উত্তম সিংহের ছোটগল্প


 
প্রতীক্ষার অবসান 

এখনও কি তুমি আমার উপর রাগ করে থাকবে। সামান্য কথা কাটাকাটি কার ঘরে হয় না বলত। তা বলে আমাকে ঘরে রেখে তুমি একা বেড়িয়ে এলে?
আপনি ভুল করছেন। আপনি যাকে খুঁজছেন আমি সেই ব্যক্তি নই। আপনি আমাকে অন্য কারও সাথে গুলিয়ে ফেলছেন ম্যাডাম।
উইকেন্ডের ছুটিতে সরগরম দিঘা। বাঙালির পায়ে যে সত্যি সরষে আছে তা এখানে এলে হাড়ে হাড়ে মালুম হয়। অনেক খুঁজে পেতে মনিরুল হোটেল বলাকায় একটি ঘর পেয়েছেন। রিসেপশনে প্রথামাফিক কাজ গুলো সারছিলেন হঠাৎ এই ঘটনার সম্মুখীন। মানুষ মেলোড্রামায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তাই গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলেও এসেছে অনেকে। উপস্থিত ব্যক্তিদের কৌতূহল বাড়িয়ে মহিলা মনিরুলের হাত ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন- কথা দিচ্ছি আর কখন তোমাকে মুখ করব না। তোমার দুটি পায়ে পড়ছি, দোহাই তোমায়, ফিরে চল।
মানুষের সমুদ্র দেখা মাথায় উঠল। ঘটতে থাকা 
মেগাসিরিয়ালটা সকলে গ্রোগাসে গিলছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে এক যুবক হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে ঢুকে এলো- কি করছ মা! ওনাকে ছেড়ে দাও। ইনি আমার বাবা নন।
ছেলেটি একপ্রকার টানতে টানতে তার মাকে নিয়ে চলে গেল। সুধী দর্শকবৃন্দ এত সহজ সমাধান আশা করেননি। কিছুটা হতাশ হয়ে নিজেদের প্রকৃতির কোলে সমর্পন করলেন। মনিরুলও তার ঘরে চলে গেলেন।
ফ্রেশ হয়ে সবে একটু বসেছেন। তারস্বরে ডোর বেলটা বেজে উঠল। মনিরুল দরজা খুলে দেখলেন ঘণ্টাখানেক আগের দেখা সেই ছেলেটা। কিছুটা ভারাক্রান্ত- আমি কি একটু ভিতরে আসতে পারি?
চেয়ারে বসতে বসতে ছেলেটি বলল- আমি অনুভব চ্যাটার্জি। কলকাতা থেকে এসেছি। মাস খানেক আগে মাত্র ষাট বছর বয়সে আমার বাবা পরিমল চ্যাটার্জি মারা গেছেন। 
ছেলেটার চোখে মুখে একটা কষ্টানুভূতি ফুটে উঠল। মনিরুল সান্তনার স্বরে বললেন- তবে তো খুব তাড়াতাড়ি তোমার বাবা চলে গেছেন। ষাট তো কোন বয়সই নয়। এখন মানুষ হেসে খেলে আশি নব্বই বছর কাটিয়ে দিচ্ছে। সত্যি, ঘটনাটা খুবই দুঃখজনক, মর্মান্তিক। 
না ততটাও দুঃখজনক নয়। বাবা বছর খানেক ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন। সেই দিক থেকে অন্তত কষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু চিন্তা হল মাকে নিয়ে। তারপর থেকেই মা কেমন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। 
তাই বোধহয় মাকে নিয়ে হাওয়া বদলে বেড়িয়েছ।
হ্যাঁ ঠিক তাই। সুধা, মানে আমার স্ত্রী বলল টানা তিনদিন ছুটি আছে, চলো মাকে নিয়ে দিঘা ঘুরে আসি। আর দেখুন এখানে এসে কি বিপত্তি। 
বিপত্তি শব্দটা কানে ঠেকল মনিরুলের। এই বিপত্তির মধ্যে সেও কোথাও কি আছে!
অনুভব মনিরুলের হাত ধরে কান্না ভাঙা গলায় বলল- কাকু এখন একমাত্র আপনিই ভরসা। 
একি বলছ তুমি। একজন অসহায় মহিলাকে আমি ঠকাতে পারব না। এ অন্যায়। আল্লা মাফ করবেন না।
মাকে যে কোনভাবেই সামলানো যাচ্ছে না। এভাবে চললে মা যে... কথা শেষ করতে পারে না অনুভব। মনিরুল উঠে এসে তার কাঁধে হাত রাখে।

দুই

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবো নামবো। বয়স্ক দম্পতি বেলাভূমিতে পাশাপাশি বসে। পিছনে অসামান্ন ঝাউ গাছেরা মুহুর্তদর্শী। বয়স্কা সমুদ্রের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন- নৌকো গুলো কেমন দুলতে দুলতে চলে যাচ্ছে দেখ। ঠিক যেন হর কি পৌরী ঘাটে মানত করা প্রদীপ। হাওয়া আর স্রোত সামলে কেমন তরতর করে বয়ে যায় বল। ওরা সব ভাসতে ভাসতে কোথায় যায় বলত? 
দূর সমুদ্রে চোখ স্থির রেখে বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন- দিগন্তে। যেখানে জলের প্রাণ, মাটির টান আকাশকে ধরে ফেলে, ঠিক সেখানেই। তুমি আমার কাছে আগে কতবার দিগন্ত দেখতে চেয়েছ, তোমার মনে আছে?
অগোছালো অন্ধকারে বয়স্ক বয়স্কা স্থির হয়ে নিশ্চুপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

তিন

ক্ষুদ্র এক ওষুধ সারা শরীরকে কীভাবে বস মানায় ভাবলেও অবাক লাগে!
যে মানুষটাকে শান্ত করতে সারাদিন সবাই হিমশিম খেল এখন দেখ কি নিষ্পাপ সে ঘুমাচ্ছে। মনিরুল নিজের ঘরে চলে এলেন। দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। তাকে কি ভীষণ ক্লান্ত লাগছে?
মনে পড়ছে ছত্রিশ বছর আগের এক সন্ধ্যার কথা। শেষ চলে যাওয়া, তার পদক্ষেপ গুলো এখনও সযত্নে রেখেছে সে। সেই চলে যাওয়া যে এভাবে ফিরে আসবে তা কোনদিন কল্পনাতেও ভাবেনি মনিরুল। আজ তার এক জন্ম প্রতীক্ষার অবসান হল। তবু মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। কাল আবার তাকে মনিরুল থেকে পরিমল হয়ে উঠতে হবে। তার আগে অন্তত একটা প্রশান্তির ঘুম ভীষণই দরকারি।

 গল্পকার উত্তম সিংহ 
বড়শুল, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ 













 

1 Comments

  1. বাঃ! খুব ভালো লাগলো;ভাবনায় অভিনবত্ব আছে।
    মানুষ, মানুষের জন্য---
    জীবন, জীবনের জন্য----
    একটুখানি সহানুভূতি, কি মানুষ পেতে পারে না!!

    উত্তরমুছুন