
ইনফ্যাচুরিয়েশান
সুজনেষু ইন্দ্র,
এই চিঠি ঠিকানা হীন হয়ে ডাকবাক্সে জমা থাকবে যেমন জমা রেখেছি আমাদের দুটি বছরের কথা।কোথাও পৌঁছাবে না এই স্মৃতি।স্মৃতি আদতে কোথাও যেতেই পারেনা তার নিয়তি একই ভাবে এক জায়গায় থেকে যাওয়ায় তবু সে সময় ছাপিয়ে চলতে চায়।তুমি,তোমার শহর আর আমি_আজ তিনজনেই বদলে গেছি।কি লাভ শহরের নামে?আসলে সব শহরেই এমন দু একটা ব্যর্থ প্রেমের গল্প থাকেই।কেমন আছো তুমি?তোমার এখনকার শহরের উঁচু বিল্ডিং, প্রচুর গাড়ি আর ধোঁয়ার মাঝে আমাদের নদীর পাড় রেলব্রীজের আধা শহর গুম হয়ে গেছে নিশ্চিত!
তবু তুমি শুনলে হয়তো অবাক হবে বছর কয়েকের মধ্যে ফ্ল্যাটে ভরে গেছে আমাদের ছিমছাম এই জায়গা।সেদিন বাজার সেরে ফেরার পথে আমাদের কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে দেখে কষ্ট হলো।গেলো ঝড়ে একেবারে শ্রীহীন হয়ে গেছে।অথচ ওর নীচে যেদিন প্রথম তুমি ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিলে ওর তখন যৌবন কাল।পড়ে ফেরার পথে আবছা আলো আঁধারীর সেই একান্ত আমাদের গাছটা আজ আমাদের সম্পর্কের মতো শেষের পথে।তুমি জানো সুশীল স্যারের কাছে ফিজিক্স পড়তে যেতাম শুধু তোমায় দেখবো বলে।খুব বাজে পড়াতেন কিচ্ছু বুঝতাম না কিন্তু তুমি যে ওখানেই পড়তে।হয়তো ভুলে গেছো সেদিন তোমার পাশে প্রথম বসেছি লোডশেডিং হতেই তুমি বললে,এবার স্যার হ্যারিকেন আনতে গিয়ে নতুন বৌকে আদর করে আসবে বুঝলে?আমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিলাম।তুমি ভীষণ দুষ্টু ছিলে ইন্দ্র।আসলে স্পষ্টবাদী ছিলে।তাই যেদিন পড়তে দিল্লী চলে গেলে আমায় পরিস্কার বলে দিয়েছিলে,লং ডিসট্যান্স রিলেশানশিপ অসম্ভব।ভাগ্যিস বলেছিলে তাই আজ তোমার পাশে হট প্যান্ট পরা তোমার উজ্জ্বল বৌকে ফেসবুকে ওয়াল জুড়ে দেখে ততটা কষ্ট হয়না।লং ডিসট্যান্স রিলেশানশিপ আর বোধহয় ততটা পোড়ায় না।
আসলে বয়সের ভার বারবার অতীতচারী করে তোলে মনে হয় খুব একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে আর চিৎকার করে বলছে,ইন্দ্র এখানে এই নদীর পাড়ে অনেক কাশ ফুটে আছে।রতনদার বাবা এখনো আলুকাবলি বিক্রি করে একবার আসবে?চেটে চেটে শেষ নুনঝালটা ভাগাভাগি করতে?গোঁ গোঁ আওয়াজ করি ঘুমের মধ্যে।এতটুকু জোরে শব্দ বেরোয় না।পোষ্ট অফিসে যাবার পথে ফুটপাতের দোকানগুলো সস্তার জামা কাপড় সাজিয়ে বসে থাকে ওখান থেকে প্রয়োজনের কেনাকাটা সারি।কোর্টমোড়ে দুই শিফটে কোচিং পড়াই তারপর মা আর আমি এখনো ওল সেদ্ধ দিয়ে ভাত চটকে নিই।এই দিয়ে সাপটে যেদিন ভাত খেয়েছিলে আমাদের বাড়ি মা খুব লজ্জা পেয়েছিলো জানো।আমাকে এতো বকেছিলো,কেন বললি না ইন্দ্র খাবে?ছি ছি কত বড়োলোকের ছেলে এই ওলসেদ্ধ দিয়ে ভাত দিলাম?একটা ডিম নিয়ে আসতাম অন্তত।মা আসলে বোঝেনি তখন সব ভালো লাগারই ছিলো।
উচ্চমাধ্যমিকের দুমাস আগে থেকেই তোমার বদলটা টের পাচ্ছিলাম।রেলব্রীজে ওঠার মুখে প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করে সত্যদার টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করেছিলাম।কি ভীষণ নিষ্প্রিহ ভাবে বললে,এতো সময় তোমার?এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে?বাড়ি যাও এখন প্রেম করার সময় নয়।পড়তে বসো বাড়ি গিয়ে।খুব অভিমান হয়েছিলো।সত্যদা এখন জেরক্স মেশিন বসিয়ে নিয়েছে।বুথ থেকে কেও ফোন করে না।সবার ফোন স্মার্ট।তুমি দিল্লী যাবার বহুদিন পর তোমার ফোন নম্বর দিয়েছিলো মিথিলেশ।ফোন করলেই তুমি বুঝিয়ে বলেছো,ওসব ইনফ্যাচুরিয়েশান তুমি এখনো মনে রেখেছো ঝিনুক?পাগল নাকি?আমি রুমালে চোখ মুছতাম আর সত্যদা পান চেবানো দাঁতে আমার বুক মাপতো।ওড়নায় নিজেকে আরো আড়াল করতাম।তুমি আমায় তুই না বলে তুমি বলতে কেন?এই প্রশ্নটা এখনো কুরে কুরে খায়।
ইনফেচুরিয়াশানে তুমি কতকি করতে পারো সে কেবল আমি জানি।তাই অনুমান করার চেষ্টা করিনা বিবাহিত আদরে তুমি কতটা দস্যি।তবে কি জানো সরস্বতী পূজায় নিয়ম করে স্কুলে যাই।তোমার আমার গল্প গুলো বারান্দার পাঁচিলে আজো কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ওদের ছুঁয়ে আসি।চোখটা একটু জ্বালা করে।ডাক্তার বলেছে এ্যালার্জী।তা হবে।এখন তো দিন দিন রোগ বাড়ছে।মিষ্টি ছেড়েছি বহুকাল।থাইরয়েড বেড়েই চলেছে।গালগুলো ভেঙেচুরে কোটরে।বন্ধুরা ভাবে প্রেমে ব্যর্থতার চিহ্ন।কেউ কেউ সহনাভূতি দেয়,এ কি চেহারা ঝিনুক?এমন করলে কোন ছেলে পছন্দ করবে বলতো?আমি ঠ্যাং তুলে সাইকেলে চড়ে পড়াতে যাই।
আমার ফেসবুক এ্যাকাউন্টে ইলেভেনের ছবি দিয়ে রেখেছি।রোজ ফ্রেণ্ড রিকুয়েস্ট চেক করি।যদি কোনদিন তুমি...
শহরটা বদলে যাচ্ছে দ্রুত।গাছ কেটে রাস্তা চওড়া হচ্ছে যেমন আমার শূণ্য সিঁথি।রাস্তার ধারে সাহেবী ধাঁচের বাড়িগুলো একটাও নেই শুধু ফ্ল্যাটের খোপ এখন।তবু পূর্ণিমার দিনে আলো গলে পড়ে মোহময় হয় তোমার আমার পুরোনো শহর।তোমার স্মৃতির ছোঁয়ায় জেগে ওঠে যেমন আমার ঝিমানো শরীর।ভালো তুমি আছো বুঝতে পারি।কোনদিন দেখা হলে দোলের লেগে থাকা রঙ ঘষে তুলে দিও গোপনে এঁকেছিলে যত ইনফ্যাচুরিয়াশানে।তাহলে হয়তো আমিও একটু ভালো থাকবো।
অপ্রলাপ বন্ধ করি এখানেই।
ইতি
পুরোনো কেয়াতলা মাঠ
লেখিকা সৌমী আচার্য্য
বি-১৩/১১০,কল্যানী, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ
0 Comments