
এক মুঠো আকাশ
মিনতি কাজ করে বেরিয়ে গেলে এককাপ চা করে নিয়ে এসে মুঠোফোনটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে পৃথা। সকাল থেকে যা চলে.... এক মিনিট দম ফেলার ফুরসত নেই। কর্তার অফিস, ছেলেমেয়ের স্কুল, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির আলাদা কম তেলে রান্না, ছেলেমেয়ের জন্য স্পাইসি কিছু... ঝক্কি কি কম?.... সবাইকে খুশি রাখতে রাখতে নিজের খুশির খবর নেবার আর সময়ও নেই... হয়তো বা ইচ্ছাটাও মরে গেছে...
যাইহোক, হাতের মুঠোফোনে হঠাৎ পরপর মেসেজ... স্কুলের বন্ধুরা.... "এই যে, আমার অক্সিজেনের যোগান চলে এসেছে ".... স্কুলে
রি-ইউনিয়ন হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে....।
প্রবালের স্কুলে এই ক'দিন আগেই হয়ে গেল
রি-ইউনিয়ন। পৃথাকেও নিয়ে যাবে বলেছিল, কিন্তু মেয়ের প্রোজেক্টের জন্য আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
পৃথার না জানি কেন মনে হচ্ছে যে রি-ইউনিয়ন থেকে ফেরার পর প্রবাল একটু অন্যমনস্ক রয়েছে... অবশ্য কাজের যা চাপ... তবু্ও....
বিকেলের দিকে ছেলেমেয়ে দুজনই ট্যিউসনে ব্যস্ত, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এই সময় একটু হাঁটতে বেরিয়ে রামকৃষ্ণ আশ্রমে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আসেন।
প্রবাল অফিস থেকে ফিরলে চা নিয়ে এসে ব্যালকনি তে বসে দু'জনে। প্রবাল যেন একটু অন্যমনস্ক...
---"কি গো, কি হয়েছে? "....
---" কই, কিছু না তো"... প্রবাল এড়িয়ে যায়।
--"কিছু না বললেই হল... রি-ইউনিয়ন থেকে ফিরে আসার পর থেকেই দেখছি কেমন যেন মনমরা হয়ে আছো,.. কিছু হয়েছে ওখানে?...
পৃথা নাছোড়বান্দা...
---" না রে বাবা, সেরকম কিছু নয় "...
---" আচ্ছা, আমাকে বলা যাবে না তারমানে.. তাই তো? "....পৃথা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
হেসে ফেলে প্রবাল....
---" তোমার ছেলেমানুষি আর গেল না... আচ্ছা, বলছি "....
---" বলো.. বলো."... প্রবালের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে গুছিয়ে বসে পৃথা।
প্রবালের বাবা মানে পৃথার শ্বশুরমশাই কোলিয়ারিতে চাকরির সুবাদে বরাবর ধানবাদে থেকেছেন। সেই অর্থে প্রবাল পুরো স্কুল লাইফটা ধানবাদেই কাটিয়েছে আর সেখানে তার নানা রাজ্য থেকে আসা অনেক অবাঙালি বন্ধু ছিল। স্কুল লাইফ, কোলিয়ারির জীবনযাত্রা এসব গল্প কিছু কিছু শুনেছে প্রবালের কাছে। এখন তো ফেসবুক, হোয়্যাটস আপের দৌলতে বেশ কিছু পুরনো বন্ধুর সাথে আবার যোগাযোগ হয়েছে। রি-ইউনিয়নে ভালোই মজা করেছে মনেহয়....
---" জানো পৃথা, অনেকদিন পর পুরনো জায়গায় ফিরে গিয়ে মনটা না খুব খারাপ হয়ে আছে "...
---" এ তো খুবই স্বাভাবিক গো...স্কুলের লাইফ, বন্ধু, পুরনো জায়গা এগুলো তো সবসময়েই ভীষণ নস্টালজিক আমাদের কাছে, আবার বেঁচে থাকার অক্সিজেনও.. তাই না?"...
---"ঠিক বলেছো। "...
---" এবার বাকীটা বলো "....
---" পুরনো সেই জায়গাটার কত পরিবর্তন হয়ে গেছে জানো?... আমরা যেখানে থাকতাম তার পাশেই একটা বিরাট মাঠ ছিল, ওখানে একটা মন্দির হয়েছে। স্কুলে আসা -যাওয়ার পথে যে শর্মাকাকুর দোকানে আমরা পেন,পেন্সিল থেকে কেক, হজমিগুলি কিনতাম.. সেটাও আর নেই তার মালিকের মত...সেই সহজ,সরল জায়গাটা যেন কেমন একটা কৃত্তিমতায় ঢেকে গেছে....নাকি আমার দেখার ভুল.. কে জানে?".....
---"আর তোমার বন্ধুরা?...তারা সবাই কেমন আছে?"...
---"সবাই নিজের নিজের জায়গায় কেউ মেনে নিয়েছে আর কেউ মানিয়ে নিয়েছে.. সবাই নিজের মত করে ভালোই আছে... শুধু.."...
---"শুধু কি? "..
---" শুধু প্রমিতের কথা জেনে খুব খারাপ লাগলো "...
---" কেন, কি হয়েছে তার? "...
---" খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল জানো? ... একটা অঙ্ক তিন-চার রকম ভাবে করতে পারতো... এক্সট্রিমলি ট্যালেন্টেড... স্যারেরাও ওকে ভীষণ ভালোবাসতেন...আমরা বেশিরভাগ ছেলেই তো ক্লাস টেনের পর বাইরে ছড়িয়ে গেলাম, প্রমিত নাকি কোন এক মেয়ের পাল্লায় পড়ে তাড়াতাড়ি চাকরির যোগাড় করতে গিয়ে এখন শেষমেশ বাড়িতে কোচিং করিয়ে পেট চালাচ্ছে.... আমি কোচিং করানোকে ছোট করছি না, কিন্তু প্রমিত এটা ডিজার্ভ করে না"...
---" কি করবে বলো? সবই কপাল "...পৃথা স্বান্তনা দেয়।
---" আচ্ছা ছাড়ো, বাকিদের খবর বলো "...
---" দু'দিন খুব আনন্দ করেছি জানো? তোমাকে তো আগেই বলেছি যে কোলিয়ারিতে আমরা কত মজায় দিন কাটিয়েছি। আমি, রাহুল, ভিকি, আনন্দ, শিবুদা, মনপ্রিত... সবাই যেন একটাই ফ্যামিলির মত ছিলাম... একসঙ্গে স্কুল, খেলা, পুজো, ঈদ, হোলি, ছট.. সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত... এমনই একসময়ে, আমরা তখন ক্লাস নাইন...একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে নতুন এসেছে, নীলম মালহোত্রা...ওর বাবা কোলিয়ারির চেয়ারম্যান ছিলেন । বুঝতেই পারছো, ক্লাস নাইন... দেখেই বুকের মধ্যে কেমন যেন ঝড় বয়ে গেল.. ছুটির পর যা শুনলাম, সে ঝড় একা আমার মনে নয় আরও অনেকের সাজানো বাগান তছনছ করেছে.."...
---"তারপর? কোনদিন বলোনি তো এতসব"....
---"তারপর আর কি? আমরা যতই ভেসে বেড়াই না.. সে কিন্তু কাউকেই বিশেষ পাত্তা দিত না। তবে কেন জানি না, আমার সাথে কথা বলতো.. এমনই বেশ কয়েকমাস পর একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখি নীলমদের বাংলোর সামনে ভিড়, নীলম সেদিন স্কুলও যায়নি.... কি হয়েছে জানতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল... মালহোত্রা আঙ্কেল নাকি সুইসাইড করেছেন."...
---"কি বলছো? তারপর?....কেন এমন করলেন উনি?...পৃথা বিহ্বল হয়ে পড়ে...
---"পরে জানতে পারলাম কোন এক বেআইনি কাজে জড়িয়ে গিয়েছিলেন যারজন্য প্রচুর অপমানিত হতে হয়েছিল ওনাকে, তাই.."..
---"আর নীলম? তার কি হল?..
---"এর কিছুদিন পর নীলমরা হরিয়ানা ফিরে গেলো...তবে যাবার আগেরদিন সন্ধ্যেবেলায় আমার সাথে দেখা করে আমার হাতে একটা কাগজের চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছিল। বাড়ি ফিরে দেখি লেখা আছে, 'আই লাইক ইউ, বাট নেভার গট আ মোমেন্ট টু এক্সপ্রেস মাই ফিলিংস.. ডোন্ট ফরগেট মি '..নীলম।'....
---"তারপর? "...
---" তারপর.?... হারিয়ে গেল নীলম মালহোত্রা..আমিও নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেলাম... তুমি এলে আমার জীবনে, আস্তে আস্তে ছেলে, মেয়ে.. আমায় পরিপূর্ণ করলে.."...
---" নীলমের সাথে পরে যোগাযোগ করোনি?"..
---"কি করে করবো? তখন তো আর ফোনের সুবিধা ছিল না, আর সেই চিরকুটে কোন ঠিকানাও ছিল না "....
---"রি-ইউনিয়নে কি হল তাহলে? খোঁজ পেলে তার?"....পৃথা একটু অভিমানী হয়...
---"আসল গল্প তো সেখানেই.."...
---"মানে? "...
---" মানে? নীলম মালহোত্রা এখন নীলম বাসু হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাসে সৌগত বাসু বলে একটা ছেলে ছিল, পড়াশোনায় ভালো কিন্তু ভীষণ প্যাঁচালো আর হিংসুটে। আমরা কেউ ওর সাথে মিশতাম না.. সে ব্যাটা টুয়েলভের পর দিল্লীতে গিয়েছিল পড়াশোনার জন্য, ওখানেই নীলমের সঙ্গে দেখা... তারপর নীলমকে কি করে পটিয়েছে ওই জানে ".....
---" ও...এই কারণে মনমরা হয়ে আছো? "…..
---" আরে না না... ওই আর কি?... তুমি আবার রাগ করলে না তো? "...
---" না না., এতো হতেই পারে "......চায়ের কাপদুটো নিয়ে রান্নাঘরে আসে পৃথা।
রাত্রে খাওয়ার পর আজ কি মনে হল অনেকদিন পর ছাদে এসে দাঁড়ায় পৃথা। রাতের আকাশটা যেন কি এক মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে তারাগুলোকে.. আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আকাশটা যেন কখন সমুদ্র হয়ে গেছে... সেই সমুদ্রের ধারে একটা আবছায়া অবয়ব যেন নিজের খেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে...
"কে ও?" পৃথা চঞ্চল হয়ে ওঠে।
অনেকবার ডেকেও কোন সাড়া পায় না পৃথা। শুধু যাওয়ার আগে একবার চোখ মেলে সে তাকায় পৃথার দিকে.... "কে ও?, ভীষণ যেন চেনা মনে হচ্ছে ".... আবার খুঁজতে থাকে পৃথা।
---" পৃথা... পৃথা... " প্রবাল ডাকতে ডাকতে ছাদে উঠে আসে।
হঠাৎ করে পৃথার ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে... চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।
---"তুমি এখানে?.. এ কি.! কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? আমার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছো? ..
---"আরে না না... ও কিছু নয় "...
---" আমাকে বলবে না? "...
---" আচ্ছা বলবো... তোমাকেই বলবো.. আর কাউকে বলিনি "...
---" বলো তাহলে."...
---"চলো নীচে গিয়ে শুয়ে শুয়ে বলি... হিম পড়ছে."....
প্রবালের হাতটা ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় পৃথা। আকাশ সমুদ্রে তখন একটার পর একটা ঢেউ এসে আবার ফিরে যাচ্ছে...
0 Comments