দীপক বেরার মুক্তগদ্য


বিষণ্ণতা,ঘুম ও 
আমাদের জীবনযাপন


বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছি মন ভাল নেই। কিছুই ভাল লাগে না। একটু আগেই আমার এক বন্ধু, সৌমেন ফোন করেছিল। কেমন আছি জিজ্ঞেস করায়, বললাম, "ভাল নেই রে, কিছুই আজকাল ভাল লাগে না।" শুনেই ও বলে, "প্রায়ইতো ওই একই কথাই বলিস।" কথাটা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। ভাবি, সত্যিই তো, লোকের কাছে বলে কী লাভ! শুধু শুধু লজ্জিত হওয়া। কিন্তু, কী করি, এরকম তো প্রায়শই হচ্ছে। কিচ্ছু ভাল লাগে না। কোনও কাজেই মন লাগে না কিছুতেই। এত চিন্তা, এত কাজের প্রেশার! তবুও মনে মনে ঠিক করি, না, এই শেষবার, এবার থেকে আর কাউকে নিজের খারাপ খবরের কথা বলব না। 

এমনিতেই আমি একটু ইনট্রোভার্ট। মিথ্যে কথাটা চট করে বলতে পারি না। তাই, আজকাল কেউ, "কেমন আছিস? " প্রশ্নটা করলেই, এটা ওটা, অন্য কিছু বলে এড়িয়ে যাই। তবুও, সেদিনই এক বন্ধু মেসেজ করে জানতে চেয়েছিল, "কেমন আছ?" তাড়াহুড়োয় লিখে ফেললাম, 'ডিপ্রেসড'! বললো, "বাঃ, কত সহজেই বললে কথাটা। এজন্যই তোমাকে এত ভাল লাগে।" ভাবলাম এতে এত সহজিয়ার কী ব্যাপার আছে, বা ভাল লাগারই বা কী আছে, কিছুই বুঝলাম না! কিন্তু, একটু খেয়াল করতেই পারিপার্শ্বিকতায় বুঝলাম, কেউ খারাপ আছি, এই মনখারাপের কথাগুলো সহজে বলেনা অন্যের কাছে। অথবা, বললেও সেটার রিএ্যাক্ট নেগেটিভ আসে।
আপনি যখনই কাউকে বলবেন আপনার মনখারাপ। তখনই পাল্টা প্রশ্ন আসবে আপনার কাছে, "কেন? কী ব্যাপার! হাজবেন্ড-ওয়াইফ সমস্যা চলছে বুঝি? ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস? বাচ্চা নিয়ে সমস্যা বুঝি?" এইরকম হাজারো গোয়েন্দা মার্কা প্রশ্নবাণ ছুটে আসবে আপনার দিকে। আর, তাতে করে আপনার চতুর্গুন মনখারাপ হতে বাধ্য।

"আপনারা কি আমার মনখারাপ ভাল করে দিতে পারেন?" আজকাল এই কথাটা সবাইকে যেন বলতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প পড়েছিলাম। সেই বাঁশিওয়ালা এসে বাঁশি বাজিয়ে যদি আমার মনখারাপটা ম্যাজিকের মত ভাল করে দিত, তবে কত না ভাল হত! আমার এই বিষণ্ণ সন্ধ্যাগুলো গোধূলির রঙিন আলোর স্পর্শে অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে উঠত! জীবনের রঙিন স্মৃতি হয়ে জীবন খাতায় জমা হত।
কিন্তু, বই এর পাতা থেকে হ্যামিলন তো আর বাস্তবের মাটিতে আসবে না! তাই নিজের মনখারাপের দায়িত্বটা আর কাউকে দেওয়া যাবেনা। অগত্যা, নিজের সমস্যা নিজেকেই মেটাতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই চলমান পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ মানুষই বিষণ্ণতায় ভুগছে। এই বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন একটা মারাত্মক রোগ। বিষণ্ণতা হল 'সায়লেন্ট কিলার' বা নীরব ঘাতক। তিলে তিলে মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়। বিশেষ করে আমাদের দেশে এই শহরে ব্যক্তি বিশেষে আয়ের বৈষম্য বিস্তর। ধনী-দরিদ্রের বিশাল পার্থক্য, লাইফ স্টাইল এর ব্যাপক ব্যবধান! এর ফলে তুলনামূলক অপেক্ষাকৃত খারাপ আছে যারা, তাদের শরীর ও মনের ওপর বিশাল প্রভাব পড়ছে।
এমনিতেই প্রতিদিনের রোজনামচায়, নিত্যকার ব্যস্ত যাপিত জীবনের বাস্তবতার কষাঘাত সবাই টের পাচ্ছি ভীষণরকম। ক্রমবর্ধমান নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, তাছাড়া, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ সমস্যায় মানুষ জর্জরিত! রাস্তায় ধূলো-ময়লা, দূষণ, ভেঙে পড়া ট্রাফিক সিস্টেমে নাভিশ্বাস! তিরিশ মিনিট এর পথ যেতে লেগে যাচ্ছে দেড় দু'ঘন্টা! অফিসে কাজের চাপ, তাও কাঙ্খিত বেতন নেই। বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পড়াশোনার সিস্টেম বদল, তরুণ প্রজন্মের বেকারত্ব। আত্মীয়স্বজনদের সামাজিক আয়োজন, জ্যাম ঠেলে ঠেলে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে ঘরে বা বাসায় ফিরে কে কার খবর রাখে? তবুও সেই একই চিরকালীন বুলি আমরা সবাই আওড়াই, "হ্যাঁ ভাল আছি, এই তো চলছে," গোছের কিছু নিয়ম রক্ষার বাণী। এভাবেই নিরন্তর আমরা অভিনয় করে চলেছি,..আর বলেই চলেছি , "এই বেশ ভাল আছি!" 

কিছু মনখারাপ বা বিষণ্ণতা সাময়িক, কিছু সময় বা কিছু দিন পরে ঠিক হয়ে যায়। আবার কিছু কিছু বিষণ্ণতা মনের মধ্যে পারমানেন্টলি চেপে বসে। তখন এই বিষণ্ণতা আপনার, আমার শরীর-মন-হৃদয়ের জন্য একদমই ভাল নয়। 

তাই, আমাদের জানা দরকার, বিষণ্ণতা কেন হয়? 
১. মানসিক বা শারীরিক ভাবে অবমাননার শিকার হলে অপমান বোধ থেকে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন। 
২. নিরাপত্তাহীনতা বা একাকিত্ব। 
৩. ব্রেক-আপ, ডিভোর্স, অথবা কোনও প্রিয়জনের মৃত্যুশোক। 
৪. বংশগত প্রভাব। 
৫. জীবন পদ্ধতিতে বড় রকমের পরিবর্তন। যেমন, চাকরি চলে যাওয়া, কিংবা চাকরি থেকে অবসর, বসবাসের হঠাৎ স্থান পরিবর্তন। 
৬. বড় কোনও রোগ হওয়া এবং সেই রোগের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। 
৭. ঠিক মত ঘুম না হওয়া বা ঘুম বেশি হওয়া। 

বিষণ্ণতার সাথে ঘুমের একটা বিশেষ সংযোগ আছে। আমাদের জীবনযাপনে ঘুমের একটা বেশ বড় ভূমিকা আছে। ঘুম কারুর কাছে বিলাস যাপন! যার চাওয়া-পাওয়া'র কোনও চাহিদা নেই, তার কাছে ঘুম খুব পছন্দের, একটা খুব প্রিয় জিনিস। সারাদিন, সারারাত শুধুই ঘুম, আর ঘুম, আর কিছুরই যেন দরকার নেই। বেশ আয়েশ করে ঘুমটাকে উপভোগ করা! 

আবার আজকাল, রাজনৈতিক নেতা কিংবা শীর্ষ বড় ব্যবসায়ীদের প্রায়শই গর্ব করে বলতে শোনা যায়, তারা কতটা কম ঘুমান। যেন তাদের মধ্যে কম ঘুমানোর প্রতিযোগিতা চলছে। কম ঘুমানো নিয়ে এত বড়াই করার কিছু নেই। কারণ, ঘুমের অভাব আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর নাটকীয় প্রভাব ফেলে। 
'ম্যাথিউ ওয়াকার' হলেন নিউরোসায়েন্স এন্ড সাইকোলজির প্রফেসর। তিনি পড়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে তে। 
'ম্যাথিউ ওয়াকার' বলেন, আধুনিক মানুষকে প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। ঘুমানোর সময় নেই। বেশি সময় ধরে ঘুমানোর চেষ্টা তাদের কম। 
তাঁর মতে, যখন আমরা শরীরের সঙ্গে লড়াই করি, তখন আমরা আসলে হেরে যাই। আমরা অসুস্থ হই, রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হই। 

কাজেই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যদি বাঁচতে চান, শরীর সুস্থ রাখুন, রাতে বিছানায় বেশি করে ঘুমান। 
মনে রাখবেন, ঘুম খুবই সার্বজনীন। আর এটা একেবারেই বিনামূল্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ঘুমের উপকারিতার সীমা নেই। তবে, ন্যাচারাল ঘুম দরকার, স্লিপিং পিল খেয়ে নয়। পরিশ্রম করুন, ব্যায়াম করুন। দেখবেন, আপনাআপনিই ঘুম এসে যাবে। 

পরিশেষে বলি, বিষণ্ণতা, বিষাদ, মনখারাপ বা খারাপ লাগা থেকে আপনাকেই বেরিয়ে আসতে হবে, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে আপনাকেই। এক্ষেত্রে কাউকে পাশে পেয়ে গেলে ভালই, বেরিয়ে আসাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আর নেহাত যদি না পাওয়া যায়, তবে কবিগুরুর কথায়, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে"। এই নীতিতে নিজেই সাহায্য করুন নিজেকে। সবসময় মনে রাখতে হবে, নিজের প্রতি ইতিবাচক ভাবনা বা ভূমিকার কোনও বিকল্প নেই। শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করুন। সর্বোপরি ভালবাসুন নিজেকে। চেষ্টা করুন জীবনকে অপার আনন্দে ভরিয়ে তুলতে। কারণ, মনে রাখবেন জীবন একবারই। খুব বেশি খরচের প্রয়োজন নেই। সুখটা সম্পূর্ণ মানসিক একটা ব্যাপার। নিজের মত করে ভাল থাকাটাই খুব বেশি প্রয়োজনীয় আজকের এই জীবনে। 

তাই বন্ধুরা, আজকের বর্তমান জনজীবনে চেপে বসা "কোভিড-19" বা 'করোনা' কে তুড়ি মেরে চলুন, কিন্তু সচেতন থাকুন। খুব ভাল থাকুন, বিন্দাস থাকুন। অনেক ভাগ্যে পাওয়া পার্থিব এই জীবনের অপার আনন্দকে উপভোগ করুন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 
"মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, 
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।" 

         গদ্যকার দীপক বেরা
                 হরিদেবপুর, টালিগঞ্জ, কলকাতা


 

0 Comments