ক্লাসের আটর্স সেকসেনে একটা মেয়েকে তার বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে দিদিমণি নিজে তাদের বাড়ি গিয়ে মা বাবাকে বুঝিয়ে ব্যাপারটা সামলান। অল্পদিনের মধ্যেই দিদিমণি ক্লাস টুয়েলভের মেয়েদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে গেলেন।
কয়েক সম্তাহ পরে একদিন টিফিনের সময় আবার অফিস থেকে অপরাজিতার ডাক পড়ে।এইবার অপরাজিতা ভয়ে একদম কুঁকড়ে গেল। হেডদির অফিস থেকে বকানি খেয়ে আসার পরে আর কারোর জন্য কোন চিঠি লেখেনি, এবার কি আবার কি জন্য ডাকল?
জানতে পারলে মা এক্কেবারে আস্ত রাখবে না। ভয়ে ভয়ে অফিসের দিকে যেতেই অফিসের একটু আগে নতুন মিসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।অপরাজিতা অফিসের কাছে যেতেই নতুন মিস অপরাজিতাকে ডেকে স্টাফরুমের পাশে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন রকেমের কথাবার্তার মাঝে বললেন,‘তুমি তো খুব সুন্দর চিঠি লেখ।’
-চিঠি!কই মিস আমি তো সেরকম কিছু লিখিনি।
–না এখন না, তবে লিখেছ, আমি হেডদির আলমারি থেকে নিয়ে একদিন পড়ছিলাম, অসাধারণ।
অপরাজিতা হেসে উঠল,‘ও সব চুকে গেছে।সব বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে একটু মজা, আপনি কি যে বলেন মিস? এখন আমি আর কাউকে লিখে দি না, সব বন্ধ, বাবারে ! নাক, কান মুলেছি।’
-শুধুই বান্ধবীদের? নিজের জন্যে কোন দিন লেখনি? চমকে উঠল অপরাজিতা।নিজের জন্য চিঠি! ভাবতেই সারাটা শরীরে যন্ত্রণা আরম্ভ হয়ে যায়। ব্যাচের একটা ছেলে দুদিন বাড়ি যেতে না যেতেই মা একদিন জিজ্ঞেস করে,‘ছেলেটা কে অপু? ব্যাচে আর কেউ পড়ে না, তোরই কেন খাতা নিতে আসে?’
-কি ভাবছ?
-এই আপনার প্রশ্নের উত্তর, সত্যি ম্যাম নিজের জন্য কোন লেখবার চিন্তা করিনি।সব বন্ধুদের জন্যেই লেখা।
-সে তুমি তোমার বন্ধুদের জন্যে বন্ধ করেছ বেশ করেছ, আমার জন্য একটা লিখে দেবে?
-অপরাজিতা আবার চমকে ওঠে, ‘আপনার জন্যে?’
–হ্যাঁ।আমি বাংলাতে অতটা ভালো লিখতে পারি না।
তারপরেই অপরাজিতা আরো কিছু কথা বলতে যাচ্ছিল, সেই সময়েই টিফিন শেষের ঘন্টাটা বেজে উঠল। অপরাজিতা কিছুই বুঝতে পারছিল না।ঠিক কি করা যাবে, তখনো খাওয়া হয় নি,স্টাফ রুমের পাশে একা বসে। বায়োলজি মিস একটু আগেই বলে বেরোলেন, ‘আমি তোমার জন্য আলু কাবলি এনে দিচ্ছি।’ মাথার মধ্যে হাজার হাজার শব্দ ঘুরছে। একবার মিসকে দেওয়া চিঠিটা পড়ছে, একবার সাদা খাতাতে চোখ রাখছে। এমন সময় রুমের ভিতর একটা ছায়া ঢুকতে দেখে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল হেডমিস দাঁড়িয়ে আছে। অপরাজিতা থতমত খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই হেডমিস বলে উঠলেন, ‘কি রে চিঠি তো লিখছিস, মিসকে তোর পাঁচটাকা নেওয়ার কথাটা বলেছিস?’
1 Comments
খুব নির্মল আনন্দের গল্প
উত্তরমুছুন