অভিমান
মিনিট কুড়িপঁচিশ হয়ে গেছে রীণা দুটো আলমারির মাঝখানে যে একচিলতে জায়গাটা আছে সেখানে যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে,হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে।চোখের সামনে তখন একটা নিথর শরীর, ছাদের কড়িবরগা থেকে ঝুলছে। রীণার চোখ সোজা সেদিকেই।
খুব কষ্ট পেয়ে মরল মেয়েটা।সংসারে কারোকেই খুশী করতে পারলো না। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, ষোলো-সাড়ে ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে আসে। বাপ টাকাপয়সা, জিনিসপত্র কিছুই খারাপ দেয়নি, কিন্তু তাতেও অশান্তি আটকানো গেল না। শাশুড়ী জাঁদরেল আর স্বামী অতিরিক্ত মা- ন্যাওটা হলে যা হয়!
অমর ছেলেটা এমনি ভালো, নেশাভাঙ, বাজে স্বভাব কিচ্ছু নেই। কিন্তু হলে কী হবে বউয়ের মন'টাকে বোঝার মত দরদও যে তার নেই।সবচেয়ে বড় কথা মায়ের মুখের উপর কিছু বলার মুরোদও নেই এতটুকু। আর তাই শাশুড়ীর বাপ-মা তুলে গালাগাল, বিয়ের তিন বছরেও কোল খালি থাকা নিয়ে গঞ্জনা, কখনো কখনো চুলের মুঠি ধরে মারধোর, এসবই মেয়েটা চুপচাপ হজম করে গেছে।
একবার সামান্য উত্তর করেছিল,ব্যাস ওমনি পরেরদিন ওকে বাপের ঘর পাঠিয়ে দেওয়া হয়।জামাই শ্বশুরবাড়ির উঠোনে বাক্সপেটরা নামিয়ে বলেছিল,
__' মা বলল, আপনার শরীরটা ভালো নেই তাই ওকে পাঠালো ক'দিন একটু আপনার সেবা করতে'।_
শ্বশুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল,
_'আমি তো বাবা বারো মাসের রুগী, কত আর সেবা করবে! তা বাবা তুমি আবার কবে আসবে মেয়েটা'কে নিয়ে যেতে,তাড়াতাড়ি আসবে তো?'__
জামাই বাস ধরার তাড়া আছে বলে উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।আর মেয়েটার তখন দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে আসা জল উঠোনের ঠাঠা রোদে উবে গিয়েছিল।কারোর নজরে পড়েনি।
ঘরের বাইরে থেকে এবার চিৎকার চেঁচামেচি কানে এলো রীণার।কেউ আবার জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। রীণার একবার মনে হল উঠে গিয়ে দরজা'টা খুলে দেওয়া উচিত কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল এতে ব্যাপারটা অন্যদিকে চলে যাবে, খামোখা একটা সন্দেহের দানা বাঁধবে।দরকার নেই নিজেরা এসেই দেখুক কী হয়েছে।রীণা বড় আলমারিটার পিছনে নিজেকে আরেকটু আড়াল করে নিল।
কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই এক ধাক্কায় ঘরের দরজা ভেঙে হুরমুড় করে ঘরে ঢুকে এলো অমর,অমরের মা আরও দু-চারজন গ্রামের লোক। কড়িবরগা থেকে ঝুলন্ত নিষ্প্রাণ শরীর'টা দেখেই শাশুড়ী ককিয়ে উঠলো, বোঝা গেল না যন্ত্রণায় না উল্লাসে, ঠিক কী কারণে। অমরের চোখেমুখেও যন্ত্রণার ছাপ কিনা বোঝা গেল না, তবে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
পুলিশ এসে গেছে।কারা যেন ডেকে এনেছে।পুলিশ এসেই শরীরটাকে নামানোর নির্দেশ দিয়ে ঘরের বিছানা পত্র, জামাকাপড় সব ওলঢাল করে তল্লাশি চালাচ্ছে। কী জন্য কে জানে! রীণার বেশ ভয় হচ্ছে। পুলিশগুলো তল্লাশি চালিয়ে আবার ঘরের এই কোণটায় চলে আসবে না তো!
__'এই যে স্যার পাওয়া গেছে'
এক হাবিলদার ইন্সপেক্টরের হাতে কী একটা চিরকুট দিল।
__'ডেড বডির কোমরে গোঁজা ছিল, স্যার'।
সাদা ছোটো একফালি কাগজ। কাগজটা খুলতেই কয়েকজন হুমড়ি খেয়ে তাতে ঝুঁকে পড়লো।
__'দেখলেন আমি এটাই তো এতক্ষণ বলছিলাম, মাথার দোষ ছিল, বেশ কয়েকবার পীরতলায় নিয়ে গিয়ে মা ঝাড়িয়ে এনেছিল।লাভ হয়নি।ডাক্তার দেখানোর কথাও বলেছিলাম, বলেছিল আমি কি পাগল নাকি? পাগলই ছিল জানেন স্যার, তানাহলে এই কাণ্ড করে বলুন স্যার'__
বলেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো অমর,অমরের মা'ও পাল্লা দিয়ে আরেকবার হাউহাউ করে উঠলো।
ইন্সপেক্টর গম্ভীর মুখে ঘরের চারপাশ'টা একবার দেখে নিয়ে, অমরের কাঁধে হাত রেখে,
__'শান্ত হন, আত্মহত্যার কারণ যাই হোক না কেন একবার আমাদের সাথে আপনাকে থানায় যেতে হবে, কিছু রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ আছে।'
অমর চোখমুখ মুছে আজ্ঞাবাহী ভদ্রলোকের মত পুলিশের পিছুপিছু বেরিয়ে গেল। নিথর শরীরটাকে তখন কারা যেন একটা রংচটা চাদরে মুড়ে ফেলছে।রীণা লক্ষ্য করে দেখলো এটা তো তিন বছর আগে বিয়েতে পাওয়া চাদর, ফুলশয্যায় এই চাদরটাই তো পাতা হয়েছিল।
আস্তে আস্তে ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে গেল।বাইরে থেকে ভাঙা দরজায় যেমন করে হোক শিকল লাগিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে টুকটাক কথা কানে ভেসে আসছে রীণার। কারা যেন বলছে, 'যাক তোমরা মা-ব্যাটা বেঁচে গেলে, তোমাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে যায়নি'।
রীণা আলমারির আড়ালে থেকে ধীর পা'য়ে বেরিয়ে এলো। তারপর ঘরটাকে ভালো করে দেখলো একবার।খাটটার দিকে তাকালো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফুলশয্যার সেই রাত, সেই সোহাগ।কিছুক্ষণ এইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল,
__' হ্যাঁ ইন্সপেক্টর বাবু, আপনারা ঠিকই পড়েছেন "আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, শুধু আমার অভিমান ছাড়া'।
দরজার বাইরে তখনো বেশ কিছু মানুষের কথাবাত্রা চলছে।রীণাকে সেইসব আর টানছে না।সে তখন দরজার বিপরীত দিকে যে জানলাটা আছে সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর হুশ করে মিলিয়ে গেল।
রাধানগর পাড়া, পূর্ব বর্ধমান
0 Comments