দ্য রায়-চলচ্চিত্র যাদুকর
সিনেমা যা আমাদের নিত্যদিনের ঘটনার চিত্তাকর্ষক রূপদান।অনেক সময় তা কাল্পনিক জগতেরও হতে পারে বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের নির্যাস থাকতে পারে এর মধ্যে।কোনো সাহিত্যিকের কালজয়ী রচনার উপস্থাপনাও সিনেমার মুখ্য বিষয় হতে পারে।আমরা আমাদের জীবনের ঘটনাগুলোকে বিভিন্ন চরিত্রের আলোকে, সে সাদা কালোই হোক আর ইষ্টম্যান কালারই হোক তার আঙিনায় দেখি আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ি।সেই সিনেমার রেশ আমাদের মনে অনেক দিন রয়ে যায়।ভালো পরিচালকের হাত ধরে ঐ সৃষ্টি পাড়ি দেয় নানান দেশের সংস্কৃতির প্রতিযোগিতায়।
এমনি একটি সাদা কালো ছবি,যেটি আজ থেকে ৫০বছর আগে (১৬.১.১৯৭০)মুক্তি পেয়েছিল, সেইটিই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু।সিনেমাটি হল বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কাহিনী "অরণ্যের দিনরাত্রি" উপন্যাসের চিত্রায়ন।যার পরিচালক আরেক মহান ব্যক্তি শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায়।
চিরকাল আমাদের যুবক প্রজন্মের
একটা ছকভাঙা জীবনের সঙ্গী হতে ইচ্ছা করে।গতানুগতিক জীবনের বাইরে বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস জীবন আমাদের নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে তোলে।আর সেই অ্যাডভেঞ্চার যদি অরণ্য কেন্দ্রিক হয় তবে তো কেল্লাফতে।এমনি এক গল্পে চার বন্ধু কোলকাতার কোলাহল মুখর কৃত্রিম পরিবেশ থেকে পাড়ি দেয় বতর্মান ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলার ডালটনগঞ্জ নামক জায়গায়।সেই পালামৌ যাকে দেখে বিখ্যাত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তি-বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। চার বন্ধু সঞ্জয়( সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়), অসীম (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়), হরি (শমিত ভঞ্জ)এবং শেখর(রবি ঘোষ)।চার ভিন্ন স্বভাবের বন্ধু ছুটি কাটাতে ডালটনগঞ্জ উপস্থিত হয়।সুদর্শন,সুঠাম চেহারার সৌমিত্রের মাচো লুক আজো আচ্ছা আচ্ছা নায়ককে বলে বলে কুপোকাত করতে পারে।অপরদিকে শুভেন্দুর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত বামপন্থী লুক এককথায় অপূর্ব।শমিত ভঞ্জ পেটাই চেহারা নিয়ে ক্রিকেটার।আর 'বাটকুল' চেহারার রবিঘোষ যার প্রতি কথাতেই হাস্যরসের উদ্রেক ঘটায়।সিনেমার শুরুতেই আমরা যাকে বলি 'কাস্টিং' তাতে ধামসা মাদলের সুর বুঝতে অপেক্ষা রাখে না যে আমরা সভ্য জগত থেকে এক আদিম অরণ্যের বুকে বসবাসকারীদের সঙ্গী হতে চলেছি।তাইতো ইংরেজী দৈনিকে আগুন ধরিয়ে রবি ঘোষের বিখ্যাত উক্তি-"সভ্যতার সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ।"এই দৃশ্য দেখেই পরিচালকের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। এরা সবাই উপস্থিত হয় ডালটনগঞ্জের ডাকবাংলোয়।এই পটভূমিতেই শুরু হয় সিনেমার আসল যাদু।
সাঁওতাল রমণীর ভূমিকায় অসাধারণ মেক আপে সিমি গারোয়াল।কানে বড়ো মাকড়ি,চুলে ফুল,গলায় মালা, স্বল্প বস্ত্রা "দুলি"চরিত্রে সিমি যেনো সত্যি বনের রাণী।তীক্ষ্ণ চোখ,টিকালো নাক ,অসাধারন চেহারার অবয়ব অরণ্যের দিনরাত্রির স্বাদকে অনন্য করে তোলে।এইখানেই" দ্য রয়'স ম্যাজিক"।বলিউডের অন্যতম গ্ল্যামারাস নায়িকাকে ঐ চরিত্রে অভিনয় করানো উনি বলেই সম্ভব।অপরদিকে অনন্ত দাশের চোখ ধাঁধানো মেক আপ সত্যি মনোমুগ্ধ করে তোলে।সিনেমায় এক অনন্য ভূমিকায় শর্মীলা ঠাকুর।অর্পণা যার ডাক নাম রিনি।আধুনিকা বসনে অনেকখানি ঐ যুগ থেকে এগিয়ে সিনেমায় যিনি পাহাড়ি সান্যালের মেয়ে।সঞ্জয়ের রিনির প্রেমে পড়া,হরির দুলির সাথে অন্তরঙ্গতা, রিনির বিধবা বৌদির সাথে সঞ্জয়ের প্রেমময়তা এবং বিভিন্ন সময়ে বন্ধুদের মদের ভাটিতে দেশী মদ খেয়ে বাওলামো অনবদ্য রসাত্মক।সিনেমার অন্যতম একটি দৃশ্য "মেমোরি গেম" যা খুবই আকর্ষণীয়।সব মিলিয়ে নিয়ম ভাঙার এক অসাধারণ মায়াময়তা দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে।মেলার দৃশ্য,পরিবেশ নির্বাচন, চরিত্র নির্বাচন সবই সত্যজিৎ রয় বলেই সম্ভব।যদি দেখে থাকেন ভালো ,আবার দেখুন।আর নতুন প্রজন্ম না দেখে থাকলে অবশ্যই দেখুন।দ্য গ্ৰেট সত্যজিৎ রায় কেনো বুঝতে পারবেন।পিয়ালী ফিল্মস এর নিবেদনে ১২ রিলের এই সিনেমাটি " গ্লোডেন বিয়ার" এর জন্য মনোনীত হয়েছিল।
সত্যি এইসব কালজয়ী সৃষ্টিকর্তা বারে বারে জন্মগ্ৰহণ করেন না।।
আলোচক দেবজিৎ সাহা
রাজগঞ্জ,পূর্ব বর্ধমান
0 Comments