
সময় পেরিয়ে প্রেম আজও চিরন্তন
"দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না---
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না---
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।"
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ভোরবেলায় পাশের বাড়ির 'এফ এম রেডিও' থেকে ভেসে আসা জোর ভলিউমে বাজানো রবীন্দ্র সঙ্গীতে...,তাকিয়ে দেখি দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে, ভোর ০৫ টা ৪৫ বাজে। আজকাল সকালবেলা একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। নীলাঞ্জনার সকাল বেলার কাজকর্ম, বাজারপত্র হয়ে গেলে একসাথে চা খাই। নীলাঞ্জনা পাশে থাকলে আমারও একটু সুবিধে হয়। কিন্তু, গানের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গিয়ে সব গন্ডগোল হয়ে গেল। হালকা একটা বিরক্তির আঁচ মনের কোণে দানা বাঁধে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল বলে। কিন্তু কী আর করা..! অগত্যা, বালিশে মুখ গুঁজে আবার শুয়ে পড়লাম। ভোরের অবিচ্ছিন্ন নীরবতায় চোখ দুটো বন্ধ করে গানটি শুনতে শুনতে কখন যে হারিয়ে গিয়েছিলাম অতীতের সেইসব বর্ণময় দিনগুলোতে, বুঝতেই পারিনি!
সেইসব দিনগুলো, যে দিনগুলো হৃদয়ের গভীরে ঘুমিয়ে আছে বহুকাল। চলার পথের স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে আজও অমলিন হয়ে আছে আমার ফেলে আসা জীবনের সেইসব 'নানা রঙের দিনগুলি!' শ্রান্ত পথের ক্লান্ত পথিকের মত পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, পেরিয়ে গিয়েছে জীবনের অনেকটা সময় এই শহরে, এই কলকাতায়। সময়ের অবিশ্রান্ত ধারায় চলমান সময়ের মাঝে বিলীন হয়ে যায় জীবনের মুহূর্তগুলো প্রতিনিয়ত। আমরা হেঁটে চলেছি নিরন্তর জীবনের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ক্রমশ, ক্রমাগতভাবে অনন্তের দিকে..!
আমার শহর, আমার ভালবাসার শহর হল কলকাতা। একটা বাঙালিয়ানার সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে আমার আর কলকাতার হৃদয়ের সাথে।
মনে পড়ে যায়, সেদিনের সেই দামাল শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে, স্কুল পেরিয়ে কলেজ জীবন! তারপর 'ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি। সত্তরের দশকের কলকাতা, উত্তাল রাজনীতি, ছাত্র আন্দোলন, ভাষণ, স্লোগান, মিছিল, কত কিছু!
মনে পড়ে যায় নস্টালজিক জীবনের কথা, নীলাঞ্জনার কথা! কীভাবে নীলাঞ্জনার সাথে প্রথম পরিচয়? খুব মনে পড়ছিল সেইসব দিনগুলোর কথা।
ইউনিভার্সিটিকে বামদিকে রেখে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের দিকে হাঁটছিলাম। এমন সময় সুরেলা নারী কন্ঠস্বরে ডাক---
"এই যে শুনছেন?"
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাই--
"এই তো আমি ডাকছিলাম। আমি নীলাঞ্জনা, নীলাঞ্জনা সেন।"
দেখেই চিনতে পারি, আমাদেরই কলেজের ছাত্রী, আমার এক ক্লাস জুনিয়র, বাংলা অনার্স।
হ্যাঁ জানি, আমি বললাম।
"ও আপনি আমাকে চেনেন, কী সৌভাগ্য আমার!"
বললাম, সৌভাগ্যের কি আছে? খুব ভাল আবৃত্তি করেন, কলেজে কালচারাল কম্পিটিশনে প্রত্যেক বছর প্রথম প্রাইজ বাঁধা। অ্যানুয়াল ফাংশনে পার্টিশিপেশন, কত হাততালি। আপনাকে চিনব না?
যাইহোক, আমি....,বলতে গিয়ে থমকে গেলাম।
"জানি, অরিন্দম,অরিন্দম সরকার। থার্ড ইয়ার ইংলিশ অনার্স।"
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নীলাঞ্জনা বলেন।
ও, আমাকেও তো আপনি চেনেন দেখছি! আমি বলি।
নীলাঞ্জনা বলেন, "আমার সম্বন্ধে তো আপনি অনেক কিছু বলে গেলেন। নিজের ব্যাপারে তো কিছুই বললেন না?"
সঙ্গে সঙ্গে বলি, আমার ব্যাপারে বলার সুযোগ টাই বা পেলাম কোথায়? তাছাড়া আমার নিজের সম্বন্ধে কিই বা বলার আছে?
"এত বড় লেখক আপনি, কলেজ ম্যাগাজিন - এ আপনার লেখা পড়িনি ভেবছেন? শারদীয়া কল্লোল - এ আপনার গল্প, কবিতা সব পড়েছি।"
নীলাঞ্জনা এক নাগাড়ে বলে চলে।
আরে, না না, ও আর এমন কি!
বলেই জিজ্ঞেস করি, আমাকে ডাকলেন কেন বললেন না তো?
নীলাঞ্জনা বলেন, "রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কথা বলা যায়? চলুন কফি হাউসে যাওয়া যাক।"
নীলাঞ্জনা দেখতে ছিল খুবই সুন্দরী! তাই ওর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগটা হাতছাড়া করতেও মন চাইছিল না। তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
কফি হাউসে গিয়ে একদিকের কোণের টেবিলে গিয়ে বসলাম। ও নিজেই দুটো কফির অর্ডার দিল। অনেকক্ষণ ধরে দু'জনে পরিচয় পর্ব সহ নানান বিষয়ে গল্প চালিয়ে গেলাম। ওর সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। জানলাম, ওর কবিতার প্রতি, গল্প-উপন্যাসের প্রতি, সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা। কথায় কথায় অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। সেদিন বাড়ি ফিরতে আমাদের প্রত্যেকের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।
এটাই ছিল আমাদের জীবনের রোমান্টিক প্রেমের সূত্রপাত।
পরবর্তী কালে নীলাঞ্জনার সাথে আমার বিয়েটা খুব একটা সহজে সুসম্পন্ন হয়নি। কারণ, নীলাঞ্জনার হাই-প্রোফাইল ব্যারিস্টার বাবা আমার মত বেকার লেখক ছেলের সাথে বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। কিন্তু, নীলাঞ্জনা আর আমি দুজনেই পরস্পরের প্রেমে পাগল ছিলাম। নীলাঞ্জনা আমাকে বিয়ে করতে চেয়ে ক্রমশ বাবার বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ নীলাঞ্জনা একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। তারপর অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এই অধমের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা সম্ভব হয়েছিল। আমরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছিলাম। তারপর জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পথ পাড়ি দিয়ে আজও রয়ে গেছি উত্তর কলকাতার শোভা বাজারের চুন-সুরকি, পলেস্তরা খসে পড়া বাপ-ঠাকুর্দার এই পুরনো জীর্ণ বাড়িতে।
এতক্ষণে বহুদূরে চলে গিয়েছিলাম স্মৃতির মেঠোপথ ধরে যাপিত জীবনের ধূসর মায়াজালে! ফেলে আসা দিনগুলোর আলো ছায়ায় হাতড়ে খুঁজে ফিরছিলাম কিছু প্রিয় সময়, কিছু অনন্য মুহূর্ত, কিছু প্রিয় মুখ, কিছু প্রিয় উপলব্ধি, কিছু ভাল লাগার স্পর্শ-আমেজ, অন্তরের গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু চিরচেনা ঘটনার স্থিরচিত্র। নিজের অজান্তেই স্মৃতির পথ ধরে হারিয়ে গিয়েছিলাম এক অন্য সময়ের সীমানায়। খুঁজে পাই এক অন্য 'আমি' কে। হারিয়ে যাই বিলীন হয়ে যাওয়া অতীতের অনন্য বিলাস-ভ্রমণে!
হঠাৎ সম্বিত ফেরে নীলাঞ্জনার ডাকে---
"কী গো এখনও ঘুমোচ্ছো? আমার বাজার থেকে এসে তোমার চা পর্যন্ত বানানো হয়ে গেল এখনও ওঠোনি!"
বললাম, তোমার সাহায্য ছাড়া উঠি কী করে বল, নীলাঞ্জনা?
নীলাঞ্জনা বলে, "আরে বাবা, ওই ওঠার কথা বলেছি না, ঘুম থেকে ওঠা, মানে ঘুম ভাঙার কথা বলছি।"
না না, ঘুম তো আমার অনেকক্ষণ আগেই ভেঙে গেছে। এমনি শুয়ে শুয়ে সাত-পাঁচ ভাবছিলাম।
"ও, কোনও গল্প উপন্যাস এর প্লট?" নীলাঞ্জনা জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ, গল্প উপন্যাস এর প্লটই বটে! আমাদের অতীত জীবনের গল্প, আমাদের ভালবাসার গল্প, আমাদের এই ভালবাসার শহরের গল্প!
"থাক থাক, ওইসব ভেবে আর কাজ নেই" বলেই
নীলাঞ্জনা আমাকে দু'হাতে ধরে খুব সাবধানে বিছানার পাশে রাখা হুইল চেয়ারটায় বসিয়ে দেয়। আমাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। দু'জনে একসাথে বসে চা খাই। গল্প-গুজব করি। এটাই আমাদের প্রতিদিনের রুটিন।
ও হো! এই দেখুন, কথায় কথায় আপনাদের তো বলাই হয় নি। বছর খানেক আগে হঠাৎ আমার একটা 'সেরিব্রাল এ্যাটাক' হয়েছিল, তারপর থেকেই শরীরের বাম পাশটা প্যারালাইজড্ হয়ে যায়! এখন নীলাঞ্জনা ছাড়া আমি অচল। তাই, এখন নীলাঞ্জনাই আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমি এখন অকেজো, বাতিল একজন মানুষ! নিজেকে নিজের প্রতি রাগ হয়, ঘেন্না হয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, "কী অপাত্রে, নীলাঞ্জনার কী অদ্ভূত ভালবাসা!" এই ভাবনাটা নীলাঞ্জনাকে বলিনা কোনও দিন। কারণ, আমি জানি, এই কথাটা যে আমি ভাবি, বা মনের মধ্যে পোষণ করি, সেটা জানলে, নীলাঞ্জনা খুবই কষ্ট পাবে, ভীষণ কষ্ট পাবে।
আসলে, শরীরটাকে নিয়েই আমার যত সমস্যা। নিজেরটা নিজে করে নিতে পারলে ওর অন্তত কিছুটা সুবিধে হত। কিন্তু, ডান হাতে লেখার কাজটা করতে পারি। ভাগ্যিস শরীরের বাম দিকটা অবস হয়েছিল! তা না হলে আমার লেখাটাও বন্ধ হয়ে যেত। লিখতে পারছি বলেই তো বেঁচে আছি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাই। লেখা মনোনীত হওয়ার ই-মেইল পাই, তখনই আনন্দে ভরে ওঠে বুকটা। তার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!
নীলাঞ্জনা মাঝে মধ্যেই আমার স্মার্টফোন থেকে ই-মেইল এর ইনবক্স চেক করে। কোনও ম্যাগাজিনের এডিটরের মেইল এসেছে কিনা, আমার কোনও লেখা মনোনীত হল কিনা? লেখা মনোনীত হলে অভাবের সংসারে কিছু টাকা উপার্জনের পাশাপাশি ওর মুখমণ্ডলে আলাদা একটা আলোর রেখা, একটু অমল আনন্দের উদ্ভাস দেখতে পাই। তা হল, আমার লেখা মনোনীত হওয়ার আনন্দ! আমার জন্য ওর গর্ববোধের আনন্দ! সংসারে এত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও নীলাঞ্জনা আমার লেখা গল্প পড়ে, কবিতা পড়ে, আবৃত্তি করে। কবিতাতে ওর দারুণ সেন্স! দারুণ সুন্দর করে ও আবৃত্তি করে। কবিতাগুলো যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আমি অবাক হয়ে শুনি!
এমনই আমাদের ভালবাসা, এটাই আমাদের বাঙালিয়ানা, এটাই আমাদের শহর কলকাতা, আর এটাই আমাদের সেন্টিমেন্ট!
হঠাৎ নীলাঞ্জনা আনন্দে চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে! আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, "এবারের শারদীয়া দেশ পূজাবার্ষিকীতে তোমার উপন্যাসটা সিলেক্টেড হয়েছে। এইমাত্র এডিটরের মেইলটা এল। ওহ্! আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না!" নীলাঞ্জনা উঠে এসে আমার গালে চুমু খায়। এডিটরের ই-মেইলটা আমাকে স্ক্রোল করে করে দেখাতে থাকে।
আমি কিন্তু মেইল দেখিনা, দেখতে থাকি নীলাঞ্জনার মুখ, ওর মুখমণ্ডলের বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রকাশ!
কী অসাধারণ নীলাঞ্জনার এই প্রেম! কী অসম্ভব উদারনৈতিকতা, কী অসাধারণ হৃদয়বৃত্তি!
প্রেম নামক এক কোমলতার অনন্য শৃঙ্খল, যা মানুষকে চিরকালের জন্য একসূত্রে বেঁধে ফেলতে পারে! নীলাঞ্জনার এই প্রেমের মধ্যে অতীত বর্তমানের আমি কোনও ভেদ বা ফারাক খুঁজে পাই না। ওর ভালবাসার অতীত-বর্তমান সব যেন একাকার হয়ে যায়!
"দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না.."
হয়তো, থাকে না দিনগুলি সোনার খাঁচায়!
তবুও, আমাদের এই কলকাতা শহরে আমাদের মতই অনেক মানুষ আছে, যারা পরস্পরকে ভালবেসে একসাথে জীবন কাটায় পরম মমতায়, অথবা বেদনা বিচ্ছেদে! তারাও সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, বুকে আগলে তাকে বড় করছে। একটা আশা নিয়ে বেঁচে রয়েছে, সুসময়ের আশা! অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের আশা! সে আশা শেষ হয়ে গেলে, আবার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে, আবার একটা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে! একটা অদম্য লড়াই এর মধ্যে 'হার না-মানা' বেঁচে থাকা!
এই হল আমাদের শহর কলকাতা। কঠোর কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্যেও একঝলক সূর্যকিরণের আশায় সবাই একসাথে থেকে প্রাণপণ বেঁচে থাকা!
স্মৃতির চোরাবালিতে এভাবেই আমিও ক্ষণিক হারিয়ে গিয়েছিলাম। আবার ফিরে আসি বর্তমানের দেওয়াল ঘেঁষে। যেখানে জীবন সত্য, যেখানে বাস্তবতার স্পর্শে চেতনা সত্য। এই আসা-যাওয়ার লুকোচুরিই আমার আর নীলাঞ্জনার বেঁচে থাকার পাথেয়। স্মৃতির সাগর থেকে সিঞ্চন করে আনা প্রাণসঞ্চারী ভালবাসাই আমাদের জীবনবোধের অলৌকিক সারথী।
রবীন্দ্রনাথের 'অচল স্মৃতি' থেকে নীলাঞ্জনা আবৃত্তি করে চলে---
"আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি।"...
0 Comments