সুষ্মিতা রায়চৌধুরীর গল্প



 শরৎসুন্দরী

১।

গাড়ির কাঁচটা হাল্কা নামিয়ে নিলো কুহু।আজ সানগ্লাসটা চোখ ঢাকুক অন্তরালে ।
কলকাতাকে বাইশ ঘন্টা আগে পুরোপুরি বিদায় জানিয়ে এসেছে সে ।
সাদা পেজা তুলোয় স্নিগ্ধ শরৎ আজ পুষ্প সজ্জিত এক মুঠো রঙের ঝংকারে ।।
আলো ফুটেছে গাছে,মার্কিণী শহর মাতছে উৎসবে ।।
স্টিয়ারিং এ অর্চি,সতর্ক নজর তার সামনের রাস্তায় ।
গন্ত্বব্যে ভুলের কোনো জায়গা নেই...
আর কয়েকটা দিন পেরোলেই কুহুর আর নিঃশ্বাস ফেলার জো থাকবে না ।
লেখা,নাচ তো আছেই,আছে পুজোর কাজ।বিয়ে হওয়ার ঠিক পরেই সে কলকাতা ছাড়া।এক বছর হয়ে গেলো তার সংসার সাগরপারে..খোদ নিউ জার্সিতে তার সাজের খুব চর্চা (চোখ টাটানোও আছে যদিও )!

২।

কুহুর মনটা চলে গেলো ফেলে আসা দেবীপক্ষে ।।
পাঁচদিনে দশটা জামা,বাবা নিয়ে যেতো নিউ মার্কেট !
প্যান্ডেল বাঁধার গন্ধ ঠিক ততোটাই কুহুর ভালো লাগতো যতটা লাগতো আনন্দমেলার ঘ্রাণ..লুকিয়ে একটু লিপস্টিক,আনকোরা হাতে শাড়ি সামলে,দে ছুট অষ্টমীর অঞ্জলিতে,দেরী হলেই কুশের পাশে ঐন্দ্রিলা দাড়িয়ে পড়বে !
হ্যাঁ,কুশ!!সেই স্কুল থেকে বেষ্ট ফ্রেন্ড কথাটার মানে বুঝতে শেখা ওর থেকেই ।
স্কুলের গন্ডি পেরোতেই,ভয় পাওয়া ইচ্ছেগুলো বোঝাতে চাইতো প্রথম এবং শেষ প্রেম “তুই” ।
কিন্ত “ও কেনো আগে বলছে না” এই দ্বন্ধে কেটে গেলো কলেজ লাইফ ।
হয়তো সারাক্ষণ একসাথে থাকার ফলে বড্ড বেশী নিশ্চিত হয়ে গেছিলো পরস্পরের উপস্থিতি 
সেবার সদ্য পরিণীতা কুহু ...
কলেজ শেষ করে সে তখন ইংরেজী নিয়ে মাস্টার্স  করছে।উজ্জ্বল শ্যমবর্ণা,তন্বী,কাজলনয়না,সুডৌল কোমরে অনেকেই ধরাশায়ী হলেও মেয়ে সেই পাগল একজনের জন্য।ছন্নছাড়া,কবিতা লেখা,আর দেশ-বিদেশে গান গেয়ে বেড়ানো কুশের জন্য ।।
-“ও দুগ্গা মা,তুমি তো সব জানো”!এমনটাই আব্দার থাকতো কুহুর প্রত্যেক পুজোয় কিন্তু সেই ঐন্দ্রিলার সাথে দাড়িয়ে কুশ মা দুগ্গার সামনে।
চোখে জল আসতেই হঠাৎ কুহু শুনতে পায় কুশের ডাক,“সন্ধ্যেবেলা আমার বাড়ি আসিস,বুঝলি পাগলি”!!
কুহু সেই প্রথম দেখেছিলো বাড়ির পুজো,আটচালার লাল থামে “মুখার্জী” ।বিশ্বাস হচ্ছিল না কুহুর,সত্যি সে কুশের বাড়িতে!
সম্বিত ফিরলো স্পর্শে।আলতো হাতের অকারণ ছোঁয়ায় কুশের ভরসা যেনো বাঁধভাঙার আহ্বান।।
কুহুর ধুনুচি নাচে সেদিন উদ্দাম মদিরতা !
“মা তুমি যেওনা বিসর্জন” ।।
মা তুমি থাকো ম্যাডক্সের বন্ধুত্বে,প্রথম সিগারেটের টানে,ফুচকায়,বাবা মার বকুনিতে,কিশোরের গানে,দেদার প্যান্ডেল হপিং এ,মা তুমি থাকো নির্ঝঞ্জাট সম্মোহনের আমন্ত্রণে,তুমি থাকো বিসর্জনের ঢাকে,আলতা-সিঁদুরে ।।
সেই শুরু কুহু কুশের কলকথা। দু চাকায় তখন উদাসী ফাগুণ হাওয়া...
ময়দান ঘেঁষে,কর্মব্যস্ত ডালহৌসীকে একগাল হাসি দিয়ে,ট্রামলাইন পেরিয়ে,তখন ওরা  মধ্য কলকাতায়।যেনো নতুন করে পরিচয় হয় অগোছালো ভীড়ে।কলকাতাকে নতুন করে ভালোবাসে দুজনের প্রতিশ্রুতি।
সদ্য ঝাপখোলা দোকানীর সিদ্ধিলাভের স্বপ্ন ,ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে মিনির প্রশ্ন,ট্রাফিক পুলিশের ঘর্মাক্ত নজরদারী,কখনও সবুজ কখনও লাল,যেনো সংকেতে চলাচল ।
ছোট্ট মেয়েটার শতছিদ্র জামায় একতোড়া সতেজ গোলাপের রোমান্টিকতা,”নেবে দিদি”?
খোলাভাঙ্গা চিনে বাদামে দূরদর্শনের হাতছানি ,গা ঘেঁষে দাঁড়ানো হাতটানা ময়ুরপক্ষীতে টিং টিং শব্দে বিলুপ্ত না হওয়ার অনুরণন ।শহরটায় হেঁটে চলে বেকারত্ব,টাই পরা ক্লান্ত কাঁধের সাথে তাল মিলিয়ে।
জন্জালের স্তুপের ঠিক ওপরেই সান্তার টুপি পরে কার্তিকের কাঠামো ।এখানে এভাবেই জন্ম নেয় প্রত্যাশারা...
মনে হঠাৎ যেনো কেউ ছুঁয়ে দিয়েছে সোনার কাঠি।
বহু প্রতিক্ষীত ভালোবাসা নাম পায় জোড়াসাঁকোর লাল পাঁচিল ঘেরা লোহার দরজায়।
“আমার কবি প্রেম আজ কি তবে অবশেষে উন্মুক্ত?লাল থাম,তোরণ পেরিয়ে ঝুলবারান্দা,সবুজ খিড়কী দরজা,সাদা দালানে কি আজ তবে আমার চন্দ্রমল্লিকারা প্রাণ পাবে?বৌঠানের ঘরেই কি পুড়ে যাওয়া আগুনে কবিতারা চেনা মৌতাত ভেঙ্গেছিলো ?মৃণালিনীকে লেখা শেষ চিঠিটাতে কি ছিলো অসমাপ্ত সোহাগ?এখানেই কি তবে আমরা গান বাঁধবো,”-এক নিঃশ্বাসে কুশের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো কুহু সেদিন।
কুশ হাতটা ছোয়,”আমি এখানে সমাপ্তিতেও রাজি”।
বাইক চলতো নিষিদ্ধপল্লী পেরিয়ে,রাজবাড়ির অন্দরমহলে..!!!
সিংহদুয়ারের শেকল খুলে তুলসী মঞ্চে শাঁখের আওয়াজ,
শোভাবাজার রাজবাড়ী ।।
দূর্গা দালানে কুহুর  কাজলচোখ রুপকথা বোনে বাসরশয্যার।ঝাড়লন্ঠনে জলসাঘরের আর্তি।
রাজকন্যা আজও অপেক্ষায় তিন ভুবনের পারে যাওয়ার।
ফিটন্ গাড়ি না,হাত ধরে হাঁটা মানুষটাই যে স্বপ্নের রাজকুমার।
বাইক থামে খোলা দরজার সামনে,
পরিতৃপ্ত হৃদয় তখন এগিয়ে চলে সৃষ্টির রাজ্যপাট।
কাশিমিত্র ঘাটে দুকুল ভাসানো গল্প আর এককাপ থুরি মাটির ভাড়ে চা !ওই সোদা গন্ধটা নেশা ধরায় কল্লোলীনির....
আলগা খোপা সিঁদুরী গোধূলীতে দক্ষিণেশ্বরের 
গঙ্গা...
অস্তাচলের আলোয় নোঙরে বাঁধা নৌকো..!!!পিছনে পড়ে থাকে উত্তুরে হাওয়ার হাতছানি,
মিত্র কাফে,কলতলায় বালতির কলতান,শরিকী বাড়ির আপনপর,এ্যান্টেনায় দোল খাওয়া পায়রা,ঘুড়ি ওড়ানো ছাঁদ,আর...ধূলিস্নাত আভিজাত্য।            কান আটকে যায়,জোৎস্নাস্নাত নৌকা বাওয়ার শব্দে...
শুন্যে ভাসমান লৌহমানব কলকথার ইতিহাস যত্নে আগলে রাখে রোজ...
রূপোর জ্যোৎস্নাধারায় স্নান করে প্রথম চুম্বন,চাঁদ নীল জোনাকী,মেঘ রাঙা রাত আর কবিতারা।

৩।

কিন্ত হঠাৎ !!!!
হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেছিলো সেই বছরেই ।
গঙ্গা-স্নান করে বাড়ি ফেরার সময় কার-এক্সিডেন্টে মারা যান কুশের মা বাবা !!
এক নিমেষে হারিয়ে গেছিলো কৃষ্নচুড়ার আলো,
শুন্য হয়ে গেছিলো ছায়াপথ ।ঘাটকাজ করে ফেরার পর কুশকে জড়িয়ে ধরে কুহু বলেছিলো “আমি আছি,চল বিয়ে করেনি”..না কোনও কুন্ঠাবোধ কাজ করেনি ।
মুহুর্ত চুপ..
ঠোঁটের তুরুপে রঙ্গীন আদর ,
সেই প্রথমবার বাধ ভাঙলো..।
স্বেচছায় বশ্যতা স্বীকার করে আবেদনের গোপণ মিনার,
ঠোঁটের ভিতরে উষ্ন পরাগ,
রাতের শরীর ঘুমের আদর,
নরম গভীরতা..
সকাল হতেই ফাগুণ সিক্ত কুশকে কাছে টেনে নেবে বলে হাত বাড়াতেই কুহু দেখে সে একা।পাশে একটা চিঠি-“আমার ঘেন্না হয় জীবনকে,চাই না আমি,ভালো থাকা”।হারিয়ে যায় কুশ চিরদিনের মতন।

৪।

হুঁশ ফিরলো অর্চির ডাকে,”ওই সামনের সিটে ঘুমিও না”!!
হুমম্,সানগ্লাসটা ঠিক করে নিলো কুহু,কবে যে আনন্দমেলা থেকে দেশ এ পৌছে গেলো।।
অনেক চেষ্টা করেছিলো কুহু যোগাযোগ করার ।
কিন্তু মাবাবা হারানো কুশ কিছুতেই আর চায়না কুহুর উপস্থিতি-“তোকে ভালোবাসলাম ওদের হারালাম”।এই ছিলো কুশের শেষ কথা।
তাই অভিমানী কুহু বলেনি,জীবন জন্ম নিচ্ছিলো তার ভেতরে ।
যে জীবন এনে দিতে পারতো প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়ার একটা সুযোগ...
হৃদয়ের জন্ম যে অবৈধ,বিসর্জন হলো তাই রক্তক্ষরণে ।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ একটা চেনা নম্বর দেখিয়েছিলো  ট্রু-কলার ।
কুশের সেই চেনা গলায়-“কুহু একবার আসতে পারবি”?
তাই,এই কলকাতায় যাওয়া কুহুর,
এটা দেখাতে,ইচ্ছে থাকলে পথে দেরী হয় না ।
স্বযত্নে রাখা ইউ-এস-জি রিপোর্টটা দেখিয়েছিলো সে কুশকে,”এটুকুই বলার ছিলো তোকে”।

৫।

পুড়িয়ে দিয়ে এসেছে কুহু সব অনুভূতি,ভালো না থাকলেও প্রতিশ্রুতি ভাঙবে না সে ।
না আজ আর ছাতিম ফুলের গন্ধে কবিতারা আসে না,
আসে না চোখ বুজে মাথা রেখে শান্ত হওয়ার রাত,
স্লিপিং পিল আজ বেষ্ট ফ্রেন্ড,ওরা যে কখনও পলাতক হবে না।
মাত্র দু সপ্তাহে কলকাতাকে বিদায় জানিয়েছিলো কুহু ...
অর্চি কে সে ভালোবাসতে পারেনা কিন্তু ভালোলাগাতে শিখছে কুহু ।
এখানে পুজোয় কাশফুলের সমগোত্রীয় খোঁজ,আছে পুজোর ম্যাগাজিনে নিজের নাম,এসোসিয়েসনের স্টাইল আইকন হওয়ার তকমা..
শাসনের বেঁড়াজালে অর্চিকে হারানার ভয় আজ নেই!!
আছে প্রাণপ্রণে “আমি বাঙালি”প্রমাণ 
করার তাগিদ !!!
দীর্ঘনিশ্বাসে কুহুর হাসি পেলো....
হঠাৎ শরতের রঙ লালের মতন অর্চি বলে,”আরে আমি অষ্টমিতে ছুটি নেবো পাগলি”।
ধক করে ওঠে বুকটা ।
পাগলিটা কবে ভেঙ্গেচুরে গেছে যে!!
কিন্ত অর্চি যে কি করে জেনে গেলো,তার এই অধরা পাগলিটা এখনও বিসর্জনে কাঁদে..ভালোবাসা ভালো থেকো!
জরাজীর্ণ কাঠামোই ধরে রাখে মহামায়ার নিখুঁত অবয়ব ।।
তাই আবারো এক মুঠো শরতের মেঘবালিকা কুহু,
সিঁদুররাঙা মুখে বাঁচার লড়াই লড়তেই হবে অর্চিকে নিয়ে ।।
আসছে বছর কোলে এসো মা...।।

লেখিকা সুষ্মিতা রায়চৌধুরী 
নিউ জার্সি, আমেরিকা




















0 Comments