বিকাশরঞ্জন হালদারের স্মৃতি আলেখ্য


ছায়া ফেলে যায়...

শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। এর ঠিক উল্টো দিকটায়। আমাদের  সেই ভাড়া বাড়িটা এখন সম্পূর্ণ অতীত।কলকাতা শহরের ঐ বাড়িটায় ফেলে রেখে এসেছি জীবনের অনেক গুলো বছর। তখন আমারা আমাদের ছোটো বেলায়। পড়তাম " মিত্র  ইনস্টিটিউশন " - এ। বাবা  " জি  পি ও " তে- ডেপুটি পোষ্ট মাস্টার -(২)। বড়োদের মুখেই শুনেছি। বুঝতাম না। খুব ভোর বেলা উঠে পড়তে হতো। সকালে স্কুল।বাবা আমাদের দু ভাইকে হাত ধরে স্কুলে দিয়ে আসতো। বাণ্ড পাঁউরুটি কিনে দিতো। কেক বিস্কুট কখনও কখনও। খোলা হাওয়ায়  বাসা থেকে ঐ পথটুকু  বাবার হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার- তখনকার সেই ভালো লাগাটা বেশ মনে পড়ে। মনেপড়ে স্কুলে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োতে জুতোয় ফিতে লাগাতে পারতাম না ঠিক মতো। একদিন রেগেগিয়ে  বাবা বলল জুতো  বিক্রি করে দিয়ে আসবে! এই দেখুন বলতে গিয়ে একা একা কেমন হাসছি!  সকালে একটু বেলার দিকে। সকাল ৯ টাই হবে বোধ হয়। কি সুন্দর সুর তুলে মিষ্টি সুরে " সাইরেন " বাজতো।সেই শ্রুতি সুখ এখনও কাছে আসে। আমি  তাকে খুঁজে পাই। এবার বলি- ( একটু  চুপি চুপিই বলছি) আমাদের ঐ বাড়িটার  সামনের  গলি দিয়ে কিছুটা দূরে ডলিরা থাকতো। আমাদের মতোই হবে।তবু দিদি বলেই ডাকতাম।ভারি মিষ্টি দেখতে! হাসলে কেমন একটা মোহ তৈরি হতো। ভালো লাগতো খুব।ওর দু গালে টোল পড়তো! বেশ বুঝতে পারি- ঐ বয়েসেও আমারা দু ভাই,ওকে  পাগলের মতো  ভালোবাসতাম। বার বার দেখতে ইচ্ছে করতো। কাছে যেতে ইচ্ছে করতো। একদিন  মা কে লুকিয়ে, দু ভাই ডলিদিদের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। জ্যাঠাইমা (ডলিদির  মা)আমাদের আদর করে,লুচি মিষ্টি খাওয়ালেন। অনেকটা সময়ও কেমন যেনো কম মনে হলো। ( সুখের সময় সত্যিই বড়ো কম!)  আমাদের  ফিরতে দেরি দেখে,মা চিন্তা করছিলো। মনে আছে ঐদিন দুভাই  মায়ের হাতে লাঠি পেটা  খেয়েছিলাম। এখন বুঝি সেটা ছিলো আমাদের জীবনে একটিবার প্রেমে পড়া! শহরের সেই কিশোর বেলা,সবুজ- সোজা প্রেম,সেই ভালোবাসার অনুভূতি, টান,এখন স্মৃতি!যা একদিন ফেলে রেখে আসতে  হয়েছে ঐ শহরে। রবিবার মাঝে মাঝেই  বাবা আমাদের কলেজ স্কোয়ারে বেড়াতে নিয়ে যেতো। সাঁতার দ্যাখার সেই সব দিন। সেও তো বুকে বড়ো ছায়া ফেলে যায় আজও। নীল আকাশের তলায়,নীল জলের সমসাময়িক হিল্লোল! আর চায়না মোটর দিন গুলো মনে পড়লে বড্ড কষ্ট হয়! একটা ছোট্ট ঘটনা তুলে ধরা যাক। হ্যাঁ ঘটনাই তো। পুজোর সময় একবার বায়না ধরলাম, ঠাকুর দেখতে নিয়ে যেতে হবে। মা,  বাবাকে বলল আমাদের ঘুমিয়ে নিয়ে আসতে। বাবা শর্ত দিলো হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখতে হবে। কোলে ওঠার কথা বলতে পারবো না। আমরা  রাজি। হায়! হেঁটে হেঁটে বাবা-ই হার মানলো আমাদের কাছে। হেসে বুঝিয়ে বাঝিয়ে তাড়াতাড়ি  বসায় ফিরলো আমাদের নিয়ে। এখন আমরা  দঃ ২৪পরগনার, রঘুনাথপুরের গ্রামের বাড়িতে।বাবা নেই। বাবা নেই!! বি এফ এ - ডিগ্রি  নিয়ে,গভর্নমেন্ট  আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে দাদা এখন দিল্লিতে  সপরিবারে। আমি এই বাংলার মাটিতে একটু আধটু  লেখালেখির নেশায় যাপন করে চলেছি জীবন। শহরের সেই সব ছেড়ে আসা সম্পর্ক গুলো আবছা। একটা দুটো এখনও অবশ্যই উজ্জ্বল। সেদিনের সেই দিদি ডাকা ডলি,পার্ক, স্কুল,বেড়াতে যাওয়া,ঠাকুর দেখতে যাওয়া,একটুও হারায়নি।স্মৃতি হয়ে আছে। বেঁচে আছে যেনো নতুন সম্পর্কে।এখন এক দিকে গ্রাম, আর একদিকে ফেলে আসা শহর কলকাতা।এর মাঝখান দিয়ে জীবন বয়ে চলেছে, তুলির টানে,আঁকা বাঁকা নদীর মতোই...

লেখক বিকাশরঞ্জন হালদার 
রঘুনাথপুর, বিরেশ্বরপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা 































0 Comments